১৭ শর্তে দরকষাকষি কেন্দ্রীয় ব্যাংক-আইএমএফের

ইসমাইল আলী ও রোহান রাজিব: রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একক কর্তৃত্ব স্থাপন করতে হবে, অর্থ পাচারকারীদের নাম ও বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করতে হবে, বেসরকারি কোনো ব্যাংকে এক পরিবারের দুইজনের বেশি পরিচালক থাকতে পারবে না, টানা ছয় বছরের বেশি পরিচালক থাকতে পারবে না কেউ, বাংলাদেশ ব্যাংকে থাকবে আইএমএফের পর্যবেক্ষক, সুদের হারের সীমা তুলে দিতে হবে, রিজার্ভের প্রকৃত পরিমাণ দেখাতে হবে, ব্যালেন্স অব পেমেন্টের সঠিক তথ্য প্রকাশ করতে হবেÑএমনই এক গাদা শর্ত দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। ঋণ পেতে হলে পর্যায়ক্রমে এসব শর্ত পূরণ করতে হবে বাংলাদেশকে।

দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় আইএমএফ থেকে সাড়ে চার বিলিয়ন (৪৫০ কোটি) ডলার ঋণ চেয়েছে বাংলাদেশ। এজন্য সংস্থাটির প্রতিনিধিদল গত দু’সপ্তাহ ধরে ঢাকায় বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে আলোচনা করে। এর মধ্যে গত ৮ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সমাপনী বৈঠক করে। এর আগে ২৭, ৩০ ও ৩১ অক্টোবর এবং ২ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করেছে আইএমএফ প্রতিনিধিদল। এছাড়া শিডিউল বহির্ভূতভাবে গভর্নরের বাসায় নৈশভোজে অংশ নেয় আইএমএফ প্রতিনিধিদল।

সূত্র জানায়, পাঁচ দফা বৈঠকে ব্যাংক ও আর্থিক খাতে বড় ধরনের সংস্কারে জোর দেয় আইএমএফ। মূলত ১৭টি শর্তকে সামনে রেখে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করে প্রতিনিধিদল। এ সময় তাৎক্ষণিক তিনটি শর্ত মানতে রাজি হয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিছু শর্ত পর্যায়ক্রমে মানার কথাও জানানো হয়। তবে কয়েকটি শর্ত মানার বিষয়ে কোনো ধরনের আশ্বাস দেয়া হয়নি। আর বৈঠকগুলোয় যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন আইএমএফের প্রধান কার্যালয়ের কর্মকর্তারা।

বৈঠকে উপস্থিত একাধিক সূত্র জানায়, রিজার্ভের দুইটি বিষয় নিয়ে আপত্তি তুলে আইএমএফ। প্রথমত, রিজার্ভ হিসাব পদ্ধতিতে সংস্কার আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। এক্ষেত্রে রিজার্ভ থেকে বাদ দিতে হবে ইডিএফ (রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল) ও আইডিএফ (অবকাঠামো উন্নয়ন তহবিল)। প্রাথমিকভাবে এটি মানতে রাজি হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এক্ষেত্রে শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক পর্ষদে অনুমোদন নিলেই হবে।

এ বিষয়ে এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গতকাল অর্থ মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর জানান, বর্তমানে নেট রিজার্ভের পরিমাণ প্রায় ২৬ বিলিয়ন ডলার। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে এর পরিমাণ দেখানো হয়েছে প্রায় ৩৪ বিলিয়ন ডলার। তবে এখনই একবারে রিজার্ভ সমন্বয় করবে না বাংলাদেশ ব্যাংক। রিজার্ভ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে তা সমন্বয়ের কথা জানানো হয়।

রিজার্ভ সংরক্ষণ পদ্ধতিতে আরও একটি আপত্তি তোলে আইএমএফ। তা হলÑরিজার্ভের যে মুনাফা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক দেখায় তার একটি অংশ আন-রিয়েলাইজড গেইন, সেটি বাদ দিতে হবে। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আর্থিক বিবরণী মান (আইএফআরএস) অনুসরণ করা হয়নি। এ পদ্ধতি সংস্কারের শর্ত দেয়া হয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রিজার্ভের একটি অংশ স্বর্ণ ও বন্ডে বিনিয়োগ করে রেখেছে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের দাম বাড়লেই তা রিজার্ভের মুনাফা হিসেবে যোগ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে আইএফআরএস অনুযায়ী তা গ্রহণযোগ্য নয়। এক্ষেত্রে স্বর্ণ বিক্রি করে নগদায়ন করার আগে তাকে রিজার্ভের অংশ হিসেবে দেখানো যাবে না।

এদিকে গতকাল অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে রিজার্ভ হিসাবের ক্ষেত্রে বিপিএম৬ অনুসরণের কথা জানানো হয়। আইএমএফ প্রণীত এ নীতিমালা অনুযায়ী এভেইলেবল রিজার্ভকে পৃথকভাবে দেখাতে বলা হয়। সাধারণত স্বর্ণ বা বন্ডে বিনিয়োগকেও রিজার্ভের অংশ হিসেবে দেখানো হয়। তবে যেকোনো তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে এ রিজার্ভকে ব্যবহার করা সম্ভব নয়। তাই এভেইলেবল  রিজার্ভে স্বর্ণ ও বন্ডে বিনিয়োগকে বাদ দিয়ে নগদ রিজার্ভকে দেখাতে হবে।

বৈঠকে উপস্থিত একাধিক কর্মকর্তা জানান, গত দুই মাস ধরে অলিখিতভাবে এলসি খোলা বন্ধ রাখা নিয়েও আপত্তি তুলেছে আইএমএফ প্রতিনিধিদল। দ্রুত তা খুলে দেয়ার শর্ত দেয়া হয়। এছাড়া মুদ্রানীতির মূল্যায়ন তিন মাস পর পর করার শর্ত দেয়া হয়, যা ৭-৮ বছর আগে অনুসরণ করত কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এছাড়া বছরে দুইবার মুদ্রানীতি ঘোষণা করার কথাও বলা হয়েছে। যদিও তিন বছর ধরে বছরে একবার মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হচ্ছে।

আইএমএফের অন্যতম শর্ত ছিল, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বেসরকারি ব্যাংকের জন্য এক নিয়ম আর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের জন্য আরেক নিয়ম তা মানা হবে না। বর্তমানে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ডিজিএমের ওপরের পদগুলোয় পদোন্নতি সরকার নিয়ন্ত্রণ করে, যা বাতিল করতে হবে। এছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের ক্ষমতা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে দিতে হবে।

সূত্র জানায়, এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য করতে পারেনি। এ শর্তে রাজি না হলে পরবর্তীতে বিকল্প কোনো শর্ত দিতে পারে আইএমএফ বলে বৈঠকে জানানো হয়।

এদিকে ব্যালেন্স অব পেমেন্টের হিসাবেও ত্রুটি রয়েছে বাংলাদেশের, যা নিয়ে আপত্তি তোলে আইএমএফ। বৈঠক সূত্র জানায়, পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে শুধু পণ্যমূল্যকে বিবেচনা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এক্ষেত্রে জাহাজ ভাড়া, ফ্রেড ফরোয়ার্ড চার্জ, বিমা চার্জ ইত্যাদিও ডলারে পরিশোধ করতে হয়। এগুলোও আমদানির ব্যয়ের অংশ। কিন্তু এসব চার্জ বাদ দেয়ায় আমদানি কম দেখানো হয়। এতে গত কয়েক বছরে পাঁচ বিলিয়ন ডলার আমদানি ব্যয় কম দেখানো হয়েছে। এ মূল্যকে আমদানির ব্যয়ের সঙ্গে যোগ করে ব্যালেন্স অব পেমেন্টের (বিওপি) সঠিক হিসাব দেখাতে বলা হয়েছে।

গত দুই সপ্তাহে অনুষ্ঠিত বৈঠকে আইএমএফ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে আরও কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। এর মধ্যে রয়েছে, ঋণের সুদের হারের সীমা তুলে দেয়া, অভিন্ন এক্সচেঞ্জ রেট, খেলাপি ঋণ কমানো, বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি কমিয়ে আনা, ব্যাংক পর্ষদ গঠনের আইনের সংস্কার, ব্যাংকের আইটি খাতের সংস্কার, বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা, খাতভিত্তিক আর্থিক ইন্ডিকেটরস, বিভিন্ন ব্যাংকের অনিয়মের বিরুদ্ধে গৃহীত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা, ১০টি দুর্বল ব্যাংকের জন্য নেয়া উদ্যোগ, ফাইন্যান্সিয়াল সেক্টর সাপোর্ট প্রজেক্ট (এফএসএসপি) বাস্তবায়ন, ব্যাংক সুপারভিশন, ক্যাপাসিটি বিল্ডিং, ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১, ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন (সংশোধন) আইনসহ ৫টি অন্যতম আইনের সংস্কার।

আইএমএফের শর্ত মানতে গিয়ে এরই মধ্যে ঋণের সুদহার তুলে দেয়া শুরু হয়েছে। এক্ষেত্রে উৎপাদনশীল খাত ছাড়া বাকি সব খাতে ৯ শতাংশ সুদহারের সীমা তুলে দেয়ার কথা বলে আইএমএফ। এর পরিপ্রেক্ষিতে গাড়ি ও ব্যক্তিগত ঋণে সর্বোচ্চ ১২ শতাংশ সুদহার নিতে পারবে বলে ব্যাংকগুলোকে এরই মধ্যে মৌখিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

সূত্র জানায়, বেসরকারি ব্যাংকের পর্ষদ গঠনের আইনে যে পরিবর্তন বাংলাদেশ করেছে তা নিয়ে কঠোর আপত্তি তুলেছে আইএমএফ। আগে বেসরকারি কোনো ব্যাংকে এক পরিবারের দুইজনের বেশি পরিচালক থাকতে পারত না। এছাড়া টানা ছয় বছরের বেশি কেউ পরিচালক থাকতে পারবে না বলে আইন ছিল। তবে তা সংশোধন করে টানা ৯ বছর পরিচালক থাকা ও এক পরিবারের যতজন ইচ্ছা ততজন পর্ষদে থাকার সুযোগ দেয়া হয়। তবে তা বাতিলের জন্য ব্যাংক কোম্পানি আইন সংস্কার করে আগের শর্ত ফেরত আনার কথা বলেছে আইএমএফ।

এদিকে ডলারের বিপরীতে বিনিমর হারকে ডিসেম্বরের মধ্যে একটি মানদণ্ডে আনতে বলা হয়। বর্তমানে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয়, আমদানি ও খোলা বাজারে ডলারের ভিন্ন ভিন্ন হার অনুসরণ করা হয়। ক্ষেত্রভেদে তা ৯৯ থেকে ১০৭ টাকা। এক্ষেত্রে কাছাকাছি একটি বা দুটি হারকে অনুসরণের শর্ত দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্মত হয়েছে। তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে তা বাস্তবায়ন করা হবে।

বৈঠকে বিএফআইইউয়ের (বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টালিজেন্স ইউনিট) কার্যক্রমে জবাবদিহিতা বাড়াতে বলেছে আইএমএফ। এছাড়া অর্থ পাচারকারীদের তথ্য যেকোনো ফরম্যাটে প্রকাশের শর্ত দেয়া হয়। তবে এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কিছুই জানায়নি। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন বৃদ্ধি ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কমানোর শর্তও দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে এ বছর আইএমএফ যে গোপন প্রতিবেদন দিয়েছে সেটি পালনে কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারÑতাও জানতে চাওয়া হয়। তবে প্রতিবেদন সম্পর্কে কোনো তথ্য জানাতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক।

সূত্র জানায়, সর্বশেষ বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আইএমএফ প্রতিনিধিদল সমাপনী বৈঠকে নিজেদের পক্ষে দরকষাকষি করেছেন। আইএমএফ অনেক বিষয়ে তাৎক্ষণিক পরিবর্তন চায়। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধিরা কিছু ইস্যুতে দ্বিমত পোষণ করে নিজেদের ব্যাখা উপস্থাপন করেছে। তবে ঋণ পেতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যক্রম এবং ব্যাংক ও আর্থিক খাতের সংস্কার পর্যবেক্ষণে আইএমএফ সরাসরি নিজেদের লোক দিয়ে তদারকি করবে। এক্ষেত্রে পরামর্শক দেশীয় বা বিদেশি হতে পারে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০