১৩ প্রতিষ্ঠানের কাছেই অগ্রণী ব্যাংকের ৪৬ শতাংশ ঋণ

রোহান রাজিব: দেশের ব্যাংকগুলো বরাবরই বড় গ্রুপকে ঋণ দিতে বেশি আগ্রহী থাকে। এজন্য চলে অসুস্থ প্রতিযোগিতাও। এসব প্রতিষ্ঠান বা গ্রুপের সক্ষমতা ও ঝুঁকি বিবেচনা না করেই নামমাত্র জামানতে বিপুল অঙ্কের ঋণ তুলে দেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের অগ্রণী ব্যাংক। এ ব্যাংকটির মোট ঋণের ৪৬ শতাংশই ১৩টি গ্রুপ বা কোম্পানির কাছে। অগ্রণী ব্যাংকের ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য উঠে এসেছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সাল শেষে ব্যাংকটির ঋণ স্থিতি ছিল ৭২ হাজার ৯৩৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে শীর্ষ ১৩ গ্রুপ/কোম্পানির কাছে ঋণের স্থিতি ছিল ৩৩ হাজার ৭৮৮ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৪৬ দশমিক ৩২ শতাংশ। আর গত ডিসেম্বর শেষে মাত্র ৪৪টি কোম্পানির কাছে অগ্রণী ব্যাংকের ঋণের পরিমাণ ছিল ৫৩ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৭২ দশমিক ২৬ শতাংশ।

শীর্ষ ১৩ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণ রয়েছে আরপিসিএল-নরিনকো ইন্টারন্যাশনাল পাওয়ার লিমিটেডের। প্রতিষ্ঠানটির অধীন পটুয়াখালী এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে প্রদত্ত ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকা। এছাড়া ইউনিক গ্রুপের কাছে তিন হাজার ৮৫২ কোটি, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনে (বিসিআইসি) তিন হাজার কোটি, বসুন্ধরা গ্রুপে (সায়েম সোবহান) দুই হাজার ৯৭৮ কোটি, বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পনিতে (পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র) দুই হাজার ৬৫৬ কোটি, ওরিয়ন গ্রুপের কাছে দুই হাজার ২৫৪ কোটি, বসুন্ধরা গ্রুপে (সাফওয়ান সোবহান) এক হাজার ৮২১ কোটি, বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভলপমেন্ট বোর্ডে (পিডিবি) এক হাজার ৩৩৪ কোটি, বিএসআরএম গ্রুপে এক হাজার ২০২ কোটি, জাকিয়া গ্রুপে এক হাজার ১৫৭ কোটি, থার্মেক্স গ্রুপের কাছে এক হাজার ১১০ কোটি, আবুল খায়ের গ্রুপে এক হাজার ৫০ কোটি এবং জজ ভূইয়া গ্রুপে এক হাজার এক কোটি টাকা ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে।

একটি ব্যাংক বিতরণকৃত মোট ঋণের কত শতাংশ অর্থ বড় গ্রাহকদের দিতে পারবে, তা ব্যাংক কোম্পানি আইন ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালাও রয়েছে। এক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে, অগ্রণী ব্যাংক সে নীতি মেনেও ঋণ দেয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ব্যাংকটি বড় গ্রাহকের ক্ষেত্রে মোট ঋণ পোর্টফোলিওর ৩০ শতাংশ পর্যন্ত দিতে পারবে। কিন্তু ব্যাংকটির বড় ঋণের হার ডিসেম্বর শেষে দাঁড়িয়েছে ৩৬ শতাংশ। এ ছাড়া ১৯ গ্রাহককে ব্যাংকটির মোট মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি ঋণ দিয়েছে, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মের লঙ্ঘন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ ড. জায়েদ বখত শেয়ার বিজকে বলেন, ‘একক গ্রাহকের ঋণসীমার নীতিমালা বাংলাদেশ ব্যাংক পরিবর্তন করেছে। আগে অথরাইজড ক্যাপিটেলে হিসাব করা হতো। এখন সেটা পেইড আপ ক্যাপিটাল করা হয়েছে। এর ফলে মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি ঋণ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এটা ঠিক হতে একটু সময় লাগবে। যারা একক গ্রাহকের ঋণসীমার বাইরে চলে গেছে, সেগুলো কমিয়ে আনার চেষ্টা করছি। এখন নতুন করে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করছি।’

শুধু বড় গ্রাহকদের কাছে ব্যাংকটির ঋণ কেন্দ্রীভূত নয়। পাঁচ শাখায় কেন্দ্রীভূত হচ্ছে সিংগভাগ ঋণ। প্রতিবেদন অনুযায়ী, অগ্রণী ব্যাংকের মোট ঋণের ৪১ শতাংশই পাঁচ শাখায় কেন্দ্রীভূত। ২০২২ সাল শেষে ব্যাংকটির ঋণ স্থিতি ছিল ৭২ হাজার ৯৩৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে পাঁচ শাখায় ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ২৯ হাজার ৯৮২ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৪১ দশমিক ১০ শতাংশ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণ গেছে ব্যাংকটির প্রধান কার্যলয়ের নিচে প্রিন্সিপাল শাখা থেকে। এর পরিমাণ ২০ হাজার ৬৪৭ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২৮ দশমিক ৩১ শতাংশ। এছাড়া ফরেন এক্সচেঞ্জ করপোরেশনের শাখা থেকে দুই হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ৩০ শতাংশ, বি-ওয়াপদা শাখা থেকে দুই হাজার ৪০৮ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ৩০ শতাংশ, আমিন কোর্ট করপোরেট শাখা থেকে দুই হাজার ১১২ কোটি টাকা বা দুই দশমিক ৯০ শতাংশ এবং ওয়াসা করপোরেট শাখা থেকে দুই হাজার ৪৯ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়।

আমানত কমলেও বেড়েছে ঋণ বিতরণ

২০২১ সাল শেষে অগ্রণী ব্যাংকের আমানত ছিল এক লাখ ৮৬৪ কোটি টাকা, ওই সময়ে ঋণ ছিল ৫৯ হাজার ৭৯০ কোটি ২৯ লাখ টাকা। ২০২২ সাল শেষে আমানত কমে হয় ৯৩ হাজার ৭৭ কোটি টাকা। আর ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ৭২ হাজার ৯৩৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে ব্যাংকটির আমানত কমেছে সাত হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা। আর এ সময়ে ঋণ বেড়েছে ১৩ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ আমানত কমলেও গত বছরে ব্যাংকটি একাধিক সিন্ডিকেট বা জোটভুক্ত ঋণে যুক্ত হয়, আবার বড় গ্রাহকদেরও নতুন করে ঋণ দেয়।

খেলাপি ঋণ বেড়েছে দেড়গুণ

২০২১ সাল শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ৯ হাজার ৯৮৭ কোটি টাকা, গত ২০২২ সাল শেষে যা বেড়ে হয়েছে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এক বছরে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ পাঁচ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা বেড়েছে। ফলে ব্যাংকটি বড় অঙ্কের মূলধন সংকটে পড়েছে। গত ২০২১ মূলধন ঘাটতি ছিল এক হাজার ৫৪৮ কোটি টাকা। ২০২২ সাল শেষে বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৭৩৩ কোটি টাকা।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ব্যাংকগুলোর সাধারণত বড় গ্রাহককে ঋণ দিতে বেশি আগ্রহ দেখায়। আর বড় গ্রাহকদের কাছে ঋণ কেন্দ্রীভূত হওয়ার ঘটনা পুরোনো, যার কারণে ব্যাংক খাত প্রভাশালী গ্রাহকদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ছে। এটা ব্যাংক খাতের জন্য ভালো লক্ষণ নয়। এতে একজন গ্রাহক দেউলিয়া হলে খেলাপি বেড়ে যায়, যা ব্যাংকের জন্য বাড়তি ঝুঁকি সৃষ্টি করে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০