১৮ শতাংশ কর্মসংস্থান: ডিপ্লোমাধারীদের মানসম্মত উচ্চশিক্ষার সুযোগ সীমিত

 

নাজমুল হুসাইন: দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলে প্রতিবছর দেড় লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী ডিপ্লোমা কোর্স শেষ করছেন। তবে চার বছরের এসব ডিপ্লোমা কোর্স শেষে শিক্ষার্র্থীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ কম। বৃহৎ অংশের এসব ডিপ্লোমাধারীর জন্য দেশের সরকারি প্রতিষ্ঠান মাত্র একটি। যেখানে  পড়ার সুযোগ হয় এক শতাংশেরও কম। শুধু উচ্চশিক্ষায়ই বঞ্চিত হচ্ছে এসব ডিপ্লোমাধারীরা তা নয়, দেশের সীমিত চাকরির বাজারেও মিলছে না তাদের কাক্সিক্ষত কর্মসংস্থান। এতে বেকার রয়ে যাচ্ছে প্রায় অর্ধেক ডিপ্লোমাধারী।

তথ্যমতে, দেশে ডিপ্লোমাধারীর উচ্চশিক্ষার একমাত্র প্রতিষ্ঠান ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ডুয়েট)। এ প্রতিষ্ঠানে প্রতি শিক্ষাবর্ষে ৫২০ জন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারকে উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেওয়া হয়। বর্তমানে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের আওতায় ডিপ্লোমা ডিগ্রি প্রদানকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা চার শতাধিক। সরকারিভাবে ৪৯টি আর বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় গড়ে উঠেছে ৩৮৫টি প্রতিষ্ঠান। সব মিলে এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী দেড় লাখ। যারা উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাচ্ছেন না।

শুধু উচ্চশিক্ষা নয়, ডিপ্লোমাধারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগও সীমিত। কর্মের সঙ্গে অনেকটাই সম্পর্কহীন এসব শিক্ষার কারণে এ অবস্থা। এতে বেকার হয়ে রয়েছে দেশের অর্ধেক ডিপ্লোমাধারী। গত বছর দেশে কারিগরি শিক্ষার্থীদের নিয়ে গবেষণা করে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। সংস্থাটির প্রকাশিত ‘ইনোভেটিভ স্ট্র্যাটেজিস ইন টেকনিক্যাল অ্যান্ড ভোকেশনাল এডুকেশন অ্যান্ড ট্রেনিং ফর অ্যাসিলারেটেড হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট ইন সাউথ এশিয়া: বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে উঠে আসে ডিপ্লোমাধারীদের দুর্দশার চিত্র।

প্রতিবেদনে তথ্যমতে, চার বছর মেয়াদি ডিপ্লোমাধারীদেরও মাত্র ১৮ দশমিক ২ শতাংশের কর্মসংস্থান হয়েছে। চাকরি না পেলেও কারিগরি জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পেরেছে মাত্র ২ দশমিক ৪ শতাংশ। চাকরি না পেয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে উচ্চশিক্ষায় নিয়োজিতের প্রবণতায় রয়েছে ৩২ দশমিক ৯ শতাংশ। আর দেশের ডিপ্লোমাধারীদের মধ্যে বেকার রয়েছে ৪৬ দশমিক ৪ শতাংশ।

এ প্রসঙ্গে পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থায় বড় ধরনের অসামঞ্জস্য রয়েছে। এছাড়া দেশের শ্রমবাজার সম্প্রসারণ কতটুকু হচ্ছে তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হলেও সে অনুপাতে কাজের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না। এছাড়া কারিগরি শ্রমশক্তিকে বিদেশে রফতানির সুযোগও কাজে লাগানো যাচ্ছে না।’

কর্মসংস্থান ও উচ্চশিক্ষার সুযোগ প্রসারিত না হলেও উল্টো বাড়ছে ডিপ্লোমা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা। দেশের আনাচ-কানাচে গড়ে উঠছে বেসরকারি পলিটেকনিক্যাল। এসব প্রতিষ্ঠান নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে সব মহলে। আর উচ্চশিক্ষা ব্যবসায় নেমেছে নামসর্বস্ব অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়।

রাজধানীসহ সারা দেশে নামসর্বস্ব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পাঠদান। কিন্তু শিক্ষার্থীদের কতটুকু দক্ষ করে গড়ে তোলা হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বিষয়টি সরকারও দেখছে না। নিরুপায় এসব ডিপ্লোমাধারী শিক্ষার্থী এসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হচ্ছেন।

এ বিষয়ে ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশের (আইইবি) প্রেসিডেন্ট কবির আহমেদ বলেন, ‘দেশের এমন অবস্থা যে, বাংলাদেশে এখন আর কোনো ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার, গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি ছাড়া নেই। কেননা সরকারের একটি ডুয়েট ছাড়া ডিপ্লোমধারীদের কোনোই পথ নেই। তাই বাধ্য হয়ে নামসর্বস্ব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে অনেকে। ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়াররা সেখানে যাচ্ছেন, আর টাকা দিয়ে বিএসসির সার্টিফিকেট পাচ্ছেন। এ বিষয়ে সরকারের নজর দেওয়া উচিত।’

দেশের ১০টি পলিটেকনিকে এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য এক যুগেও সৃষ্টি করা হয়নি কর্মসংস্থানের কোনো পদ। এছাড়া ইনস্টিটিউট অব গ্লাস অ্যান্ড সিরামিক, গ্রাফিকম আর্টস ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ সার্ভে ইনস্টিটিউটে ডিপ্লোমা করে উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা নেই। এছাড়া বিভিন্ন ইনস্টিটিউটে অটোমোবাইল, কেমিক্যাল, প্রিন্টিং, ইলেকট্রো মেডিক্যাল, মেরিন, শিপবিল্ডিং, মেকাটনিকস, কনস্ট্রাকশন, টেলিকমিউনিকেশন, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স, ইনস্টরুমেন্টেশন অ্যান্ড প্রসেস কন্ট্রোল, ডেটা টেলিকমিউনিকেশন অ্যান্ড নেটওয়ার্কিং, এয়ারক্রাফট মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ারিং (অ্যারোস্পেস), এয়ারক্রাফট মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ারিং (অ্যাভিয়োনিকস) এবং মাইনিং অ্যান্ড মাইন সার্ভে টেকনোলজি মতো বিষয় খোলা হলেও উচ্চশিক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

সরকারি কারিগরি শিক্ষক সমিতির সভাপতি ইদ্রিস আলী বলেন, ‘ডিপ্লোমাধারী শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার জন্য অনেকবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। শিক্ষার্থীরাও রাস্তায় নেমে আন্দোলন করেছে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। ফলে প্রতিবছর দেশের লাখো শিক্ষার্থী শিক্ষাজীবনের মাঝপথে এসে হতাশ হয়ে পড়েন এবং ঝরে যান।’

এসব বিষয়ে কথা হলে পরিবেশ প্রকৌশল বিভাগের সম্প্রতি ডিপ্লোমা শেষ করা শিক্ষার্থী সফিক আহমেদ উচ্চশিক্ষা ও কর্মের সুযোগ সম্পর্কে আক্ষেপ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘ডুয়েটে চান্স না পেয়ে বাধ্য হয়েই এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। তবে জানি, এ সার্টিফিকেট কোনো কাজে লাগবে না। বৃথা সময় ব্যয় করছি। সঙ্গে বাবার অর্থ নষ্ট।’

এ কারণে পরিবারের চাপে চাকরির চেষ্টা করছেন, যা বাস্তবে সম্ভব নয়Ñএমনটা জানিয়ে সফিক বলেন, ‘চাকরি তো হবে না। কারণ দেশে পরিবেশ অধিদফতর রয়েছে। কিন্তু সেখানে পরিবেশ প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থীদের চাকরির সুযোগ নেই। সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ওয়াসা, শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে শিল্পকারখানা, বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি), দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাসহ বেশ কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে পরিবেশ প্রকৌশলী লাগে, অথচ কোথাও নিয়োগ দেওয়া হয় না। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি খুব স্বল্পসংখ্যক।’

 

 

 

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০