১৯৭১ গণহত্যা: এপ্রিল

কাজী সালমা সুলতানা : ১৯৭১ সাল। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের মাস। এ বছরের শুরু থেকেই পাক সেনারা প্রতিদিন বাঙালিদের হত্যা করা শুরু করে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের স্বাধিকারের দাবিকে চিরতরে নির্মূল করতে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী এই গণহত্যা শুরু করে। ৯ মাসব্যাপী এই মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ৩০ লাখ বলা হলেও সারাদেশজুড়ে নদী স্থলের অসংখ্য বধ্যভ‚মি ও গণকবর  থেকে বোঝা যায়  প্রকৃত শহিদের সংখ্যা আরও বেশি। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এ পর্যন্ত পাঁচ হাজারের অধিক বধ্যভ‚মির সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে এক হাজার বধ্যভ‚মি চিহ্নিত। এদেশের মাটি, নদী, নালা, খালবিল, পুকুর ডোবা সব ভরে গিয়েছিল মানুষের লাশে। তাদের জীবনের বিনিময়েই আমরা পেয়েছি বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে যে গণহত্যাগুলো সংঘটিত হয়েছিল:

রাজবাটি গণহত্যা: ১৩ এপ্রিল ১৯৭১। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী   দিনাজপুর শহরের দিকে অগ্রসর হতে তাকে। পথে তারা রাজবাটি ঢোকার আগে কাটাপাড়া ভুইপাড়া গোলামপাড়ার বাড়িতে বাড়িতে তল্লাশি ও হত্যাকাণ্ড চালায়। এতে অজস  সাধারণ মানুষ নিহত হয়। পাক বাহিনী রাজবাটি জামে মসজিদের পাশে কয়েকটি পাল পাড়ায় কমপক্ষে ২১ জনকে  হত্যা করে। সব মিলিয়ে এই এলাকায় কমপক্ষে ২৫ জন মানুষকে হত্যা করা হয়।

জগৎমল্লপাড়া গণহত্যা:  ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল। এক দিনেই রাউজানের বিভিন্ন গ্রামে প্রায় ২০০ জনকে গুলিতে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। সেদিন মাত্র আধা ঘণ্টায় সেখানে ৩৯ জনকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয়। একই সঙ্গে হত্যা করা হয় জগৎমল্লপাড়া-সন্নিহিত কুন্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা নূতন চন্দ্র সিংহকে।

জগৎমল্লপাড়া গণহত্যায় শহিদ হন ৪০ জন। পাকিস্তানি বাহিনী জগৎমল্লপাড়ায় এসে ৩৬ জনকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে।

চারঘাট গণহত্যা: ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী রাজশাহী জেলার পদ্মা-বড়ালবিধৌত চারঘাট উপজেলায় গণহত্যা সংঘটিত করে। সেদিন পাকিস্তানি সৈন্যরা পুলিশ একাডেমি, চারঘাট উপজেলার থানাপাড়া, কুঠিপাড়া, গৌরশহরপুর, বাবুপাড়াসহ পদ্মা নদীর তীরে ব্যাপক গণহত্যা সংঘটিত করে, যার সাক্ষ্য বহন করছে দুটি গণকবর ও একটি বধ্যভ‚মি।

১৩ এপ্রিল বেলা ১০টার পর খবর আসে পাকবাহিনী নাটোর থেকে রাজশাহীর দিকে আসে। পথে তারা মোক্তারপুর ট্রাফিক মোড় ও সারদা বাজারে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে বাধাগ্রস্ত হয় এবং আধা ঘণ্টা গুলিবিনিময় হয়। এতে শহিদ হন ইউসুফ, দিদারসহ বেশ অনেকজন।

পাকবাহিনী পুলিশ একাডেমির দখল নেয়ার পর শুরু হয় গণহত্যা। তারা পুলিশ একাডেমির ভেতর ঢুকে পদ্মার চারপাশে ঘেরাও করে। তারা নারী ও শিশুদের এক দলে ভাগ করে এবং সব পুরুষকে আরেকটি দলে ভাগ করে। এর পরই তারা ব্রাশফায়ারের মাধ্যমে গণহত্যা শুরু করে। চাটখিল গণহত্যায় প্রায় ২০০ মানুষ নিহত এবং আরও শতাধিক মানুষ আহত হন।

গোলাহাট গণহত্যা :  ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল গোলাহাট গণহত্যা সংঘটিত হয়। এই গণহত্যায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের অবাঙালি বিহারি ও বাঙালি সহযোগীরা সম্মিলিতভাবে ৪৪৭ জন হিন্দু মারোয়াড়িকে হত্যা করে।

হরিপুর গণহত্যা: ১৩ এপ্রিল ১৯৭১। পাকিস্তানি বাহিনী ক্ষিপ্ত হয়ে ফজরের নামাজের পূর্বেই রাজশাহী-নবাবগঞ্জ রোডের দক্ষিণ পাশে রাজশাহী কোর্ট থেকে গোদাগাড়ী উপজেলার ফরহাদপুর গ্রাম পর্যন্ত ঘিরে ফেলে। পাকিস্তানি বাহিনী ফজরের আজান হওয়ার সময় গ্রামের বাড়িঘরে আগুন দেয় এবং গুলি করতে শুরু করে। তাদের গুলি থেকে নারী, পুরুষ এমনকি গবাদি পশু পর্যন্তও রেহাই পায়নি।

১৩ নভেম্বর হরিপুর ইউনিয়নের ১৪৫ জনের বেশি লোককে কয়েক স্থানে জড়ো করে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। হরিপুর ইউনিয়নের অসংখ্য নারীকে নির্যাতন ও ধর্ষণ করে পাকিস্তানি নরপশুরা। গণহত্যার শিকার এসব মানুষের মধ্যে বেলুয়া খোলা মসজিদে তাবলীগ জামাতে আগত অন্য স্থানের লোকও ছিল। এছাড়া পাকিস্তানি বাহিনী স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় অন্যান্য স্থান থেকে লোকজন ধরে এনে এখানে হত্যা করে।

রংপুর গণহত্যা: ১৫ এপ্রিল ১৯৭১। সেদিন সকাল নয়টার দিকে দুই গাড় মিলিটারি খুলনার ডুমুরিয়ার রংপুর গ্রামের পাশে শেলুয়া বাজারে আসে। সেখানে নেমে ২০ জন পানসেনারা পায়ে হেঁটে রংপুর গ্রামে প্রবেশ করে। তারা রংপুর কালিবাটি উচ্চ ইংরেজি স্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রফুল্ল কুমার বিশ্বাসকে খোঁজ করে।  প্রফুল্ল কুমার ছিলেন এলাকার গুণীজন ও সর্বজন শ্রদ্ধেয়। তিনি তখন বাড়িতেই ছিলেন। পাকসেনারা তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। হত্যাকারীরা পরে কয়েকটি গ্রামে  আগুন ধরিয়ে দেয়।

সরোজগঞ্জ বাজার গণহত্যা :  ১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল । সেদিন সকালে চুয়াডাঙ্গা শহরের পাকিস্তান সেনারা বিমান হামলা চালিয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে। সেদিন দুপুরে পাকসেনাদের লক্ষ্য ছিল চুয়াডাঙ্গা দখল করা। পথিমধ্যে সরোজখান বাজারের মোড়ে এসে থেমে যায় ও  বাজারের মানুষজনদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন ও ব্যাপক গুলিবর্ষণ করে। পাক বাহিনী বাজারের লোকজনদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে একে একে হত্যা করে। ওই দিন আনুমানিক ৭০ থেকে ১০০ জন সেদিন নিহত হয়।  

চৌকিরপাড় গণহত্যা: পাক হানাদার বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পায়নি নাটোরের চৌকিরপাড় মহল্লাটিও। ১৯ এপ্রিল পাকিস্তান বাহিনী এখানে  স্থানীয় ও আশ্রিত ৪০/৫০ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। পাকিস্তানি বাহিনী ১২ এপ্রিল নাটোরে প্রবেশ করে। ১৯ এপ্রিল গভীর রাতে পাকসেনারা চৌকিরপাড়ে গণহত্যা চালায়। পাকসেনারা খবর পেয়েছিল  চৌকিরপাড়ে কানাইলাল বাগচিদের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা আশ্রয় নিয়েছে। তারা বাগচীবাড়িতে অতর্কিত হামলা করে। মুক্তিযোদ্ধারা উপায়ন্তর না পেয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়। এ সময় খান সেনারা যাকে পেয়েছে তাকে হত্যা করে। এক সময় তারা পুরো পঞ্চগড় শহর জ্বালিয়ে দেয়। খানসেনাদের মর্টারসেল ও গুলিতে নিহত হয় ৭ জন । পাকিস্তান বাহিনী ডাক বাংলোতে স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপনের পরে সেখানে মওলানা ইদ্রিস আলিকে ধরে এনে নির্যাতন ও হত্যা করে।

পঞ্চগড় জেলা পরিষদ ডাকবাংলো গণহত্যা : ১৯ এপ্রিল ১৯৭১। সকাল ১০টার দিকে পাকিস্তান বাহিনী পঞ্চগড় আক্রমণ করে গণহত্যা নির্যাতন ও ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে ত্রাশের রাজত্ব কায়েম করে। তারা করোতোয়া নদীর পশ্চিমপাড় ধাক্কামারা সি এন্ড বি, যতন পুকুরি, মীরগড়, রেলস্টেশন পুরাতন পঞ্চগড়,  এম আর সরকারি কলেজ আক্রমণ করে  এবং বানাড়িপাড়া জালাসি, আসলামবাগ ও মিঠাপুকুর অঞ্চলেও গণহত্যা  পরিচালনা  করে।  

তারাপুর চা-বাগান গণহত্যা:  ১৮ এপ্রিল ১৯৭১।  এদিন পাকবাহিনী সিলেট শহরের কাছে তারাপুর চা-বাগানে গণহত্যা চালায়। তারা  চা-বাগানের মালিক পুরুষ ও চা-শ্রমিকসহ প্রায় ৪০-৫০ জনকে নৃশংসভাবে  হত্যা করে। তারাপুর মালিক ও শ্রমিকদের ভিন্ন দুটি বধ্যভ‚মিতে হত্যা করা হয়। 

 ১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর

গণমাধ্যমকর্মী

salma15august@gmail.com

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০