কাজী সালমা সুলতানা: তারাকান্দা গণহত্যা: ১৯৭১ সালের ২ জুন গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া কান্দি ইউনিয়নের তারাকান্দা গ্রামে গণহত্যা সংঘটিত হয়। এদিন কোটালীপাড়া থানা থেকে ১১ পাকিস্তানি সেনা গোপালপুর আসে। সেখানে তাদের জন্য পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়ে অপেক্ষা করছিল স্থানীয় দোসর রাজাকাররা। তারা প্রস্তুতি নেয় তারাকান্দর আক্রমণের। তারাকান্দরের লোকজন তখন মর্টার বা মেশিনগানের শক্তির ব্যাপারে ছিল একদম অজ্ঞ। তারপরও তারা ঢাল-সড়কি নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে প্রস্তুতি নেয়। পাক সেনারা ভারী মেশিনগানের গুলি ও মর্টার শেল ছুড়তে থাকে তারাকান্দরের দিকে। পাকিস্তানি বাহিনীর ভারী অস্ত্রের সামনে আর টিকতে না পেরে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এই সুযোগে স্থানীয় রাজাকার ও আলবদররা পাকিস্তানি বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে ঢুকে পড়ে তারাকান্দর গ্রামে। প্রতিরোধকারী যোদ্ধাদের ফেলে আসা রামদা, কুড়াল ও বল্লম দিয়ে শতাধিক মানুষকে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা। বেলা ১১টায় শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে এই হত্যাযজ্ঞ। এতে শহিদ হন প্রায় দুই শতাধিক নারী-পুরুষ, শিশু ও বৃদ্ধ।
জাফরগঞ্জ গণহত্যা: রংপুর-পাগলাপীর রাস্তার পাশে জাফরগঞ্জের ঘাঘট নদীর ওপর ব্রিজ। ১০ জুন এখানেই চালানো হয় বর্বর হত্যাযজ্ঞ, যা ‘জাফরগঞ্জ ব্রিজ গণহত্যা’ হিসেবে খ্যাত। ৮ জুন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা রংপুর রেডিও স্টেশনের সামনে গ্রেনেড বিস্ফোরণ করে। পরের দিন ৯ জুন ওরিয়েন্টাল সিনেমা হলের সামনেও গ্রেনেড হামলা পরিচালনা করে। এই দুই ঘটনার পর পাক হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। তারা সাধারণ মানুষদের গণহারে গ্রেপ্তার করতে থাকে। ঘটনাস্থল রেডিও স্টেশনের আশপাশের এলাকা থেকে অসংখ্য মানুষকে ধরে নিয়ে যায় হানাদারেরা। ক্যান্টনমেন্টে তাদের ওপরে চলতে থাকে অমানুষিক নির্যাতন। প্রাণভয়ে অনেকেই ওই এলাকা ত্যাগ করে। ১০ জুন মধ্যরাতে পাকসেনারা রংপুর-সৈয়দপুর মহাসড়কের জাফরগঞ্জ ব্রিজের কাছে ২৪ জনকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে লাশগুলো ফেলে দেয় ব্রিজের নিচে। সেদিন সেখানে তাদের দাফনের জন্য কোনো মানুষ ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের পুরো ৯ মাস ধরেই ওই ব্রিজের নিচে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করে লাশ ফেলে রাখে পাক সেনারা।
গোলাহাট গণহত্যা: ১৩ জুন নীলফামারী জেলার অবাঙালি অধ্যুষিত সৈয়দপুর শহরতলির গোলাহাটে এক ভয়াবহ গণহত্যা সংঘটিত হয়, যাকে অপারেশন খরচখাতা বলে অভিহিত করা হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের সহযোগী বিহারি ও বাঙালি রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী ৪৪৮ হিন্দু মাড়োয়ারি ও নারী শিশুদের পরিকল্পনা করে হত্যা করে।
১ জুন বিহারি সম্প্রদায় নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর পৌরসভার বিভিন্ন এলাকা, বিশেষ করে মারোয়ারি পট্টি থেকে ১৮৫ মারোয়ারিকে বন্দি করে সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। সেখানে ছোট ছোট কুঠরিতে কদিন রাখার পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মেজর গুলের নির্দেশে তাদের সৈয়দপুর বিমানবন্দরের সংস্কার এবং মাটি কাটার কাজে লাগিয়ে নির্যাতন চালানো হয়।
১২ জুন ট্রেনযোগে সীমান্ত-সংলগ্ন হলদিবাড়ী স্টেশনে নিয়ে গিয়ে ভারতে পাঠিয়ে দেয়া হবে বলে পাকিস্তানি মেজর গুল আটককৃতদের জানায় এবং তাদের ছেড়ে দেয়। এ সময় আটককৃতরা কিছুটা ‘শঙ্কিত চিত্তে’ তাদের বাড়ি যান। অল্প সময়ের মধ্যেই বাড়ি থেকে স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, শিশুসন্তানসহ সবাইকে নিয়ে তারা ৪৪৮ জনাধিক রেলস্টেশনে ফেরেন।
১৯৭১ সালের ১৩ জুন, ভোর ৫টায় সৈয়দপুর রেলস্টেশনে ট্রেনের প্রথম দুটি বগিতে পুরুষদের তোলা হয় এবং পরের দুই বগিতে নারী ও শিশুদের তোলা হয়। ট্রেনটি ভারতের শিলিগুড়ির উদ্দেশে যাওয়ার কথা। ট্রেনটি গোলাহাট রেলকারখানার শেষ মাথায় হঠাৎ করে থেমে যায়। সেখানে বিহারি কাইয়ুম খান, ইজাহার আহমেদ ও তাদের সহযোগীদের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও সশস্ত্র রাজাকারদের একটি দল গোলাহাটের কাছে অপেক্ষা করছিল।
ট্রেনটি থামার সঙ্গে সঙ্গে তরবারি দিয়ে তাদের মাথা বিচ্ছিন্ন করে গণহত্যা শুরু করে। এরপর তারা সামনে যাকে পায় তাকে ধরে রামদা দিয়ে কোপাতে থাকে। এই চিত্র দেখে তপন কুমার প্রথমে ট্রেন থেকে লাফ দিয়ে পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু পাকিস্তানি সেনারা তাকে ধরে ফেলে। তখন তপন সৈন্যদের ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে যায়। এরপর পাকিস্তানি সৈন্যরা যাত্রীদের কিল-ঘুষি-লাথি মেরে ট্রেন থেকে নামাতে থাকে এবং ট্রেনের যাত্রীদের ধারাল অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে হত্যা করে। যাত্রীদের অনেকে ধারাল অস্ত্রের আঘাত সইতে না পেরে গুলি করে মারার জন্য অনুরোধ করে। পাকিস্তানি সেনাদের জবাব ছিল গুলির অনেক দাম। একে একে বগি থেকে নামিয়ে তলোয়ার দিয়ে তাদের মাথা কাটতে শুরু করে।
ট্রেনের দ্বিতীয় বগি থেকে ৫০ জনের মতো ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়ার পর ২৩ জনের মতো বেঁচে যান। বাকি সবাইকে পাকিস্তানি সেনারা ট্রেন থেকে নামিয়ে বিহারিদের সহযোগিতায় ধারাল অস্ত্র দিয়ে হত্যা করে। তারা শিশুদের আকাশে ছুড়ে তরবারির সঙ্গে বেঁধে দিয়ে দ্বিখণ্ডিত করে হত্যা করে। তারা অনেক শিশুর এক পা ধরে অন্য পা টেনে ছিঁড়ে ফেলে হত্যা করে। ওই দিনের গণহত্যায় ৪৪৮ জন শহিদ হন।
আদিত্যপুর গণহত্যা: ১৪ জুন তৎকালীন সিলেট জেলার বালাগঞ্জ ইউনিয়নের আদিত্যপুর গ্রামের হিন্দুদের গণহত্যা করা হয়। এদিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের সহযোগিতায় তারা ৬৩ বাঙালি হিন্দুকে হত্যা করে।
১৯৭১ সালের ১৪ জুন সূর্যোদয়ের দুই ঘণ্টা আগে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ২৫ থেকে ৩০ সৈন্যের একটি দল চারটি ট্যাংকে করে আদিত্যপুর গ্রামে এসে পৌঁছায়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীরা স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় মাত্র আধা ঘণ্টার মধ্যে ভিতরপুরো গ্রাম বেষ্টন করে ফেলে। এ সময় পাকিস্তানি বাহিনীর দালাল মুসলিম লীগের কর্মী আবদুল আহাদ চৌধুরী (ছাদ মিয়া), মসরু মিয়াসহ কয়েকজন গ্রামে এসে জানায় সবাইকে নিয়ে স্কুলমাঠে বৈঠক হবে। তারা লাউডস্পিকারের সাহায্যে ঘোষণা দেয়, শান্তি কমিটির স্থানীয় শাখা গঠন করতে এবং সংখ্যালঘু হিন্দুদের ড্যান্ডি কার্ড বিতরণ করতে তারা এসেছে। তারপরও তাদের কথায় আস্থা রাখতে পারেনি সাধারণ গ্রামবাসী। ভয়ে তারা লুকিয়ে পড়ল খাটের নিচে, কেউবা বাড়ির পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে এবং গ্রামের পেছনের হাওরে।
রাজাকাররা রিফাতপুর, আদিত্যপুর, সত্যপুর ও নারায়ণপুর গ্রাম তছনছ করে পুরুষদের ধরে এনে আদিত্যপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে জড়ো করে। শান্তি কমিটি গঠনকে প্রহসনে পরিণত করে তারা ৬৫ পুরুষকে রশি দিয়ে বেঁধে লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে। মুহূর্তেই শহিদ হন ৬৩ জন। শরীরে গুলি নিয়ে মৃতের ভান করে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান শিবপ্রসাদ সেন কঙ্কন ও সুকময় বাবু।
প্রতিটা পরিবারের পুরুষ যখন মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল, সেসময় রাজাকার ও পাকবাহিনীর হাত থেকে সম্ভ্রম বাঁচাতে গ্রামের মহিলারা পালানোর সুযোগ খুঁজছিল। কিন্তু রাজাকারদের কবলে পড়ে প্রায় ২০ মহিলা নির্যাতনের শিকার হয়। এরপর পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা প্রতিটা বাড়িতে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ চালায়। কিছুদিন পরে লাশের পচা গন্ধে ভারী হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। হত্যাযজ্ঞ আড়াল করতে ১৭ জুন বৃহস্পতিবার রাজাকাররা আবার আসে আদিত্যপুর গ্রামে। গর্ত খুঁড়ে বিদ্যালয় মাঠে লাশগুলো মাটিচাপা দেয়।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এমএজি ওসমানীর উপস্থিতিতে মাটি খুঁড়ে লাশ বের করা হয়। তারপর পোস্টমর্টেমের জন্য পাঠানো হয় সিলেট সদর হাসপাতালে। সেখানে দেশি ও আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের সামনে লাশের সংখ্যা গণনা করা হয়। তারপর লাশগুলো আবার আদিত্যপুর এনে বর্তমান গণকবরে সমাহিত করা হয়।
জগদীশপুর গণহত্যা: ১৭ জুন সকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দালালদের সহায়তায় ঝালকাঠির জগদীশপুর, খাজুরা, রামপুর, মিরাখালি ও বেতরা গ্রামে গণহত্যা সংঘটিত হয়। এদিন তারা পেয়ারা বাগানে আশ্রয় নেয়া হিন্দুধর্মাবলম্বীদের আটক করে তাদের ওপর নির্যাতন করে। পরে জগদীশপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠের পাশে এনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে ৬০ গ্রামবাসীকে হত্যা করা হয়। (চলবে)
গণমাধ্যমকর্মী