বিশেষ প্রতিনিধি: দেশে বিদ্যুতের প্রকৃত চাহিদা কত এর সঠিক হিসাব নেই। বিতরণকারী বিভিন্ন কোম্পানি ও সংস্থার প্রাক্কলনের ভিত্তিতে বিদ্যুতের চাহিদা হিসাব করা হয়। একই অবস্থা বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতারও। কাগজে-কলমে ২৩ হাজার মেগাওয়াটের বেশি (আমদানি) উৎপাদন সক্ষমতা বলা হলেও, প্রকৃতপক্ষে তা অনেক কম। ফলে সদ্য বিদায়ী রোজায় সর্বোচ্চ উৎপাদনের রেকর্ড হলেও, লোডশেডিং সামাল দেয়া যায়নি।
খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ১০-১২ শতাংশ সবসময়ই রক্ষণাবেক্ষণে থাকে। তাই চাহিদার চেয়ে উৎপাদন সক্ষমতা ১৫ শতাংশ বেশি রাখলেই চলে। বাংলাদেশে চলতি মাসে সর্বোচ্চ চাহিদা ধরা হয়েছিল ১৬ হাজার মেগাওয়াট। এ হিসাবে প্রায় সাড়ে ১৮ হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনের জন্য সবসময় প্রস্তুত থাকা উচিত। যদিও তেমনটি হয়নি। বরং বর্তমানে ১৬ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা নেই।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্যমতে, বর্তমানে সংস্থাটির নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে ৩৮টি, যেগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা ছয় হাজার ১৩ মেগাওয়াট। এছাড়া আশুগঞ্জ পাওয়ার সাপ্লাই কোম্পানির বিদ্যুৎকেন্দ্র পাঁচটি, ইলেকট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানির (ইজিসিবি) কেন্দ্র তিনটি, নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির (এনডব্লিউপিজিসিএল) কেন্দ্র সাতটি, বি-আর পাওয়ার জেনের কেন্দ্র একটি এবং রুরাল পাওয়ার কোম্পানির (আরপিসিএল) তিনটি কেন্দ্র রয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত এ পাঁচ কোম্পানির বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা চার হাজার ৮৩ মেগাওয়াট। সব মিলিয়ে সরকারি কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা ১০ হাজার ৯৬ মেগাওয়াট।
এদিকে বাংলাদেশ-চায়না যৌথ বিনিয়োগে নির্মিত পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা এক হাজার ২৪৪ মেগাওয়াট এবং বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বিনিয়োগে নির্মিত রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের (এক ইউনিট) উৎপাদন সক্ষমতা ৬১২ মেগাওয়াট। এছাড়া বেসরকারি খাতে নির্মিত ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার (আইপিপি) বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে ৬৫টি। ভারতের আদানিসহ এসব কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা আট হাজার ৭৯৪ মেগাওয়াট।
ছোট আইপিপি (এসআইপিপি) পিডিবির অধীনে রয়েছে চারটি ও আরইবির (পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড) অধীনে রয়েছে ৯টি। এগুলোর বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৩৫০ মেগাওয়াট। আর রেন্টাল (৩/৫ বছর মেয়াদি) বিদ্যুৎকেন্দ্র ১২টি ও ১৫ বছর মেয়াদি রয়েছে চারটি। এগুলোর বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা এক হাজার ৭১ মেগাওয়াট। এছাড়া ভারত থেকে আমদানি করা হয় এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াট। সব মিলিয়ে বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৩ হাজার ৩৩২ মেগাওয়াট।
যদিও প্রকৃতপক্ষে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা অনেক কম। বর্তমানে দেশে ১৬ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব নয়। চলতি মাসে শুধু দু’দিন সক্ষমতা ছিল ১৬ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। এর মধ্যে ২১ এপ্রিল রাত ৯টায় (পিক আওয়ার) সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল (আমদানিসহ) ১৬ হাজার ৩৩ মেগাওয়াট। এর আগের দিন (২০ এপ্রিল) রাত ৯টায় সর্বোচ্চ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ১৬ হাজার ৩০ মেগাওয়াট। তবে জ্বালানি সংকটে ওই দু’দিনও ১৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়নি।
পিডিবির তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, গত ১৭ এপ্রিল রাত ৯টায় দেশে সর্বোচ্চ বিদ্যুতের চাহিদা ছিল। ওই সময় ১৬ হাজার ২২১ মেগাওয়াট চাহিদা দেখা হলেও বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় ১৫ হাজার ৬০৪ মেগাওয়াট। এছাড়া ১৯ এপ্রিল রাত ৯টায় দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। ওই সময় বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল (আমদানিসহ) ১৫ হাজার ৬৪৮ মেগাওয়াট। তবে সর্বোচ্চ উৎপাদনের সময়ও ৪২৮ মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি ছিল। ফলে রেকর্ড উৎপাদনের সময়ও লোডশেডিং হয়।
এদিকে গতকাল দেশে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ১৫ হাজার ২২৮ মেগাওয়াট। এর আগের দিন (২৮ এপ্রিল) সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল আরও কম, ১৪ হাজার ৪৪৩ মেগাওয়াট। ওইদিনের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, জ্বালানি তেল, গ্যাস ও কয়লার সংকটের কারণে ৩৩টি কেন্দ্রে পূর্ণ বা আংশিক উৎপাদন বন্ধ ছিল। এতে দুই হাজার ৭৩৫ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র বসে ছিল। একই সময় রক্ষণাবেক্ষণ বা কারিগরি ত্রুটির কারণে বন্ধ ছিল তিন হাজার ৩৫১ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম এ প্রসঙ্গে শেয়ার বিজকে বলেন, দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা কতÑ এর কোনো সঠিক তথ্য বা পরিসংখ্যান নেই। একই অবস্থা বিদ্যুতের চাহিদার। এর সঠিক পরিসংখ্যানও নেই। ফলে একদিনে রেকর্ড উৎপাদন করেও সাম্প্রতিক তীব্র গরমে লোডশেডিং সামাল দেয়া যায়নি। আবার ২৩ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন সক্ষমতা বলা হলেও সর্বোচ্চ সাড়ে ১৫ হাজার মেগাওয়াটের বেশি উৎপাদন করা যায়নি।
যদিও সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের মধ্যেও ফাঁকি রয়েছে বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে। কারণ ১৭-১৯ এপ্রিল পরপর তিন দিন সর্বোচ্চ উৎপাদনের রেকর্ড গড়লেও শুধু সন্ধ্যা থেকে রাতের কিছু সময় সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। পরে তা কমিয়ে আনা হয়। এমনকি সর্বোচ্চ উৎপাদনের (রাত ৯টা) তিন থেকে চার ঘণ্টার মধ্যে বড় ধরনের লোডশেডিং হয়েছিল। দিনে বিদ্যুৎ ?উৎপাদন আরও কমিয়ে দেয়া হয়। এতে ওই সময় দিনেও বড় ধরনের লোডশেডিং হয়েছে।
পিডিবির তথ্য বলছে, ১৯ এপ্রিল রাত ৯টায় ১৫ হাজার ৬৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছিল, যা রেকর্ড। ওইদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় বিদ্যুৎ উৎপাদন ১৫ হাজার মেগাওয়াট অতিক্রম করে। আর রাত সাড়ে ১০টায় তা ১৪ হাজার ৮৯৫ মেগাওয়াটে নেমে আসে। এর আগের দিনও একই অবস্থা ছিল। ১৮ এপ্রিল রাত ৯টায় ১৫ হাজার ৬২৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছিল। ওইদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় বিদ্যুৎ উৎপাদন ১৫ হাজার মেগাওয়াট অতিক্রম করে। রাত ১১টায় তা ১৪ হাজার ৮৭৩ মেগাওয়াটে নেমে আসে। ১৭ এপ্রিলও সন্ধ্যা ৭টায় বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় ১৫ হাজার মেগাওয়াট ছাড়ায়। রাত ১১টায় তা ১৪ হাজার ৮৪৫ মেগাওয়াটে নেমে আসে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঊর্ধ্বতন পিডিবির কর্মকর্তারা বলেন, তেল-গ্যাস সংকটে চাইলেও সারাদিন পুরোদমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব নয়। যে হারে গ্যাস ও তেল পাওয়া যায় সে অনুপাতে উৎপাদন করা হয়। তবে পিক আওয়ারে (রাত ৯টা) সর্বোচ্চ উৎপাদনের লক্ষ্যকে সামনে রেখে বিদ্যুৎ ?উৎপাদন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। সাধারণত রাত ১১টায় সিএনজি ফিলিং স্টেশনগুলো চালু হয়ে যায়। এছাড়া রাতে বেশকিছু কারখানায় উৎপাদন চলে। এ কারণে ১১টা থেকে গ্যাস সরবরাহ কমে যায়। এতে বাধ্য হয়েই বিদ্যুৎ উৎপাদন কমাতে হয়।