ইসমাইল আলী: ডলার সংকট ক্রমেই বাড়ছে। এতে বিভিন্ন খাতের মতো বিদ্যুৎ উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে। কারণ ডলার সংকটে জ্বালানি তেল ও কয়লা আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। আবার বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারছে না বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতেও জটিলতা তৈরি করছে ডলার সংকট। সব মিলিয়ে ডলার সংকট নিয়ে উদ্বিগ্ন পিডিবি।
এর পরিপ্রেক্ষিতে চলতি অর্থবছরের অবশিষ্ট সময় ও আগামী অর্থবছরের ডলারের সম্ভাব্য চাহিদা প্রাক্কলন করেছে পিডিবি। এতে দেখা যায়, ১৫ মাসেই বিদ্যুৎ খাতে লাগবে প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার। এ সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরে শিগগিরই অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হবে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বৈঠকে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
বৈঠকে জানানো হয়, ডলার সংকটে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির বিল দেয়া যাচ্ছে না। নিয়মিত পরিশোধ করা যাচ্ছে না বিদেশি ঋণের কিস্তি। এছাড়া ফার্নেস অয়েল ও কয়লা আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। এরই মধ্যে কয়েক মাসের বিল বকেয়া পড়েছে। ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিলও পরিশোধ করা যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছর ২১৮ কোটি ৭৬ লাখ ডলার দরকার। আর আগামী অর্থবছর দরকার হবে ৩৭৩ কোটি ৩৫ লাখ ডলার। সব মিলিয়ে ১৫ মাসে লাগবে ৫৯২ কোটি ১১ লাখ (প্রায় ৫.৯২ বিলিয়ন) ডলার বা ৬৪ হাজার কোটি টাকা, যা ২টি পদ্মা সেতুর নির্মাণব্যয়ের চেয়েও বেশি।
সূত্রমতে, ভারতের ছয়টি কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনে বাংলাদেশ। এজন্য মাসে আমদানির বিল দিতে হয় ১০ কোটি ২৬ লাখ ডলার। এর মধ্যে চারটি কেন্দ্রের বিদ্যুৎ আমদানির বিল জানুয়ারি থেকে বকেয়া। আর দুটি কেন্দ্রের বিল গত নভেম্বর থেকে বকেয়া রয়েছে। এছাড়া চলতি মাসে শুরু হয়েছে আদানির বিদ্যুৎ আমদানি। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছর ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির বিল দিতে হবে ৪৭ কোটি ৫০ লাখ ডলার। আর আগামী অর্থবছর দিতে হবে ১৭৫ কোটি ৫২ লাখ ডলার।
চলতি অর্থবছর শুরু থেকে ডলার সংকটে ফার্নেস অয়েল আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। এরই মধ্যে ৫৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার তেল আমদানির বিল বকেয়া পড়েছে। এছাড়া বাকি সময়ের জন্য আরও লাগবে ৩৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার। অর্থাৎ আইপিপি (ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) ও রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ফার্নেস অয়েল আমদানিতে চলতি অর্থবছর লাগবে ৮৯ কোটি ডলার। তবে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালুর পর তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলোয় উৎপাদন কমিয়ে দেয়া হবে। এতে আগামী অর্থবছর ফার্নেস অয়েলের চাহিদা কমে যাবে। ফলে আগামী অর্থবছর তেল আমদানি করতে হবে অনেক কম। ডলারও ব্যয় হবে অনেক কম। আগামী অর্থবছর এ খাতে লাগবে ২৫ কোটি ৩০ লাখ ডলার।
বৈঠকে জানানো হয়, আগামী অর্থবছর কয়লার চাহিদা অনেক বাড়বে। কারণ সরকারি ও বিদেশি যৌথ উদ্যোগে কয়লাভিত্তিক বড় কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হয়েছে বা হতে যাচ্ছে। এছাড়া বেসরকারি উদ্যোগেও কয়লাভিত্তিক একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদন শুরু করেছে। এতে চলতি অর্থবছর কয়লা আমদানিতে ব্যয় হবে ৫৭ কোটি ৩৫ লাখ ডলার। যদিও দুই কেন্দ্রের (পায়রা ও রামপাল) কয়লা আমদানির বিল বাবদ ২২ কোটি ডলার বকেয়া পড়েছে। আর আগামী অর্থবছর কয়লা আমদানিতে ব্যয় হবে ১৫১ কোটি ৩১ লাখ ডলার।
বর্তমানে বেসরকারি খাতে ছয়টি ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। এগুলো ক্যাপাসিটি চার্জ ডলারে পরিশোধ করতে হবে। এজন্য চলতি অর্থবছর ব্যয় হবে ১৬ কোটি ১৮ লাখ ডলার। তবে চারটি কেন্দ্রের চুক্তির মেয়াদ আগামী জুনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। অপর দুটি কেন্দ্রের চুক্তি শেষ হবে আগামী অর্থবছর। এর মধ্যে একটি আগস্ট ও অপরটির চুক্তি ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে শেষ হবে। এতে ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যয় অনেক কমে যাবে। আগামী অর্থবছর লাগবে মাত্র তিন কোটি ৭৭ লাখ ডলার।
এদিকে বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে পিডিবি দুই ধরনের ঋণ নিয়ে থাকে। এর মধ্যে এক্সপোর্ট ক্রেডিট ফ্যাসিলিটির আওতায় নেয়া হয় ইসিএ ঋণ। সাধারণত বহুজাতিক ব্যাংকগুলো কঠিন শর্তে এ ঋণ দিয়ে থাকে। এছাড়া বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার সহজ শর্তের দীর্ঘমেয়াদি ঋণও রয়েছে পিডিবির। এর মধ্যে চলতি অর্থবছর ছয় মাসে ইসিএ ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে সাত কোটি ৩২ লাখ ডলার এবং আগামী অর্থবছর পরিশোধ করতে হবে ১৪ কোটি ৬৪ লাখ ডলার। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদি ঋণের কিস্তি বাবদ চলতি অর্থবছর দরকার হবে এক কোটি ৪১ লাখ ডলার। আর আগামী অর্থবছর গুনতে হবে দুই কোটি ৮১ লাখ ডলার।
জানতে চাইলে বৈঠকে উপস্থিত পিডিবির একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ডলার সংকটে জ্বালানি তেল ও গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করতে না পারায় গত জুলাই থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এতে ঘোষণা দিয়ে লোডশেডিং শুরু করা হয়। তবে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হওয়ায় এবং শীত এসে পড়ায় নভেম্বরের শেষ দিকে ঘাটতি কমে যায়। তবে ডলার সংকটে ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের বিল পরিশোধ ব্যাহত হচ্ছে।
তারা আরও জানান, কয়লা ও ফার্নেস অয়েল আমদানির বিল এরই মধ্যে বকেয়া পড়েছে ৭৭ কোটি ৫০ লাখ ডলার। তাই আগামী দিনগুলোতে ডলার সরবরাহ স্বাভাবিক করা না গেলে গ্রীষ্মে আবার সংকট বাড়বে। তাই বিদ্যুৎ খাতে ডলার সরবরাহ স্বাভাবিক করতে এরই মধ্যে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত সম্ভাব্য চাহিদা প্রাক্কলন করা হয়েছে। এবার প্রয়োজনীয় ডলার সরবরাহের ব্যবস্থা নিতে অর্থ মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে চিঠি দেয়া হবে।