১৫ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ শোধ ১ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাক

বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা প্রতি বছর বাড়লেও বড় অংশই বসে থাকছে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেই শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ থেকে প্রচুর আয় করেছে বিনিয়োগকারী কোম্পানিগুলো। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন করে আলোচনায় আসে ক্যাপাসিটি চার্জ। তাই ১৫ বছরে এ খাতে সরকারের ব্যয় ও কোম্পানিগুলোর আয় তুলে ধরেছে শেয়ার বিজ। এ নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজনের আজ ছাপা হচ্ছে প্রথম পর্ব

ইসমাইল আলী ঃ আওয়ামী লীগের শাসনামলে গত দেড় দশকে বেসরকারি খাতে প্রায় ১০০টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র দরপত্রের মাধ্যমে নির্মাণের অনুমোদন দেয়া হয়। যদিও একটিমাত্র কোম্পানি অংশ নেয়ায় তাতেও কোনো প্রতিযোগিতা ছিল না। বাকি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল আনসলিসিটেড তথা অযাচিত প্রস্তাবের মাধ্যমে। ফলে এগুলোর নির্মাণব্যয় ও ক্যাপাসিটি চার্জ অনেক বেশি ধরা হয়।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্যমতে, ২০০৯-১০ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত ১৫ বছরে বেসরকারি রেন্টাল, কুইক রেন্টাল ও আইপিপিগুলোর (্ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে এক লাখ ৩৩ হাজার ৩৭৭ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। যদিও এ সময় বেশিরভাগ বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতার অর্ধেকও ব্যবহার হয়নি। শুরুর এক দশক (২০০৯-১০ থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছর) গড়ে বেসরকারি কেন্দ্রগুলো ৫০ শতাংশ বা তার কিছুটা বেশি চললেও শেষ পাঁচ অর্থবছর ৫০ শতাংশের নিচেই ছিল এসব কেন্দ্রের প্লান্ট ফ্যাক্টর বা বিদ্যুৎ উৎপাদনের হার।

বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০০৯-১০ অর্থবছর বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল এক হাজার ৮৭৮ মেগাওয়াট। ওই অর্থবছর কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতার ৬৯ শতাংশ ব্যবহার করা হয়। গত দেড় দশকে এটি ছিল সর্বোচ্চ ব্যবহারের হার। ওই অর্থবছর বেসরকারি খাতের কেন্দ্রগুলোকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছিল এক হাজার ৭৯০ কোটি ২০ লাখ টাকা। পরের অর্থবছর বেসরকারি খাতে স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়ায় তিন হাজার ১৬২ মেগাওয়াট। তবে সক্ষমতার ব্যবহার কমে দাঁড়ায় ৫৪ শতাংশ। সে বছর ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছিল দুই হাজার ৭৮৩ কোটি ৫৬ লাখ টাকা।

যদিও পরের অর্থবছরই ক্যাপাসিটি চার্জ এক লাফে পাঁচ হাজার কোটি টাকা ছাড়ায়। ২০১১-১২ অর্থবছর বেসরকারি খাতে স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা আরও বেড়ে দাঁড়ায় তিন হাজার ৫৮৩ মেগাওয়াট। এর ব্যবহার হয় ৫৮ শতাংশ। সে অর্থবছর ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছিল পাঁচ হাজার এক কোটি ২৩ লাখ টাকা। ২০১২-১৩ অর্থবছরে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা সামান্য বেড়ে দাঁড়ায় তিন হাজার ৬৮৫ মেগাওয়াট। সে অর্থবছর সক্ষমতার ব্যবহার হয় ৫৮ শতাংশ। ওই বছর ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছিল পাঁচ হাজার ৪৯০ কোটি ৪৫ লাখ টাকা।

পরের দুই বছর এ খাতে ব্যয় আবার পাঁচ হাজার কোটি টাকার নিচে নামে। এর মধ্যে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা চার হাজার মেগাওয়াট ছাড়ায়। সে সময় এ সক্ষমতার ব্যবহার হয় ৫২ শতাংশ। সে অর্থবছর বেসরকারি খাতের কেন্দ্রগুলোর জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছিল চার হাজার ৭১৪ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা আরও কিছুটা বেড়ে দাঁড়ায় চার হাজার ৪৪৮ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ব্যবহার হয় ৫০ শতাংশ। সে অর্থবছর ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয়েছিল চার হাজার ৬৬৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা।
পরের অর্থবছর এ খাতের ব্যয় আবারও পাঁচ হাজার কোটি টাকা ছাড়ায়। পিডিবির তথ্যমতে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা পাঁচ হাজার মেগাওয়াট ছাড়ায়। এর মধ্যে ব্যবহার হয় ৫৩ শতাংশ। সে অর্থবছর এ খাতে ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয়েছিল পাঁচ হাজার ৩৭৬ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বেসরকারি কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা দাঁড়ায় পাঁচ হাজার ৪৫৯ মেগাওয়াট, যার মধ্যে ব্যবহার হয় ৫১ শতাংশ। এ খাতে সে সময় ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ পরিশোধ করা হয় পাঁচ হাজার ৭৬৪ কোটি ৯৭ লাখ টাকা।

রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কয়েকটি কেন্দ্র অবসরে যাওয়ায় ২০১৭-১৮ অর্থবছর বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা কিছুটা কমে দাঁড়ায় পাঁচ হাজার ২১৩ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ৫৫ শতাংশ ব্যবহার হয়। বেসরকারি এসব কেন্দ্রের জন্য ওই অর্থবছর ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয়েছিল ছয় হাজার ২৪১ কোটি ২৫ লাখ টাকা। পরের (২০১৮-১৯) অর্থবছর বেসরকারি খাতের উৎপাদন সক্ষমতা আবারও বেড়ে দাঁড়ায় পাঁচ হাজার ৭৪১ মেগাওয়াট। বেসরকারি এসব কেন্দ্রের সক্ষমতা ব্যবহার হয় ৫৪ শতাংশ। এতে ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয় আট হাজার ৭২২ কোটি ২৭ লাখ টাকা।

পরের অর্থবছর ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়ায়। ওই অর্থবছর বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়ায় আট হাজার ৪১১ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ৩৯ শতাংশ ব্যবহার হয়। মূলত করোনাকালে চাহিদা হ্রাস পাওয়ায় ২০১৯-২০ অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদন অনেকটা কমে যায়। সে অর্থবছর বেসরকারি খাতে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয় ১০ হাজার ৮৫২ কোটি ৭৮ লাখ টাকা।
২০২০-২১ অর্থবছর বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৯ হাজার ৭৩৪ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ৪৬ শতাংশ ব্যবহার হয়। সে অর্থবছর বেসরকারি খাতের এসব কেন্দ্রের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয় ১৩ হাজার ২১ কোটি তিন লাখ টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছর বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ১১ হাজার ৫৩৪ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ ব্যবহার হয়েছে। ওই অর্থবছর বেসরকারি খাতে ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয় ১৩ হাজার ৭০০ কোটি ৭৪ লাখ টাকা।

এদিকে ২০২২-২৩ অর্থবছর বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ১২ হাজার ৪১৫ মেগাওয়াট। ওই অর্থবছর উৎপাদন সক্ষমতার ৪২ শতাংশ ব্যবহার হয়। তবে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছিল ১৭ হাজার ৭৮৮ কোটি ৪২ লাখ টাকা। আর ২০২৩-২৪ অর্থবছর বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৩৬৯ মেগাওয়াট। আদানি, এসএস পাওয়ারসহ বড় বিভিন্ন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদন শুরু করায় সক্ষমতা বেড়ে গেছে। এছাড়া সামিট, ইউনিকসহ বেশকিছু তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস তথা এলএনজিচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র অর্থবছরের শেষ দিকে উৎপাদন শুরু করে।
এসব কেন্দ্রের কারণে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়। যদিও সব মিলিয়ে গত অর্থবছর উৎপাদন সক্ষমতার মাত্র ৩৬ শতাংশ চলেছে। জ্বালানি সংকটে চাহিদা থাকার পরও উৎপাদন বাড়ানো যায়নি। এতে বছরব্যাপী চলে লোডশেডিং। তবে কেন্দ্রগুলোর পুরো সক্ষমতার জন্যই ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে। এতে ২০২৩-২৪ অর্থবছর খাতটিতে ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৭ হাজার ৪৬৫ কোটি ১৪ লাখ টাকা।

পিডিবির কর্মকর্তারা এ প্রসঙ্গে বলেন, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতার ৮০ শতাংশ ব্যবহার হবে, এমন শতেই ক্যাপাসিটি চার্জ নির্ধারণ করা হয়। যদিও প্রকৃতপক্ষে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে সক্ষমতার অর্ধেকেরও কম। তারপরও পুরো সক্ষমতার জন্যই ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে। এতে দুই ধরনের ক্ষতি হচ্ছে। একদিকে বেসরকারি কেন্দ্রগুলো বসে থাকছে। অপরদিকে সরকারের ব্যয়ের বোঝা বাড়ছে। তাই জ্বালানি সংকটের এ সময়ে এসব চুক্তি সংশোধন করে সরকারের ব্যয় সাশ্রয়ের উদ্যোগ নেয়া উচিত।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০