রহমত রহমান: মো. আমির হোসেন (ছদ্মনাম)। ২০১১ সালে তিনি ‘সাঁটলিপিকার-কাম-কম্পিউটার অপারেটর’ পদে একটি কর অঞ্চলে যোগ দেন। এ পদের কর্মচারীর বেতন গ্রেড-১৩। ‘নিয়োগ বিধিমালা, ১৯৯৫’ অনুযায়ী এই পদ থেকে ‘কর পরিদর্শক’ পদে পদোন্নতিতে ফিডার পদে তিন বছর চাকরি করতে হবে; সঙ্গে বিভাগীয় ৫০ শতাংশ নম্বর নিয়ে পাস করতে হবে। এই বিধিমালা অনুযায়ী ২০১৪ সালে আমির হোসেন পদোন্নতি পাননি। ‘আবার আয়কর বিধিমালা, ২০১৬’ অনুযায়ী ফিডার পদে পাঁচ বছর চাকরি ও ৫০ শতাংশের ৯ শতাংশ পদোন্নতি এই পদে। এই বিধিমালা অনুযায়ী, ২০১৬ সালের শেষ দিকে আমির হোসেনের কর পরিদর্শক পদ পাওয়ার কথা। কিন্তু ২০২৪ সালের মে পর্যন্ত অর্থাৎ প্রায় ১৩ বছরেও এই কর্মচারী পদোন্নতি পাননি। ১৩ বছরে আমির হোসেনের সামাজিক ও পারিবারিক মর্যাদা কোথায় গিয়ে ঠেকল? সঙ্গে আর্থিক অবস্থা? এ তো গেল এই কর্মচারীর পদোন্নতি বঞ্চনার গল্প। এবার আসি জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের গল্পে।
হাবিব উল্লাহ (ছদ্মনাম)। ২০১৪ সালের ‘উচ্চমান সহকারী’ পদে একটি আয়কর অঞ্চলে যোগ দেন। এই পদের কর্মচারীর বেতন গ্রেড-১৪। ‘নিয়োগ বিধিমালা, ১৯৯৫’ অনুযায়ী এই পদ থেকে ‘কর পরিদর্শক’ পদে পদোন্নতিতে ফিডার পদে তিন বছর চাকরি করতে হবে। সঙ্গে বিভাগীয় ৫০ শতাংশ নম্বর নিয়ে পাস করতে হবে। আবার ‘আয়কর বিধিমালা, ২০১৬’ অনুযায়ী ফিডার পদে আট বছর চাকরি ও ৫০ শতাংশের ৬২ শতাংশ পদোন্নতি এই পদে। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি ‘প্রধান সহকারী’ (১৩তম গ্রেড) পদে পদোন্নতি পান। পদোন্নতি পর্যন্ত সব ঠিক ছিল। কিন্তু যখনই ‘কর পরিদর্শক’ পদে এই দুজনের জ্যেষ্ঠতা তালিকা করা
হলো, তখনই শুরু হলো ‘বৈষম্য’।
দেখে নিন বৈষম্যের নমুনা। মো. আমির হোসেনের ‘তিন বছর’ পর হাবিব উল্লাহ যোগ দেন। আমির হোসেন ১৩-গ্রেড আর হাবিব উল্লাহ ১৪-গ্রেডে যোগ দেন। হাবিব উল্লাহ আট বছর পর পদোন্নতি পেয়ে আমির হোসেনের সমান বা ১৩-গ্রেডে উন্নীত হলেন। কিন্তু আমির হোসেন ১৩ বছর চাকরি করেও ১০তম গ্রেডে (কর পরিদর্শক) পদোন্নতি পাননি। সর্বশেষ বৈষম্য হলোÑকর পরিদর্শক পদে পদোন্নতি দিতে আমির হোসেন আর হাবিব উল্লাহর পৃথক জ্যেষ্ঠতা তালিকা করা হয়েছে। সেই তালিকা বাস্তবায়িত হলে হাবিব উল্লাহ আমির হোসেনের চেয়ে আগে কর পরিদর্শক পদে পদোন্নতি পাবেন। আর হাবিব উল্লাহকে ‘স্যার’ বলতে হবে আমির হোসেনকে। জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের এ যেন এক মহাকাব্য। মূলত আয়কর বিধিমালা সংশোধন না করায় দীর্ঘদিন ধরে আমির হোসেন আর হাবিব উল্লাহদের বৈষম্য চলে আসছে। আমির হোসেন আর হাবিব উল্লাহÑকেউই এই বৈষম্য চান না। তবে আয়কর বিভাগের কারণে বৈষম্য দিন দিন প্রকট হচ্ছে।
এনবিআর সূত্রমতে, আয়কর বিভাগে ‘সাঁটলিপিকার-কাম-কম্পিউটার অপারেটর’ ও ‘ব্যক্তিগত সহকারী’ ১৩তম গ্রেড। আর ‘উচ্চমান সহকারী’ ১৪তম গ্রেড। নিয়ম অনুযায়ী, গ্রেড-১৩-এ নিয়োগপ্রাপ্তরা গ্রেড-১৪-এ নিয়োগপ্রাপ্তদের চেয়ে জ্যেষ্ঠ। পদোন্নতির ক্ষেত্রে ১৩তম গ্রেড ১৪তম গ্রেডের আগে পদোন্নতি পাওয়ার কথা। কিন্তু ১৩-গ্রেডকে সুপারসিড করে ১৪-গ্রেডের কর্মচারীদের কর পরিদর্শক পদে পদোন্নতি দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। একই সঙ্গে কর অঞ্চলে পদায়নের ক্ষেত্রেও ১৩-গ্রেডকে ‘সুপারসিড’ করে জ্যেষ্ঠদের জায়গায় কনিষ্ঠদের র্দীঘদিন ধরে বসানো হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আবার আয়কর বিভাগের সম্প্রসারণে একটি শর্ত ছিল, বৈষম্য নিরসনে আয়কর বিধিমালা সংশোধন করা। কিন্তু সংশোধন ছাড়াই পদায়ন ও নিয়োগ দেয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। পদোন্নতিতে জ্যেষ্ঠতা ঠিক করা, সুপারসিড বাতিল, বিধিমালা দ্রুত সংশোধন করাসহ বৈষম্য নিরসনের দাবি জানিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চেয়ারম্যানকে চিঠি দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ স্টেনোগ্রাফার ওয়েলফেয়ার সোসাইটি (বিএসডব্লিউএস) থেকে এই চিঠি দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে এই সংগঠনের সব দাবির সঙ্গে স্টেনোটাইপিস্ট অ্যাসোসিয়েশনও ঐকমত্য পোষণ করেছে। দাবি আদায়ে দুটি সংগঠন ঐক্য পরিষদ গঠন করেছে।
বিএসডব্লিউএসের চিঠিতে বলা হয়েছে, ২০১১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ‘সাঁটলিপিকার-কাম-কম্পিউটার অপারেটর ও ব্যক্তিগত সহকারী’ পদে বিপুল পরিমাণ কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ১৯৯৫ সালের নিয়োগ বিধি অনুযায়ী ১৩-গ্রেডে এসব কর্মচারী নিয়োগ পেয়েছেন। কর বিভাগ (১০ম গ্রেড থেকে ২০তম গ্রেড কর্মচারী) নিয়োগ বিধিমালা, ২০১৬ হওয়ার পর ‘কর পরিদর্শক’ পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে এই দুই পদে নিয়োগপ্রাপ্তরা কিছু বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। ‘নিয়োগ বিধি, ২০১৬’-এর বিভিন্ন ফিডার পদের যোগ্যতার ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও পদগুলোর পৃথক পৃথক জ্যেষ্ঠতা প্রণয়নপূর্বক পদোন্নতির ক্ষেত্রে বৈষম্য আনুপাতিক হার নির্ধারণ করায় উচ্চমান সহকারীরা সাঁটলিপিকার-কাম-কম্পিউটার অপারেটর ও ব্যক্তিগত সহকারীদের কনিষ্ঠ হয়েও জ্যেষ্ঠতার সাধারণ নীতিমালা লঙ্ঘন করছেন। সাঁটলিপিকার-কাম-কম্পিউটার অপারেটর ও ব্যক্তিগত সহকারীকে উচ্চমান সহকারীরা অতিক্রম করে পূর্বে ‘কর পরিদর্শক’ পদে পদোন্নতি পেতে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
অভিযোগ করা হয়, সাঁটলিপিকার-কাম-কম্পিউটার অপারেটর ও ব্যক্তিগত সহকারীদের অনেকেই ২০০৯, ২০১০, ২০১১, ২০১২, ২০১৩, ২০১৪ সালে ১৩-বেতন গ্রেডে নিয়োগ পেয়েছেন। কিন্তু কিছু উচ্চমান সহকারী ২০১২ ও ২০১৪ সালে ১৪-বেতন গ্রেডে নিয়োগ পেয়েছেন। তারা ২০১৮ সালে পদোন্নতি পেয়ে ১৩-বেতন গ্রেডে প্রধান সহকারী হয়েছেন। তাদের মধ্যে অনেকে ২০২৩ সালে ১০ম গ্রেডে ‘কর পরিদর্শক’ পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। অথচ তাদের আগে ২০০৯, ২০১০, ২০১১, ২০১২ সালে সাঁটলিপিকার-কাম-কম্পিউটার অপারেটর ও ব্যক্তিগত সহকারী পদে নিয়োগ ও বেতন গ্রেড জ্যেষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও তারা এখনও পদোন্নতি পায়নি। জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে ২০২৩ সালের ৯ আগস্ট ৭৭ জনকে কর পরিদর্শক হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে।
চিঠিতে আরও বলা হয়, পদোন্নতির ক্ষেত্রে এই বৈষম্য দূরীকরণে পদোন্নতি বঞ্চিতরা ব্যক্তিগতভাবে ও বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে এনবিআরকে একাধিকবার চিঠি দিয়েছেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২ সালের ২০ জুলাই প্রথম সচিব (কর প্রশাসন) মো. শাহিদুজ্জামানকে সভাপতি করে নিয়োগ বিধিমালা সংশোধনের জন্য সাত সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিন্তু এক বছর ১০ মাস অতিবাহিত হলেও বিধিমালা সংশোধন করা হয়নি। বিধিমালা সংশোধন নিয়ে গড়িমসি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন পদোন্নতিবঞ্চিতরা।
অন্যদিকে আয়কর বিভাগের সম্প্রসারণ হচ্ছে। নতুন কর অঞ্চলের অধিক্ষেত্র ঘোষণা ও জনবল পদায়ন করা হয়েছে। নতুন জনবল নিয়োগ প্রক্রিয়া চলমান। আগামী ১ জুলাই থেকে কর অঞ্চলের প্রথম পর্যায়ের কার্যক্রম শুরু হবে বলে এনবিআর এরই মধ্যে আদেশ জারি করেছে। আয়কর অনুবিভাগের সংস্কার, পুনর্গঠন, সম্প্রসারণ ২০২৩ সালের ৯ এপ্রিল গেজেট আকারে জারি করা হয়। তবে সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে চলমান নিয়োগ বিধি সংশোধনের শর্তারোপ করা হয়েছে। কিন্তু কর বিভাগ নিয়োগ বিধি সংশোধন ছাড়াই কার্যক্রম শুরু করছে বলে পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মচারীরা অভিযোগ করেছেন।
আয়কর বিভাগ সূত্রমতে, এনবিআর কর পরিদর্শক পদে পদোন্নতি দিতে তিনটি ক্যাটেগরিতে পৃথকভাবে মোট ৪৫৫ জনের জ্যেষ্ঠতার তালিকা তৈরি করেছে। এই জ্যেষ্ঠতা তালিকায় ‘কর পরিদর্শক’ পদে পদোন্নতির জন্য সাঁটলিপিকার-কাম-কম্পিউটার অপারেটর ও ব্যক্তিগত সহকারী ফিডার পদে ৪৮ জন, প্রধান সহকারী ও উচ্চমান সহকারী ফিডার পদে ২৪৫ জন ও সাঁট-মুদ্রাক্ষরিক-কাম-কম্পিউটার অপারেটর ফিডার পদে ১৬২ জনের নাম রাখা হয়েছে। তিনটি জ্যেষ্ঠতার তালিকা অনুযায়ী পদোন্নতি দেয়া হলে আবারও কনিষ্ঠরা পদোন্নতি পাবেন, এতে আরো বেশি বৈষম্য তৈরি হবে।
এ বিষয়ে এনবিআরের একজন কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, নিয়োগ বিধি সংশোধনে বোর্ড সভায় কিছু সংশোধনী দেয়া হয়েছে। এই সংশোধনী মতামতের জন্য ওয়েবসাইটে দেয়া হবে। পরে তা জনপ্রশাসনে পাঠানো হবে। পৃথক তালিকা হলেও যখন একত্র করা হবে, তখন অনেক পরিবর্তন হবে।