চট্টগ্রাম মহানগর

১৬ লাখ মানসিক রোগীর চিকিৎসক ১০ জন!

প্রতিনিধি, চট্টগ্রাম:চট্টগ্রাম মহানগরীতে ৮০ লাখেরও অধিক মানুষের বসবাস। এখানে প্রায় ১৬ লাখ মানসিক রোগীর বিপরীতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছেন ১০ জন। মাত্র দুটি হাসপাতালে মানসিক রোগীর চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। এ অবস্থায় সংশ্লিষ্টদের দাবি, জনবহুল নগরী চট্টগ্রামে আলাদাভাবেই একটি মানসিক হাসপাতাল স্থাপন করা দরকার।

দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিভাগীয় শহর হিসেবে আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর মনস্তত্ত্ব নানাবিধ কারণে নেতিবাচক অবস্থানে আছে। এ নগরে সারা দেশের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের বহুমুখী সংস্কৃতি সমাবেশ ঘটেছে। ফলে আন্তঃসাংস্কৃতিক অনৈক্য প্রায়ই লক্ষ্য করা যায়। এটি মনোসামাজিক স্বাস্থ্য সংকট সৃষ্টির অন্যতম কারণ। অথচ এ নগরীতে নেই কোনো পূর্ণাঙ্গ মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র। শারীরিক স্বাস্থ্যসেবা পেলেও মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দানে তেমন কোনো পরিকল্পনা না থাকায় নগরবাসীর বিশাল অংশ মানসিক স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

জানা যায়, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল এবং চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে নিয়মিত মানসিক রোগের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। শুধু এ দুটি হাসপাতালেই মানসিক রোগ বিভাগ রয়েছে। এর চিকিৎসায় চট্টগ্রাম বিভাগের ১১ জেলার মানুষের একমাত্র ভরসা ২৩ বেডের চমেক হাসপাতালের মানসিক রোগ বিভাগ। যেখানে সরকার অনুমোদিত ২০টি ও তিনটি অতিরিক্ত বেড রাখা হয়েছে। রোগী বাড়লেও এখনও বাড়েনি হাসপাতালে বেডের সংখ্যা। অন্যদিকে, বিভাগ থাকলেও শুধু আউটডোরেই মানসিক রোগের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয় চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে। একজন রোগীর বিপরীতে ফি নেওয়া হয় সাড়ে ৩০০ টাকা। এ হাসপাতালে প্রতি মাসে গড়ে ২৮০-৩০০ মানসিক রোগী চিকিৎসাসেবা নেন। বিষণœতা বা সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তরাই বেশি আসেন এ হাসপাতালে।

অপরদিকে, মানসিক রোগের চিকিৎসায় চট্টগ্রামে মাত্র ১০ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সেবা দিয়ে থাকেন। তাদের মধ্যে চমেক হাসপাতালে রয়েছেন অধ্যাপক ডা. মহিউদ্দীন এ সিকদার, চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে ডা. মোহাম্মদ মোস্তফা ও ডা. মো. গিয়াস উদ্দিন সাগর, সিএসসিআরে অধ্যাপক সৈয়দ মাহফুজুল হক, শেভরনে অধ্যাপক এমএ মোত্তালিব, বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল হাসপাতালে সপ্তাহে একদিন বসেন ডা. শফিউল হাসান, মায়াবিনীতে ডা. সুরোজিৎ, এপিক হেলথ কেয়ারে ডা. পঞ্চানন, সপ্তাহে একদিন করে ঢাকা থেকে এসে চেম্বার করেন এপিক হেলথ কেয়ারে ডা. সালেহ এবং সেবা হসপিটালে অধ্যাপক ডা. শাহ আলম।

চট্টগ্রাম মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র সাইকিয়াট্রস্ট ডা. মোহাম্মদ মোস্তফা বলেন, ‘আন্তর্জাতিক স্বীকৃত গবেষণামতে চট্টগ্রাম মহানগরীতে প্রায় ১৬ লাখ মানুষ কোনো না কোনোভাবে মানসিক রোগে আক্রান্ত। এদের চিকিৎসায় মাত্র ১০ জন চিকিৎসক খুবই অপ্রতুল। এ জন্য অধিকসংখ্যক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরি করা দরকার। প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার জন্য প্রত্যেক এমবিবিএস ডাক্তারকে মানসিক রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসায় প্রশিক্ষণ দিতে হবে। শুধু ওষুধ দিয়ে মানসিক রোগের চিকিৎসা হয় না, বিভিন্ন রকম সাইকোথেরাপিরও প্রয়োজন হয়। আমাদের দেশে সাইকোথেরাপি দেওয়ার মতো জনবল খুবই কম।’

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের স্বাস্থ্য জরিপ ২০১৮-১৯-এর তথ্য অনুসারে, দেশে দুই কোটির বেশি মানুষ মানসিক রোগে আক্রান্ত। সমগ্র দেশে প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর শতকরা ১৬ দশমিক এক ভাগ যে কোনো ধরনের মানসিক রোগে আক্রান্ত।

চট্টগ্রামে মানসিক রোগের চিকিৎসায় হাসপাতাল ও ডাক্তার সংকট সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন শেখ ফজলে রাব্বি শেয়ার বিজকে বলেন, ‘বর্তমান যুগে অর্থনৈতিক বা সামাজিক নিরাপত্তার অভাব এবং খুব তাড়াতাড়ি সাফল্য লাভের আকাক্সক্ষাসহ নানা মানসিক দোটানায় মানসিক সমস্যা তৈরি হয়। এক্ষেত্রে চমেক হাসপাতাল এবং মা ও শিশু হাসপাতাল ছাড়া আর কোথাও চিকিৎসাসেবা নেই। বর্তমানে সরকার বিভিন্ন উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে চিকিৎসকদের মানসিক রোগের চিকিৎসায় দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছে। ভবিষ্যতে সরকারের প্রচেষ্টা আছে, মানসিক রোগের যেন চিকিৎসা দিতে পারে, সেজন্য সব উপজেলা পর্যায়ে অন্তত একজন চিকিৎসককে নিয়োগ দেওয়া হবে।’

এদিকে, মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় কর্মসূচি বাস্তবায়নের সবচেয়ে বড় অন্তরায় মানসিক রোগ ও চিকিৎসার প্রতি মানুষের ভ্রান্ত বিশ্বাস, কুসংস্কার ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। এরপর রয়েছে পর্যাপ্ত মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ, মনোচিকিৎসক ও মনোবিদসহ বিভিন্ন জনবলের অভাব, অপর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ, প্রয়োজনীয় রেফারেল ব্যবস্থার ঘাটতি, মানসিক রোগীর জন্য দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন ব্যবস্থার অভাব ও গবেষণা কাজের জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক সংস্থান।

গবেষকদের মতে, মানসিক অবস্থা বিকল হওয়ার কারণে কিংবা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে অনেকেই আত্মহত্যার মতো ভয়াবহ পথ বেছে নেন।

বর্তমান সরকারের ভিশন-২০২০ অনুসারে মানসিক স্বাস্থ্য গুরুত্ব পেয়েছে। মানসিক স্বাস্থ্যকে এসডিজিতে অন্তর্ভুক্তকরণে জাতিসংঘের নৈতিক সমর্থনও মিলেছে, যা বিশ্বব্যাপী মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে একটি ক্রস কাটিং ইস্যুতে পরিণত হয়েছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০