এহসান গ্রুপের প্রতারণা

১৭ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ

নিজস্ব প্রতিবেদক: সুদমুক্ত বিনিয়োগের ধারণা দিয়ে এমএলএম কোম্পানির ফাঁদ তৈরি করে ১৭ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন এহসান গ্রুপের চেয়ারম্যান রাগীব আহসান। ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে ধর্মপ্রাণ সাধারণ মুসলমান, ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যুক্ত ব্যক্তি, ইমাম শ্রেণি ও অন্যদের টার্গেট করতেন রাগীব। এছাড়া তিনি ওয়াজ মাহফিল আয়োজনের নামে ব্যবসায়িক প্রচার-প্রচারণা করতেন।

এসব প্রতারণা ও জালিয়াতির অভিযোগে এহসান গ্রুপের চেয়ারম্যান রাগীব আহসান (৪১) ও তার সহযোগী মো. আবুল বাশার খানকে (৩৭) গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব-১০। কয়েকজন ভুক্তভোগীর অভিযোগের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার (৯ সেপ্টেম্বর) রাতে র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র‌্যাব-১০-এর একটি আভিযানিক দল রাজধানীর শাহবাগ থানার তোপখানা রোড এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করে। এ সময় তাদের কাছ থেকে ভাউচার বই ও মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়।

গতকাল বিকালে কারওয়ান বাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

র‌্যাব জানায়, রাগীব আহসান ১৭টি প্রতিষ্ঠানের নামে প্রতারণার ফাঁদ তৈরি করেন। রাগীব আহসানের বিরুদ্ধে ১৫টির বেশি মামলা রয়েছে। রাগীব লাখ টাকার বিনিয়োগে মাসিক মাত্রাতিরিক্ত টাকা প্রাপ্তির প্রলোভন দেখিয়ে ২০০৮ সালে ১০ হাজার গ্রাহককে যুক্ত করেন। এখন তার গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় লক্ষাধিক।

গ্রেপ্তার রাগীব আহসান জানান, তিনি এহসান গ্রুপের অধীনে ১৭টি প্রতিষ্ঠানের নামে প্রতারণার ফাঁদ তৈরি করেন। প্রতিষ্ঠানগুলো হলোÑএহসান গ্রুপ বাংলাদেশ, এহসান পিরোজপুর বাংলাদেশ (পাবলিক) লিমিটেড, এহসান রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড বিল্ডার্স লিমেটেড, নূর-ই মদিনা ইন্টারন্যাশনাল ক্যাডেট একাডেমি, জামিয়া আরাবিয়া নূরজাহান মহিলা মাদ্রাসা, হোটেল মদিনা ইন্টারন্যাশনাল (আবাসিক), আল্লাহর দান বস্ত্রালয়, পিরোজপুর বস্ত্রালয়-১ ও ২, এহসান মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড, মেসার্স বিসমিল্লাহ ট্রেডিং অ্যান্ড কোং, মেসার্স মক্কা এন্টারপ্রাইজ, এহসান মাইক অ্যান্ড সাউন্ড সিস্টেম, এহসান ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলস, ইসলাম নিবাস প্রজেক্ট, এহসান পিরোজপুর হাসপাতাল, এহসান পিরোজপুর গবেষণাগার ও এহসান পিরোজপুর বৃদ্ধাশ্রম।

র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে রাগীব আহসান জানান, তিনি ১৯৮৬ সালে মাদ্রাসায় পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯৯৯ সালে হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে তিনি পাস করেন। ২০০০ সালে খুলনার একটি মাদ্রাসা থেকে মুফতি ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর মসজিদে ইমামতি করেন।

২০০৬-০৭ সালের দিকে ইমামতির পাশাপাশি ‘এহসান এস মাল্টিপারপাস’ নামে একটি এমএলএম কোম্পানিতে ৯০০ টাকা বেতনের চাকরি করার মাধ্যমে এমএলএম কোম্পানির আদ্যোপান্ত রপ্ত করেন রাগীব। ২০০৮ সালে ‘এহসান রিয়েল এস্টেট’ নামে একটি এমএলএম কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন নিজেই। ওই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ১০ হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে ১১০ কোটি টাকা নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন।

অর্থ সংগ্রহের ক্ষেত্রে রাগীব ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতি ব্যবহার করেন। দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষকে আকৃষ্ট করতে শরিয়াহ্ পদ্ধতিতে সুদমুক্ত বিনিয়োগে ব্যবসার প্রচারণা চালান। নিজের এলাকা পিরোজপুরে ওয়াজ-মাহফিলের আয়োজন করে তার এমএলএম কোম্পানিতে অংশীদার হতে আহ্বান জানান। এভাবে তিনি ১৭টি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। লাখ টাকার বিনিয়োগে রাগীব মাসিক মাত্রাতিরিক্ত টাকা প্রাপ্তির প্রলোভন দেখান। ২০০৮ সালে ১০ হাজার গ্রাহককে যুক্ত করতে সমর্থ হন। পরে গ্রাহকের সংখ্যা লাখেরও বেশি ছাড়িয়ে যায় বলে জানতে পেরেছে র‌্যাব।

জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, রাগীবের তত্ত্বাবধানে ৩০০ মাঠপর্যায়ের কর্মী ছিল, যাদের কোনো বেতন ছিল না। যদিও তাদের বিনিয়োগ আনার পরিমাণের ওপর ২০ শতাংশ লভ্যাংশ দেয়ার কথা ছিল। এসব পরিকল্পনার মাধ্যমে তিনি দ্রুত গ্রাহকসংখ্যা বাড়াতে সক্ষম হন। কর্মী-গ্রাহক সবার সঙ্গে প্রতারণা করেছেন তিনি। কর্মী-গ্রাহকদের কাউকেই লভ্যাংশ পরিশোধ করেননি।

ভুক্তভোগীরা দাবি করেন, এসব প্রতিষ্ঠানের নামে অর্থ সংগ্রহ করে রাগীব পরিবারের সদস্য ও নিকট আত্মীয়দের নামে-বেনামে সম্পত্তি ও জায়গা-জমি কিনেছেন।

গ্রেপ্তার রাগীব জিজ্ঞাসাবাদে র‌্যাবকে জানান, তিনি তার পরিবারের সদস্যদের নাম যুক্ত করে ব্যবসায়িক কাঠামো তৈরি করেন। শ্বশুরকে প্রতিষ্ঠানের সহসভাপতি, বাবাকে উপদেষ্টা ও ভগ্নিপতিকে ম্যানেজার করেছেন রাগীব। এছাড়া রাগীব আহসানের তিন ভাইয়ের মধ্যে গ্রেপ্তার আবুল বাশার প্রতিষ্ঠানের সহ-পরিচালক। অন্য দুজন প্রতিষ্ঠানের সদস্য।

গ্রাহকদের কাছ থেকে সংগৃহীত অর্থ হাউজিং, ল্যান্ড প্রজেক্ট, ব্যবসায়িক দোকান, ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের আড়ালে আত্মসাৎ করেছেন রাগীব। তিনি এখন পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদে ১১০ কোটি টাকা সংগ্রহের স্বীকারোক্তি দিয়েছেন।

গ্রেপ্তার রাগীব আহসান বিভিন্নভাবে গ্রাহকদের সঙ্গে চেক জালিয়াতি করতেন। অনেকেই পাওনা টাকার চেক নিয়ে ব্যাংকে গিয়ে প্রতারিত হয়েছেন। এছাড়া ভুক্তভোগীদের অনেকেই ভয়ভীতি, লাঞ্ছিত ও নির্যাতিত হওয়ার কথা জানিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় ১৫টি মামলা রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন নির্যাতনের কাহিনি মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন ও গণমাধ্যমেও উঠে এসেছে।

এক প্রশ্নের জবাবে র‌্যাবের গণমাধ্যম শাখার প্রধান কমান্ডার মঈন বলেন, নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা তিনি সময়ে সময়ে গ্রাহকদের দিয়েছেন। তবে অধিকাংশ গ্রাহকই টাকা ফিরে পাননি। সাত থেকে আটটি ল্যান্ড প্রজেক্ট করেছেন, দুটি মার্কেট গড়েছেন।

এহসান গ্রুপের চেয়ারম্যান রাগীব এহসান ঠিক কত পরিমাণ অর্থ জালিয়াতি করেছেন, তার বিশদ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে মানি লন্ডারিংও হতে পারে। সেজন্য সিআইডি ও দুদককে র?্যাব চিঠি দিয়ে জানাবে।

হাতিয়ে নেয়া অর্থ জঙ্গিবাদে কিংবা দেশকে উত্তপ্ত করার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে কি না জানতে চাইলে কমান্ডার মঈন বলেন, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অবশ্যই বিষয়টি তদন্ত করে দেখবে। ঢাকা, সিলেট, নারায়ণগঞ্জ, পিরোজপুরসহ ২০ জেলায় তার বিরুদ্ধে মানববন্ধন হয়েছে। তিনি যে পরিমাণ টাকা গ্রাহকদের কাছ থেকে হাতিয়েছেন, তা জঙ্গিবাদ বা দেশকে উত্তপ্ত করার ক্ষেত্রে ব্যবহার করতেন কি না, তা তদন্তসাপেক্ষে জানা যাবে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০