১৪ বছরে সামিটের পকেটে ১২ হাজার কোটি টাকা!

ইসমাইল আলী: খুলনা পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (কেপিসিএল) মাধ্যমে ইউনাইটেড গ্রুপের সঙ্গে যৌথভাবে বিদ্যুৎ খাতে যাত্রা শুরু করে সামিট। পরবর্তীকালে এককভাবে বেশকিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তোলে গ্রুপটি। বর্তমানে বেসরকারি খাতে একক বৃহৎ বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী সামিট গ্রুপ।

সামিটের আটটি কেন্দ্রের বর্তমান বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা এক হাজার ৪৩৫ মেগাওয়াট, যা বেসরকারি খাতের প্রায় সাড়ে ১২ শতাংশ। যদিও নানা কারণে কেন্দ্রগুলো বছরের প্রায় অর্ধেক সময়ই বসে থাকে। তবে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য নিয়মিতই ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি)।

সংস্থাটির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ১৪ বছরে সামিট গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য পিডিবিকে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে প্রায় ১০ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা। এছাড়া কেপিসিএলের ৩৫ শতাংশ শেয়ার রয়েছে সামিট গ্রুপ ও এর বিভিন্ন পরিচালকের কাছে। এর মাধ্যমে আরও প্রায় এক হাজার ৪৮০ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ গেছে গ্রুপটির কাছে। সব মিলিয়ে ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে গেছে সামিট গ্রুপ।

পিডিবির তথ্যমতে, ২০০৯ সালের মাঝামাঝি সামিটের একক প্রথম বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদন শুরু করে। গ্যাসচালিত সামিট পূর্বাঞ্চল নামের এ কেন্দ্রটির উৎপাদন সক্ষমতা ছিল মাত্র ৩৩ মেগাওয়াট। অল্প কয়েক দিন চলায় ওই কেন্দ্রটির জন্য ২০০৮-০৯ অর্থবছর মাত্র ৯৩ লাখ টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করে পিডিবি। পরের (২০০৯-১০) অর্থবছর ওই কেন্দ্রটির জন্য ২৪ কোটি পাঁচ লাখ টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয়।

২০১০-১১ অর্থবছর আরও একটি কেন্দ্র চালু করে সামিট গ্রুপ। ফার্নেস অয়েলচালিত সামিট নারায়ণগঞ্জ নামক কেন্দ্রটির উৎপাদন সক্ষমতা ১০২ মেগাওয়াট। এতে দুই বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতা দাঁড়ায় ১৩৫ মেগাওয়াট। কেন্দ্র দুটির জন্য ওই অর্থবছরে পিডিবির ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয় মাত্র ৬৩ কোটি ৬১ লাখ টাকা। পরের দুই অর্থবছরও সামিটের দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রই উৎপাদনে ছিল। এতে ২০১১-১২ অর্থবছরে পিডিবিকে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয় ১৯৫ কোটি ৭৬ লাখ টাকা এবং ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১৯৩ কোটি ৮৭ লাখ টাকা।

যদিও ওই সময়ে আরও কয়েকটি কেন্দ্র নির্মাণাধীন ছিল সামিটের। এর মধ্যে ২০১৩-১৪ অর্থবছরের শেষ দিকে সামিট মেঘনাঘাট কেন্দ্রের (২০৩ মেগাওয়াট) সিম্পল সাইকেল উৎপাদন শুরু হয়। এতে ওই অর্থবছর সামিটের কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৩৩৮ মেগাওয়াট। আর সে বছর পিডিবিকে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয় ২০৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা। তবে মেঘনাঘাট কেন্দ্রটি পরের অর্থবছর কম্বাইন্ড সাইকেলে ও পূর্ণ ক্ষমতায় উৎপাদন শুরু করে।

২০১৪-১৫ অর্থবছর সামিট মেঘনাঘাট বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫৫ মেগাওয়াট। ডুয়েল ফুয়েল হলেও গ্যাসের সরবরাহ না থাকায় শুরুর কয়েক বছর এটি ডিজেলে চালানো হয়। এছাড়া ওই অর্থবছর শেষ দিকে উৎপাদনে আসে ৩৪১ মেগাওয়াটের বিবিয়ানা-২ কেন্দ্রটি। যদিও গ্যাসচালিত এ কেন্দ্রটি পূর্ণোদ্যমে উৎপাদন শুরু করে পরের অর্থবছর। তবে ২০১৪-১৫ অর্থবছর সামিটের সার্বিক উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়ায় ৮১১ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে পিডিবিকে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয় ৩৭১ কোটি ২৭ লাখ টাকা।

এর পরের (২০১৫-১৬) অর্থবছর সামিট মদনগঞ্জ ও সামিট বরিশাল নামে আরও দুটি কেন্দ্র উৎপাদনে আসে। এগুলোর সক্ষমতা ছিল যথাক্রমে ৫৫ ও ১০০ মেগাওয়াট। উভয় কেন্দ্রই ছিল ফার্নেস অয়েলচালিত। এতে ২০১৫-১৬ অর্থবছর সামিটের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়ায় ৯৮৬ মেগাওয়াট। আর ওই অর্থবছর পিডিবিকে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয় ৯১৫ কোটি ৩৭ লাখ টাকা।

২০১৬-১৭ অর্থবছরও কোম্পানিটির উৎপাদন সক্ষমতা একই ছিল। তবে ওই বছর সামিটের ক্যাপাসিটি চার্জ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় এক হাজার ১০২ কোটি ৯ লাখ টাকা। পরের অর্থবছর উৎপাদনে আসে সামিটের গাজীপুর-২ কেন্দ্রটি। ফার্নেস অয়েলচালিত এ কেন্দ্রটির উৎপাদন সক্ষমতা ৩০০ মেগাওয়াট। এতে ২০১৭-১৮ অর্থবছর সামিটের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় এক হাজার ২৮৬ মেগাওয়াট। ওই অর্থবছর ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয় এক হাজার ১০০ কোটি ২৩ লাখ টাকা।

এদিকে ২০১৮-১৯ অর্থবছর উৎপাদনে আসে সামিটের এসিই অ্যালায়েন্স কেন্দ্রটি। নারায়ণগঞ্জে অবস্থিত ফার্নেস অয়েলচালিত এ কেন্দ্রটির উৎপাদন সক্ষমতা ১৪৯ মেগাওয়াট। এছাড়া জাতীয় গ্রিডে এলএনজি যুক্ত হওয়ার পর মেঘনাঘাট কেন্দ্রটিতে গ্যাসে উৎপাদন শুরু করা হয়। সে অর্থবছর সামিটের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার ৪৩৫ মেগাওয়াট। আর এসব কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ পিডিবিকে পরিশোধ করতে হয় এক হাজার ৬৮৮ কোটি ৯৩ লাখ টাকা।

পরের তিন অর্থবছরও সামিটের কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা একই ছিল। এর মধ্যে ২০১৯-২০ অর্থবছর সামিটের কেন্দ্রগুলোর জন্য এক হাজার ৫৮০ কোটি ১৯ লাখ টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করে পিডিবিকে। আর ২০২০-২১ অর্থবছর এক হাজার ৫৮৯ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ও ২০২১-২২ অর্থবছর এক হাজার ৫৫১ কোটি ৮৩ লাখ টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয়। সব মিলিয়ে ১৪ বছরে সামিট ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ আয় করেছে ১০ হাজার ৫৮২ কোটি ৮৯ লাখ টাকা।

এসব কেন্দ্রের বাইরেও কেপিসিএলের ৩৫ শতাংশ শেয়ার রয়েছে সামিট গ্রুপের হাতে। ২০১০ সালে কেপিসিএল পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। ওই কোম্পানির অধীনে এক সময় তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র ছিল। এসব কেন্দ্রের জন্য ১৪ বছরে সামিট ক্যাপাসিটি চার্জ পায় প্রায় এক হাজার ৪৮০ কোটি টাকা। যদিও সব কেন্দ্রের মেয়াদ গত দুই বছরে শেষ হয়ে যায়। তবে পরে দুটি কেন্দ্রের চুক্তি দুই বছরের জন্য নবায়ন করে সরকার।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্যাপাসিটি চার্জ বিদ্যুৎ খাতের জন্য বোঝা হয়ে উঠেছে। নানা কারণে কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন বন্ধ থাকলেও এ অর্থ গুনতে হচ্ছে পিডিবিকে। এমনকি বর্তমানে চাহিদা না থাকায় বা জ্বালানি সংকটের কারণে বেশকিছু বেসরকারি কেন্দ্র বসে থাকছে। এরপরও ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়মিতই পরিশোধ করতে হচ্ছে। তাই এ ধরনের লাইসেন্স প্রদানের আগে সংশ্লিষ্ট সব বিষয় গুরুত্ব দেয়া উচিত।

এদিকে বেসরকারি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য ১৫-২২ বছরের চুক্তিতে ক্যাপাসিটি চার্জ অনেক বেশি ধরা হয়েছে বলে মনে করেন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম। তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে সরকার দায়মুক্তি বিধান দিয়ে রেখেছে। ফলে এ খাতে কোনো প্রতিযোগিতা নেই, জবাবদিহিও নেই। আর এ সুযোগে বেসরকারি খাত বাড়তি সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। আইনটির প্রয়োগ বন্ধ না হলে এ খাতে সুশাসনও ফিরবে না।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০