ইসমাইল আলী: বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ গত কয়েক বছর ধরে দ্রুত বাড়ছে। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা সভরেন গ্যারান্টিযুক্ত বিদেশি ঋণ নিচ্ছে, যা সরকারের প্রচ্ছন্ন দায় বাড়াচ্ছে। কারণ কোনো কারণে এসব সংস্থা ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে সরকারকে সে দায় বহন করতে হবে। আবার বেসরকারি খাতেও বিদেশি ঋণ বাড়ছে লাফিয়ে। সব মিলিয়ে ১২ বছরের ব্যবধানে দেশের বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে ২৬৫ শতাংশ।
বিদেশি ঋণ বাড়ায় তা পরিশোধের চাপও বেড়েছে। এতে এক যুগের ব্যবধানে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ শোধের পরিমাণ ৫২৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এ ঋণের সুদ পরিশোধ বেড়েছে ৪১১ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের গতকাল প্রকাশিত ‘ইন্টারন্যাশনাল ডেট রিপোর্ট ২০২৩’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটিতে বিশ্বের সব দেশের এক যুগের ঋণ ও তা পরিশোধের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
এতে দেখা যায়, ২০১০ সালে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ ছিল ২৬ দশমিক ৫৭২ বিলিয়ন ডলার। ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৭ দশমিক ০১২ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ যুগের ব্যবধানে দেশে বিদেশি ঋণ বেড়েছে ৭০ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে স্বল্পমেয়াদি ঋণ। ২০১০ সালে এ ঋণের পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২২ সাল শেষে দাঁড়িয়েছে ১৮ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ১২ বছরে স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ বেড়েছে ১৫ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার বা ৫২৮ শতাংশ।
এদিকে ১২ বছরে দেশের দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বেড়েছে ৫৩ দশমিক ২৮১ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ২৪০ শতাংশ। ২০১০ সালে এ ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২২ সালে বেড়ে হয়েছে ৭৫ দশমিক ৫০১ বিলিয়ন ডলার। আর ১২ বছরে আইএমএফ (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) থেকে নেয়া ঋণ বা এসডিআর (স্পেশাল ড্রয়িং রাইটস) বরাদ্দ বেড়ে দ্বিগুণের কিছুটা বেশি হয়েছে। ২০২২ সালে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দুই দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলার, ২০১০ সালে যা ছিল এক দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ বৃদ্ধির হার ১১২ দশমিক ৬২ শতাংশ।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০২২ সাল শেষে সরকারি ও সভরেন গ্যারান্টিযুক্ত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৭ দশমিক ৬০৮ বিলিয়ন ডলার, ২০১০ সালে যা ছিল ২১ দশমিক ১৪৬ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ১২ বছরে সরকারি ঋণ বেড়েছে ৪৬ দশমিক ৪৬২ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ২২০ শতাংশ। আর ১২ বছরে বেসরকারি ঋণ ১৬ মিলিয়ন থেকে বেড়ে ৭ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। এ ঋণের প্রায় পুরোটাই বিভিন্ন দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে উচ্চ সুদে নেয়া।
যদিও সরকারি ঋণের বড় অংশই সহজ শর্তের ও কম সুদের। বর্তমানে সরকারের বিদেশি ঋণের ২৭ শতাংশ নেয়া হয়েছে বিশ্বব্যাংক থেকে, ২০ শতাংশ এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এবং ১৫ শতাংশ জাপান সরকারের থেকে নেয়া হয়েছে। এর বাইরে সরকারের ঋণের ৯ শতাংশ চীন থেকে নেয়া, রাশিয়া থেকে নেয়া আট শতাংশ এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক উৎস থেকে নেয়া ৯ শতাংশ। এসব ঋণের সুদহার বেশি ও পরিশোধের শর্তও কঠিন।
সব মিলিয়ে বর্তমানে সরকারের ঋণের গড় পরিশোধকাল দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৮ বছর, যার মধ্যে গ্রেস পিরিয়ড ছয় বছর। সহজ শর্তের ঋণগুলোয় গ্রেস পিরিয়ড ও পরিশোধকাল বেশি হলেও কঠিন শর্তের ঋণে তার উল্টো চিত্র।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১০ সালে দেশের দীর্ঘমেয়াদি ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ছিল এক বিলিয়ন ডলারের কম (মাত্র ৮২১ মিলিয়ন ডলার)। ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ১৪১ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ১২ বছরের ব্যবধানে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ পরিশোধ বেড়েছে চার দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পরিশোধের পরিমাণ ২০১০ সালে ছিল মাত্র ২০৩ মিলিয়ন ডলার। ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ০৩৭ বিলিয়ন ডলার।
প্রসঙ্গত, ২০২২ সাল শেষে মোট জাতীয় আয়ের ২০ শতাংশ দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ। আর বিদেশি ঋণ পরিশোধ (ডেট সার্ভিসিং) দাঁড়িয়েছে জাতীয় আয়ের এক শতাংশ ও রপ্তানি আয়ের ১১ শতাংশ।