১৫ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা

বিশেষ প্রতিনিধি: আওয়ামী লীগের তিন মেয়াদে দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ সরকারের ব্যয় হয়েছে প্রায় এক লাখ পাঁচ হাজার কোটি টাকা। গতকাল জাতীয় সংসদে এ তথ্য জানান বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে জাতীয় সংসদের অধিবেশনে টেবিলে উত্থাপিত প্রশ্নের জবাবে নসরুল হামিদ এ তথ্য দেন। সিলেট-২ আসনের সংসদ সদস্য মোকাব্বির খান প্রশ্নটি উত্থাপন করেন।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জানান, ৮২টি ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার বা আইপিপির মধ্যে ৭০টিকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে। এ বাবদ ব্যয় হয়েছে ৭৬ হাজার ২৪২ কোটি আট লাখ টাকা। আর ৩২টি রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিপরীতে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয়েছে ২৮ হাজার ৬৮৪ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। অর্থাৎ ১৫ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয়েছে এক লাখ চার হাজার ৯২৬ কোটি ৮১ লাখ টাকা। ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত এ ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয়েছে।

আইপিপিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ পেয়েছে বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার এ কেন্দ্রকে সাত হাজার ৪৫৫ কোটি ৩১ লাখ টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয়েছে। মাত্র তিন বছরে এ ক্যাপাসিটি চার্জ পেয়েছে কেন্দ্রটি। এর পরের অবস্থানে রয়েছে মেঘনাঘাট পাওয়ার। ৪৫০ মেগাওয়াট সক্ষমতার এ কেন্দ্রকে দেয়া হয়েছে পাঁচ হাজার ৪৭৫ কোটি ১২ লাখ টাকা।

ক্যাপাসিটি চার্জ পাওয়ায় তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে রুরাল পাওয়ার ২১০ মেগাওয়াট কেন্দ্রটি। এ কেন্দ্রকে দেয়া হয়েছে চার হাজার চার কোটি আট লাখ টাকা। চতুর্থ স্থানে থাকা ৩৩৫ মেগাওয়াটের সামিট মেঘনাঘাট পাওয়ার কেন্দ্রটি পেয়েছে তিন হাজার ৬৪৪ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। আর পঞ্চম স্থানে থাকা ৪১৪ মেগাওয়াটের সেম্বকর্প এনডব্লিউপিসি কেন্দ্রটি পেয়েছে দুই হাজার ৮২৩ কোটি ৬৬ লাখ টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ।

সর্বোচ্চ ক্যাপাসিটি চার্জ পাওয়ার তালিকায় ষষ্ঠ থেকে নবম স্থানেও রয়েছে আইপিপি। এর মধ্যে ৩০০ মেগাওয়াটের এপিআর এনার্জি ক্যাপাসিটি চার্জ পেয়েছে দুই হাজার ৭৮৮ কোটি চার লাখ টাকা, ৩৪১ মেগাওয়াটের সামিট বিবিয়ানা পাওয়ার-২ পেয়েছে দুই হাজার ৬৮৩ কোটি তিন লাখ টাকা, ৩৬০ মেগাওয়াটের হরিপুর পাওয়ার পেয়েছে দুই হাজার ৫৫৭ কোটি ৬৩ লাখ টাকা এবং ১৯৫ মেগাওয়াটের ইউনাইটেড আশুগঞ্জ এনার্জি পেয়েছে দুই হাজার ৩৭৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। আর দশম স্থানে রয়েছে এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনালের রেন্টাল কেন্দ্রটি। ১৪৫ মেগাওয়াটের এ কেন্দ্রটি ক্যাপাসিটি চার্জ পেয়েছে দুই হাজার ৩৪১ কোটি ২৮ লাখ টাকা।

অন্যান্য কেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ দুই হাজার কোটি টাকার কম। এর মধ্যে ১১৫ মেগাওয়াটের কেপিসিএল-২ ক্যাপাসিটি চার্জ পেয়েছে এক হাজার ৯২৮ কোটি ৫৪ লাখ টাকা, ২০০ মেগাওয়াট বাংলা ট্রাক-২ কেন্দ্রটি পেয়েছে এক হাজার ৮৫৩ কোটি ২২ লাখ টাকা, ১৪৯ মেগাওয়াট বিআর পাওয়ার জেন কেন্দ্রটি পেয়েছে এক হাজার ৮৩৭ কোটি ২৭ লাখ টাকা, ৩০০ মেগাওয়াট ইউনাইটেড আনোয়ার কেন্দ্র পেয়েছে এক হাজার ৮১৯ কোটি ৬৯ লাখ টাকা, ৩০০ মেগাওয়াটের সামিট গাজীপুর-২ কেন্দ্রটি পেয়েছে এক হাজার ৮১০ কোটি ৯৭ লাখ টাকা এবং প্যারামাউন্ট বিট্রাক কেন্দ্রটি এক হাজার ৬৩০ কোটি ৭৬ লাখ টাকা।

এর বাইরে ১০২ মেগাওয়াট সামিট নারায়ণগঞ্জ পাওয়ার এক হাজার ৫৬৮ কোটি ৬১ লাখ টাকা, ৮৫ মেগাওয়াট এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল এক হাজার ৫৫৮ কোটি ২৩ লাখ টাকা, ১০০ মেগাওয়াট ডাচ্-বাংলা পাওয়ার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস এক হাজার ৫৩০ কোটি ৯ লাখ টাকা, ১০০ মেগাওয়াট অ্যাক্রন ইনফ্রাস্ট্রাকচার সার্ভিসেস এক হাজার ৪৮৪ কোটি ৩০ লাখ, ৯৫ মেগাওয়াট এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল এক হাজার ৪৩৯ কোটি ১৯ লাখ টাকা, ১০০ মেগাওয়াট দেশ এনার্জি সিদ্ধিরগঞ্জ এক হাজার ৩৯১ কোটি ২১ লাখ, ২০০ মেগাওয়াট দেশ এনার্জি (চাঁদপুর) পেয়েছে এক হাজার ৩১২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা এবং ৭৯ মেগাওয়াট ম্যাক্স পাওয়ার এক হাজার ৩০৬ কোটি ৩৪ লাখ টাকা পেয়েছে।

এ ছাড়া ১০০ মেগাওয়াট পাওয়ার প্যাক মুতিয়ারা কেরানীগঞ্জ ১ হাজার ২৯১ কোটি ৬১ লাখ টাকা, ১১০ মেগাওয়াট কেপিসিএল-১ এক হাজার ১৫২ কোটি দুই লাখ টাকা, ১১০ মেগাওয়াট এনইপিসি হরিপুর এক হাজার ১২০ কোটি ৪৫ লাখ টাকা, ৫৫ মেগাওয়াট প্রিসিশন এনার্জি এক হাজার ৮৮ কোটি সাত লাখ টাকা, ১৬৩ মেগাওয়াট কুশিয়ারা পাওয়ার এক হাজার ৪৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা এবং ১৫০ মেগাওয়াট মিডল্যান্ড পাওয়ার এক হাজার ৪২ কোটি ৭৩ লাখ টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ পেয়েছে। তালিকায় থাকা অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ এক হাজার কোটি টাকার নিচে।

এদিকে একই প্রশ্নের জবাবে যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিপরীতে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয়েছে, সেসব কেন্দ্রের সঙ্গে চুক্তির কিছু শর্তের কথা তুলে ধরেন প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। শর্তের মধ্যে রয়েছেÑ কেন্দ্রগুলোর বার্ষিক প্রাপ্যতা ৯০ শতাংশ থাকতে হবে। এর কম হলে ক্যাপাসিটি

চার্জ কাটা হয়। বার্ষিক ‘ডিপেন্ডেবল ক্যাপাসিটি টেস্ট’ (নির্ভরযোগ্যতার সক্ষমতা পরীক্ষা) সম্পাদন করতে হবে। বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনার সময় ঝুঁকির নিরাপত্তায় বিমা করতে হবে। প্রতি বছর বিইআরসির মাধ্যমে লাইসেন্স নিতে হবে, পরিবেশগত ছাড়পত্র নিতে হবে। এ ছাড়া চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হবে এবং যথাসময়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে।

অন্যদিকে চট্টগ্রাম-১১ আসনের সংসদ সদস্য এম আবদুল লতিফের প্রশ্নের জবাবে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেন, বর্তমানে দেশে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৮ হাজার ১৩৪ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ১ হাজার ১৯৫ মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য উৎপাদিত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী, ২০৪১ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য জ্বালানি হতে উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বিদ্যুৎ বিভাগ বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করেছে।

এম আবদুল লতিফের আরেক প্রশ্নের জবাবে খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, দেশের ক্রমবর্ধমান গ্যাসের চাহিদা পূরণে ২০২৫ সালের মধ্যে ৪৬টি (অনুসন্ধান, উন্নয়ন ও ওয়ার্কওভার) কূপ খননের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। নসরুল হামিদ বলেন, গ্যাসের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতকল্পে আবাসিক শ্রেণির গ্রাহক পর্যায়ে ৪ লাখ ৩৪ হাজার গ্যাস প্রি-পেইড মিটার এবং শিল্প ও সিএনজি শ্রেণির গ্রাহক পর্যায়ে ৩ হাজার ২৩৯টি ইভিসি মিটার স্থাপন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সব আবাসিক গ্রাহককে প্রি-পেইড মিটারের আওতায় আনার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।

ঢাকা-৪ আসনের সংসদ সদস্য সৈয়দ আবু হোসেনের প্রশ্নের জবাবে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জানান, ২০০৯ সাল থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ২১টি অনুসন্ধান কূপ খননের মাধ্যমে ৬টি গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। এতে দৈনিক ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। ৬টি গ্যাস ক্ষেত্র হচ্ছেÑসুন্দলপুর, শ্রীকাইল, রূপগঞ্জ, ভোলা নর্থ, জকিগঞ্জ ও ইলিশা।

বগুড়া-৫ আসনের সংসদ সদস্য হাবিবর রহমানের প্রশ্নের জবাবে নসরুল হামিদ জানান, ২০২২-২৩ অর্থবছরে পল্লী বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের নিট লোকসান দুই হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা। এ সময়ে ডেকসোর নিট লোকসান ২২৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা, একই অর্থবছরের ৯ মাসে ডিপিডিসির কর পরবর্তী লোকসান ৪৬ কোটি ৫৪ লাখ টাকা।  কাজিম উদ্দিন আহম্মেদের প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী জানান, প্রতিবেশী ভারত থেকে ছয়টি চুক্তির মাধ্যমে দুই হাজার ৬৫৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০