Print Date & Time : 21 June 2025 Saturday 2:48 pm

১৯৭১ গণহত্যা: জুলাই

কাজী সালমা সুলতানা: ১৯৭১ সালের ১৮ জুলাই ময়মনসিংহের ভালুকার মল্লিকবাড়ি ভাণ্ডাব গ্রামে ৩৪ নিরীহ গ্রামবাসীকে পাক হানাদারেরা ঘর থেকে বের করে এনে নৃশংসভাবে হত্যা করে। তারা অসংখ্য ঘরবাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় এবং ধনসম্পদ লুট করে। একই উপজেলার বিরুনিয়া ইউনিয়নের কংসের কুল গ্রামে হামলা চালিয়ে নরঘাতকরা আরও ১১ জনকে হত্যা করে এবং অনেক বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে ধনসম্পদ লুট করে।

সোহাগপুর গণহত্যা: ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী থানার সোহাগপুর গ্রামে নৃশংস গণহত্যা সংঘটিত হয়। এদিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী স্থানীয় রাজাকার ও আল বদরদের সহায়তা নিয়ে সোহাগপুর গ্রামের ১৮৭ পুরুষকে গুলি করে হত্যা করে। এছাড়া তারা অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও নারীদের ওপরও নির্মম নির্যাতন করে। ফলে গ্রামটি সম্পূর্ণ পুরুষশূন্য হয়ে পড়ে।

১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই আল বদরের মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও রাজাকার কাদির ডাক্তার পাকসেনাদের নিয়ে গ্রামটিকে ঘিরে ফেলে। সকাল ৭টা থেকে তারা গ্রামে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। মাত্র দুই ঘণ্টার মধ্যে তারা ১৮৭ গ্রামবাসীকে হত্যা করে।

পাক হানাদারেরা ১২ ঘণ্টা ধরে সোহাগপুর গ্রামে মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের খুঁজতে থাকে। তারা প্রথমে সাত গ্রামবাসীকে হত্যা করে। তাদের মধ্যে দুই ব্যক্তি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। ওই তিনজন গাড়ো কৃষক ছিলেন।

তারা গ্রামের নারীদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে। পাক সেনারা গ্রাম থেকে চলে যাওয়ার পর পালিয়ে আসা গ্রামবাসীরা ফিরে আসে। পাকসেনাদের এই নির্মম গণহত্যার পর এই গ্রামে কোনো পুরুষ জীবিত ছিল না।

রাজাকার ও আল বদর বাহিনী তখন গণহত্যায় নিহত ব্যক্তিদের ‘কাফের’ ঘোষণা করে এবং তাদের লাশ দাফন নিষিদ্ধ করে। তাই তখন অনেক মৃতদেহ বন্য প্রাণী খেয়ে ফেলে। তবে কেউ কেউ স্বজনদের লাশ দাফন করতে সক্ষম হয়।

গণহত্যার ৫০ বছর পর জালাল উদ্দিন এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘সে সময়কার নির্মমতা ও ভয়াবহতার কথা বলতে গেলে আমার শরীরের লোমগুলো দাঁড়িয়ে যায়। পাকবাহিনী এলাকায় প্রবেশ করে অনবরত গুলি করতে থাকে। তারা আমার বাবা, ভাইসহ সবাইকে হত্যা করে। আমি দৌড়ে ঘরের মাচার মধ্যে লুকিয়ে নিজেকে রক্ষা করি। সোহাগপুরের কোনো পুরুষ বেঁচে ছিল না, আমি ছাড়া। তাই আমাকেই লাশগুলো একত্র করে মাটিচাপা দিতে হয়েছে। জানাজা করার মতো লোক ছিল না।’

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর সোহাগপুর গ্রামের নাম হয় ‘বিধবাপাড়া’। পরে ‘বিধাবাপাড়া’র নাম পরিবর্তন করে ‘বিধবাপল্লি’ রাখা হয়।

২০২২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি সোহাগপুর গণহত্যা স্মরণে এই গ্রামে সৌরজায়া নামে একটি স্মৃতিসৌধ স্থাপন করা হয়।

সোহাগপুর গ্রামের গণহত্যার নির্দেশদাতা ছিল আল বদর বাহিনীর জেলা কমান্ডার কামারুজ্জামান। সোহাগপুর গণহত্যায় তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদতের কথা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল তাকে ফাঁসির দণ্ড প্রদান করে। ১৯১৫ সালের ৬ মে কামারুজ্জামানের ফাঁসির দণ্ড কার্যকর করা হয়।

বিলমাড়ীয়া বাজার গণহত্যা: ১৯৭১ সালের ২৭ জুলাই পাক হানাদাররা নাটোর জেলার লালপুর উপজেলার বিলমাড়িয়া গণহত্যা সংঘটিত করে।

২৭ জুলাই ছিল বিলমাড়িয়া হাটের দিন। এদিন হাটে মৌলভী জামাউদ্দীনের পথপ্রদর্শনে দুই গাড়ি পাক হানাদার বিল মাড়িয়া হাটে আসে। সেইসঙ্গে আরও কিছু হানাদার সাধারণ পোশাকে হাটে আসে। তাদের কাছে অস্ত্রগুলো কাপড় দিয়ে মোড়ানো ছিল। হঠাৎ তারা এলোপাতাড়ি গুলি করতে শুরু করে। এতে ঘটনাস্থলেই গুলিবিদ্ধ হয়ে অনেকের মৃত্যু হয়। পদ্মার পাড়ে দোকানের পেছনে ক্ষেতের আইলে বিক্ষিপ্তভাবে শহিদদের মৃতদেহ দেখা যায়।

যারা পাক হায়নাদের হাত থেকে জীবন বাঁচাতে পলায়ন করতে বিভিন্ন স্থানে লুকায়, তাদের ধরতে পাক হানাদাররা ছুটতে থাকে। তাদের সহায়তা করে এদেশের স্থানীয় শান্তি কমিটির সদস্যরা।

সেদিন বিকাল ৫টা পর্যন্ত তল্লাশি চালিয়ে পাক সেনারা বহু নিরপরাধ মানুষকে একত্র করে নিষ্ঠুর অত্যাচার ও জিজ্ঞাসাবাদ করে। কিন্তু কোনো তথ্য না পাওয়ায় তাদের সবাইকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে।

পড়ে থাকা মৃতদেহগুলোর কোনো সুরাহা সেদিন হয়নি। শহিদদের আত্মীয়স্বজন যারা বিলবাড়িয়া ও আশেপাশের এলাকায় ছিল, তারা তারা মৃতদেহ সংগ্রহ করে দাফনকাফনের ব্যবস্থা করে। বাকিদের মৃতদেহ খোলা আকাশের নিচে পড়ে থাকে। এসব মৃতদেহ গলে-পচে কঙ্কালে পরিণত হয়।

পাক হায়নারা সেদিন শুধু হাটে আগত মানুষ হত্যা করেনি, আসার সময় তারা রাস্তা থেকে নিরপরাধ মানুষকে জোর করে তাদের গাড়িতে তোলে এবং বিলমাড়ীয়া হাটে নিয়ে এনে গুলি করে হত্যা করে।

২৮ জুলাই পাক সেনারা আবার বিলবাড়িয়ায় আসে। সেনারা আসার পথে নিরীহ সাত-আটজনকে ধরে নিয়ে আসে। সেদিন বিলবাড়িয়া বাজার ছিল জনশূন্য। দুর্ভাগ্যক্রমে বাথানবাড়িয়া গ্রামের জমসেদ আলী বাজারে এলে হানাদারদের হাতে ধরা পড়েন। আটক ৯ জনের ওপর নিষ্ঠুরভাবে অত্যাচার চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য আদায়ের চেষ্টা করা হয়। ব্যর্থ হলে তাদেরকেও পাকসেনারা গুলি করে হত্যা করে। এই নির্মম হত্যাযজ্ঞ করার পর হানাদারেরা যাওয়ার সময় আশেপাশের ঘরবাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দেয়।

দুদিন পরপর পাকিস্তান সেনাদের উপস্থিতি ও গণহত্যা সারা এলাকার মানুষের মধ্যে চরম ভীতির সৃষ্টি করে। এমন পরিস্থিতিতে শহিদদের মৃতদেহ নিতে কেউ বিলবাড়িয়া আসেনি। মৃতদেহগুলো খোলা আকাশের নিচে দিনের পর দিন পড়ে থাকে। লাশগুলো পচে যায় এবং শকুন-শেয়াল-কুকুরের খাবারে পরিণত হয়।

প্রত্যক্ষদর্শী নুরুল ইসলামের তথ্য অনুসারে এই গণহত্যায় শতাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়।

১৯৭১ সালের ৩১ জুলাই পাক হানাদার ও তাদের সহযোগীরা ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার পয়ারী গ্রামের চৌধুরীবাড়ির নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করে। পরবর্তী সময়ে তারা ওই বাড়ির ১০ জনকে গুলি করে হত্যা করে এবং একজনকে আহত করে। একই দিনে পয়ারী ইউনিয়নের স্বাধীনতার পক্ষে শিক্ষক, কৃষকসহ ১৫ জনকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে সরচাপুর কংস নদের পাড়ের বধ্যভূমিতে গণহত্যা চালায়।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তার দোসররা যে গণহত্যা চালিয়েছিল, তা ইতিহাসের নির্মম ঘটনা। এদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমন অসংখ্য নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, যার ভয়াবহতা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকেও হার মানায়। স্বাধীনতার ৫০ বছরে দাঁড়িয়ে বাঙালির স্বাধীনতার যুদ্ধে আমরা যাদের হারিয়েছি, সেই ৩০ লাখ শহিদের আত্মত্যাগ আমরা যেন ভুলে না যাই। আরও যেসব নারী-শিশু তাদের জীবন ও সম্ভ্রম হারিয়েছেন, সেই পাঁচ লক্ষাধিক নারীকে আমরা যেন শ্রদ্ধা জানাতে ভুলে না যাই। তাদের ত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ। তাদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ও সম্মান চিরজাগ্রত থাকুক।

সুত্র: গণহত্যা, নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র

গণমাধ্যমকর্মী

salma15august@gmail.com