১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ছিল প্রথম ভাষা দিবস

কাজী সালমা সুলতানা: ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ১১ মার্চ একটি গৌরবোজ্জ্বল দিন। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ দাবিতে পূর্ব বাংলায় সর্বাত্মক সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। এটাই ছিল ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস তথা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এ দেশে প্রথম সফল হরতাল। এদিন প্রতিবাদের যে ভিত রচনা হয়েছিল, তারই সূত্র ধরে তৎকালীন সরকার ১৫ মার্চ রাষ্ট্রভাষা চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয় এবং এই সংগ্রাম পরিপূর্ণতা লাভ করে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে।

১৯৪৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তমদ্দুন মজলিস ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের এক সভায় মিলিত হয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়Ñপাকিস্তান গণপরিষদের সরকারি ভাষার তালিকা থেকে বাংলাকে বাদ দেয়া, পাকিস্তানের মুদ্রা ও ডাকটিকিটে বাংলা ভাষা ব্যবহার না করা এবং নৌবাহিনীতে নিয়োগের পরীক্ষা থেকে বাংলাকে বাদ দেয়ার প্রতিবাদে ১১ মার্চ সমগ্র পাকিস্তানে সাধারণ ধর্মঘট পালন করা হবে। সভায় আরও দাবি করা হয়, বাংলাকে অবিলম্বে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি ভাষা বলে ঘোষণা করা হোক। এই সভা ও সভার সিদ্ধান্ত ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

১১ মার্চের হরতাল সফল করতে ১৯৪৮ সালের ১ মার্চ প্রচার মাধ্যমে একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়। বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন অধ্যাপক আবুল কাশেম (তমদ্দুন মজলিস সম্পাদক), শেখ মুজিবুর রহমান (পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সদস্য), নঈমুদ্দীন আহমদ (পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বায়ক) এবং আবদুর রহমান চৌধুরী (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া যুব সম্মেলনে পাকিস্তানি প্রতিনিধি দলের নেতা)। ওই বিবৃতিতে ১১ মার্চের হরতালকে সফল করার আহ্বান জানানো হয়।

১১ মার্চের হরতালকে সামনে রেখে তমদ্দুন মজলিস ও মুসলিম ছাত্রলীগের যৌথ উদ্যোগে ২ মার্চ ফজলুল হক হলে বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মীদের সমন্বয়ে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন কামরুদ্দীন আহমদ। এ সভায় উপস্থিত ছিলেন রণেশ দাসগুপ্ত, অধ্যাপক আবুল কাশেম, অজিত কুমার গুহ, আজিজ আহমদ, সরদার ফজলুল করিম, নঈমুদ্দীন আহমদ, তফাজ্জল আলী, শামসুদ্দীন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, আলী আহমদ, শহীদুল্লাহ কায়সার, অলি আহাদ, শওকত আলী, তাজউদ্দীন আহমদ, শামসুল হক, লিলি খান, আনোয়ারা খাতুন, মহিউদ্দিন, শামসুল আলম, কাজী গোলাম মাহবুব, আবদুল আউয়াল প্রমুখ। সভায় ২৮ জন সদস্য নিয়ে প্রথম সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এর আহ্বায়ক নিযুক্ত হন শামসুল আলম।

সভায় ১১ মার্চ সমগ্র পূর্ব বাংলায় সাধারণ ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১১ মার্চের কর্মসূচি সফল করার জন্য ১৯৪৮ সালের ১০ মার্চ ফজলুল হক হলে অধ্যাপক আবুল কাশেমের সভাপতিত্বে একটি প্রস্তুতি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় পরের দিনের ধর্মঘটের বিস্তারিত কর্মসূচি সম্পর্কে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

১১ মার্চ পূর্ব বাংলা (বাংলাদেশ) সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট, ঢাকা শহরে বিক্ষোভ এবং পিকেটিং করা হয়। এদিন দেশজুড়ে ছাত্র-জনতা আন্দোলন, মিছিল ও বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ভোরে ছাত্ররা পিকেটিংয়ের জন্য বিভিন্ন হল থেকে বেরিয়ে পড়েন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (বুয়েট) এবং মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিল। পিকেটিং চলাকালে ছাত্রদের ওপর লাঠিচার্জ করা হয় এবং বহু নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। হরতালের সময় ২০০ জন আহত, ১৮ জন গুরুতর আহত এবং ৯০০ জন গ্রেপ্তার হন। (অমৃত বাজার পত্রিকা, ১৩ মার্চ, ১৯৪৮)। পুলিশ মিছিল থেকে শামসুল হক, কাজী গোলাম মাহবুব, শেখ মুজিবুর রহমান, শওকত আলী, অলি আহাদসহ বেশ কয়েকজন ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেপ্তার করে।

স্বাধীন পাকিস্তানের রাজনীতিতে এটিই বঙ্গবন্ধুর প্রথম গ্রেপ্তার। ১১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকা শহরের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পূর্ণ ধর্মঘট পালিত হয়। পূর্ব বাংলার সর্বত্রই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ওই দিন ছাত্রসমাজ সর্বাত্মক ধর্মঘট পালন করে। পরবর্তীকালে ১১ মার্চ ঐতিহাসিক ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির আগ পর্যন্ত ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০