কাজী সালমা সুলতানা: ২৫ মার্চ ১৯৭১। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালির স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা নস্যাত করতে ঢাকা শহরে রাতের আঁধারে অপারেশন সার্চ লাইটের নামে নারকীয় হত্যাকাণ্ড চালায়। এর ধারাবাহিকতায় সারা দেশে নজিরবিহীন গণহত্যা, বাড়িঘর, দোকানপাট জ্বালিয়ে দেয়াসহ ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত করে। অপারেশন সার্চ লাইটের মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে নির্মূল করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। গোটা দেশব্যাপী এই হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, আগুন দিয়ে বাড়িঘর, দোকানপাট, হাটবাজার জ্বালিয়ে দেয়ার মতো নারকীয়তা চলে নয় মাসব্যাপী। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে নয় মাসে ৩০ লাখের অধিক মানুষ শহিদ হয়। এখন সন্ধান পাওয়া গেছে পাঁচ হাজারের অধিক বধ্যভূমি। এর মধ্যে এক হাজার বধ্যভূমি সঠিকভাবে চিহ্নিত হয়েছে।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আল-শামস বাহিনী এদেশের মানুষকে চিরতরে নিঃশেষ করার যে বরবরতা দেখিয়েছে, তা বিশ্বের ইতিহাসে দ্বিতীয়টি নেই। হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরদের পশুবৃত্তির শিকার হয়ে প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক মা-বোন সম্ভ্রম হারায়। নির্বিচারে মানুষ হত্যার জঘন্যতা থেকে নারী ও শিশুরাও রেহাই পায়নি। হানাদার বাহিনীর হত্যার শিকার হওয়া মানুষকে গণকবর দিতে হয়েছে সেখানেই। তাদের এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী হয়ে রয়েছে দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য বধ্যভূমি ও গণকবর। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে যে হত্যাকাণ্ডগুলো সংঘটিত হয়-
ছোট বোয়ালিয়া, জয়ন্তীনগর, বসন্তপুর গণহত্যা : ১৯৭১ সালের ১ জুলাই ঝিনাইদহ জেলার শৈলকূপা উপজেলার ছোট বোয়ালিয়া, জয়ন্তীনগর, বসন্তপুর নৃশংস গণহত্যা সংঘটিত হয়। এই গণহত্যার শিকার হয় স্থানীয় নিরীহ মানুষ ও জীবন বাঁচানোর জন্য বাড়িঘর ছেড়ে আশ্রয় নেয় শরণার্থী শিবিরে।
ছোট বোয়ালিয়া, জয়ন্তীনগর, বসন্তপুর পাশাপাশি তিনটি গ্রাম। সেদিন ভোর না হতেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার বাহিনী এই গ্রাম তিনটি তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে। এরপর নির্বিচারে গণহত্যা চালায়। ছোট বোয়ালিয়া, জয়ন্তীনগর, বসন্তপুরÑএই গণহত্যায় ২০ জন স্থানীয় নিরীহ মানুষ ও শরণার্থীদের হত্যা করা হয়।
ঝিনাইদহের নূরুন্নবী ছামদানী ও তৎকালীন বসন্তপুরের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মৌলভী শিক্ষক মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনী সেদিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে এই হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে। এছাড়া শেখপাড়া গ্রামের রাজাকার শের আলী, সাবেক চরপাড়া গ্রামের মঈনউদ্দীন খাঁন, খন্দকবাড়িয়া গ্রামের সিরাজউদ্দিন, হরিণাকুণ্ড গ্রামের তৎকালীন ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতা ডা. এম এ ওহাব এই গণহত্যায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। গণহত্যা চালানোর সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকারেরা ঘরবাড়িতে হামলা করে অর্থকড়ি, টাকা-পয়সা ও ধনসম্পদ লুট করে নেয়।
এদিন মুক্তিযোদ্ধাদের সন্দেহে পাক হানাদার ও রাজাকারেরা এলাকার সাধারণ মানুষকে ধরে নিয়ে যায় ও তাদের ওপর অত্যাচার, নির্যাতন-নিপীড়ন ও হত্যা করে। এরপর তারা ঝিনাইদহের ক্যাডেট কলেজ ক্যাম্পে মো. আত্তাফ মোল্লা, মো. হাফেজ মোল্লা এবং মো. শাহজাহান মোল্লাকে মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে ধরে নিয়ে যায়। ছোট বোয়ালিয়া, জয়ন্তীনগর, বসন্তপুর গ্রামে পাকিস্তানি হানাদারেরা ব্যাপক গণহত্যা চালায়।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এদিন কত মানুষকে হত্যা করেছিল তার সঠিক পরিসংখ্যান জানা যায়নি। তবে মাত্র ১২ জন শহিদের সন্ধান পাওয়া যায়। বাকি শহিদদের সন্ধান মেলেনি।
নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড ঘটায়Ñ প্রাণ বাঁচাতে অনেকেই দিকবিদিক ছোটাছুটি করে। এ সময়ও হানাদার বাহিনী পলায়নপর মানুষের ওপরও গুলি চালায়। ফলে এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত পরিসংখ্যান আজও অজ্ঞাত। ছোট বোয়ালিয়া, জয়ন্তীনগর, বসন্তপুর হত্যাযজ্ঞের পরিসংখ্যান করা গেলেও বালিয়াঘাট বা আশপাশের গ্রামের গ্রামের অনেক লাশ নদীর পাড়ে পুঁতে ফেলা হয় এবং অনেক লাশ আত্মীয়স্বজন নিয়ে যায়।
কাটাখালী গণহত্যা: ১৯৭১ সালের ৬ জুলাই শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার রাঙামাটিয়া খাঠুয়াপাড়া গ্রামে বর্বরোচিত গণহত্যা চালায় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার ও আল-বদর বাহিনী। এদিন মুক্তিযুদ্ধের কোম্পানি কমান্ডার নাজমুল আহসান, মুক্তিযোদ্ধা আলী হোসেন, মোফাজ্জল হোসেনসহ ১২ জন শহিদ হন।
এদিন ভোরে কোম্পানি কমান্ডার নাজমুল আহসানের নেতৃত্বে ৫৩ জনের মুক্তিযোদ্ধার দল অবস্থান নেন মালিঝি ইউনিয়নের রাঙামাটিয়া গ্রামে আতর আলীর বাড়িতে। ৫ জুলাই রাতে সফলতার সঙ্গে অপারেশন শেষ করে মুক্তিযোদ্ধারা দু’টি দলে বিভক্ত হয়ে আশ্রয় নেয় খাটুয়াপাড়ার হাজী নঈমদ্দিন ও হাজী শুকুর মামুনদের বাড়িতে। বাড়ির চারপাশে ছিল প্রশস্ত বিল। মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান টের পেয়ে এলাকার রাজাকার জালালউদ্দিন মিস্ত্রি তার ছোট ভাই হক আলী শেরপুরের তৎকালীন ছাত্রসংঘের নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানসহ ঝিনাইগাতী আহম্মদ নগর পাকিস্তানি ক্যাম্পে খবর দেয়।
৬ জুলাই সকালে কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই গ্রামে প্রবেশের একমাত্র কাঁচা সড়কের দু’দিক থেকে ব্যারিকেড দেয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকার-আলবদররা। খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা বিলের পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং আত্মরক্ষার্থে গুলি করতে করতে পিছু হটে। ওই সময় পাক-হানাদারদের বেপরোয়া গোলাবর্ষণে কোম্পানি কমান্ডার নাজমুল আহসান, তার চাচাত ভাই মোফাজ্জল হোসেন ও ভাতিজা আলী হোসেন শহিদ হন। বাকি মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান পেলেও বর্বরোচিত হামলার শিকার হন খাটুয়াপাড়া রাঙ্গামাটিয়া গ্রামের বাসিন্দারা। তাদের ৬০-৭০ জনকে কোমরে দড়ি বেঁধে লাঠিপেটা করতে করতে নিয়ে যাওয়া হয় খাটুয়াপাড়া সরকারি রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে। পাক-হানাদার বাহিনীর দল আগুন লাগিয়ে দেয় ওই এলাকার বাড়িঘরে। সেদিন অমানবিক নির্যাতন করে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয় গ্রামবাসী আয়াতুল্ল্যা, সামেছ মিস্ত্রি, মহেন্দ্র অধিকারী, আব্বাছ আলী, আমেজ উদ্দিন ও বাদশা আলীকে। পাকিস্তানি দালালদের বাধার মুখে সেদিন লাশও দাফন করতে পারেননি শহিদদের স্বজনরা।
তুলারামপুর গণহত্যা: ১৯৭১ সালের ১৭ জুলাই নড়াইল জেলার তুলারামপুর ইউনিয়নে গণহত্যা সংঘটিত হয়। তুলারামপুরের চাঁচড়া গ্রামটি ছিল তৎকালীন নড়াইল মহকুমার প্রবেশদ্বার। মুক্তিযুদ্ধকালে এই গ্রামে গড়ে উঠেছিল মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ক্যাম্প। চাঁচড়া গ্রামের অ্যাডভোকেট আফসার উদ্দীন আহমেদ ও আগরতলা মামলার অন্যতম অভিযুক্ত লে. কর্নেল মতিউর রহমানের তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠে এই ক্যাম্প। চাঁচড়া তুলারাম ছাড়াও পার্শ^বর্তী এলাকার স্বাধীনতাকামী তরুণ যুবারা এই ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেয়।
মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা তুলারামপুরে অবস্থান করে বিভিন্ন অপারেশনের পরিকল্পনা করত। ওই গ্রামের বাসিন্দারাও মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করত। তেমনি একটি পরিবার ছিল তরফদার পরিবার। এই পরিবারের সদস্যরা শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়ই দেয়নি, তারা যুদ্ধেও অংশ নিয়েছিল।
এই খবর স্থানীয় পিস কমিটির চেয়ারম্যান ও তার সহযোগীরা হানাদারদের কাছে পৌঁছে দেয়। ১৭ জুলাই ভোরে হানাদাররা তরফদার বাড়িতে যায়। তাদের সঙ্গে সোলায়মান মোল্ল্যা ও তার সহযোগীরাও ছিল। তারা তরফদার বাড়ি ও গ্রামের অন্যান্য বাড়ি থেকে ২৫-২৮ জনকে চোখ বেঁধে টেনেহিঁচড়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডে নিয়ে তিন দিন আটকে রেখে নির্মম অত্যাচার চালায়। তাদের মধ্য থেকে ৮ জন বাদে বাকিদের ছেড়ে দেয়া হয়।
সেদিন গণহত্যা গভীর রাতে মাওলানা সোলাইমানের নেতৃত্বে কয়েক ট্রাক মিলিটারি স্থানীয় রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে তুলারামপুর গ্রাম থেকে ২৫-২৮ জন মানুষকে ধরে নিয়ে নড়াইল ওয়াপদা ডাকবাংলোয় (বর্তমানে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড নামে পরিচিত) এনে তিন দিন নির্মম অত্যাচার চালায়। ২০ জুলাই ওই ৮ জনকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের উত্তর-পশ্চিম কোণে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাদের দিয়েই কবর খোঁড়ানো শেষে তাদের হাত-পা বেঁধে কবরে নামিয়ে গুলি করে জীবিত অবস্থায় মাটিচাপা দেয় হত্যাকারীরা এবং বাকিদের নির্যাতন করে ছেড়ে দেয়া হয়।
গণমাধ্যমকর্মী
salma15august@gmail.com