১৯৭১ গণহত্যা: মে

কাজী সালমা সুলতানা :১৯৭১-এর ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালির স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা বিনাশ করতে গোটা দেশজুড়ে নজিরবিহীন গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ সংগঠিত করে। এসব গণহত্যায় ৩০ লাখ মানুষ শহিদ হয়েছেন বলা হলেও বাস্তবে এই সংখ্যা ৩০ লাখেরও বেশি। এখন পর্যন্ত দেশে পাঁচ হাজারের অধিক বধ্যভ‚মির সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে এক হাজার বধ্যভূমি চিহ্নিত হয়েছে। দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য বধ্যভ‚মি ও গণকবর। ১৯৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন দীর্ঘ নয় মাস ধরেই পাকিস্তানি বাহিনীরা গণহত্যা সংগঠিত করে। ১৯৭১ সালের মে মাসে যে গণহত্যা সংঘটিত হয়

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বৃহত্তর সিলেটের বিভিন্ন চা বাগানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সদস্যরা নৃশংস গণহত্যা চালায়। ভাড়াউড়া চা বাগান, দেওরাছড়া চা বাগান, রাজঘাট চা বাগান, কালিঘাট চা বাগান, সুরমা চা বাগান, তেলিয়াপাড়া চা বাগান প্রভৃতি চা বাগানগুলোয় নারকীয় গণহত্যা চালায়।

ভাড়াউড়া চা বাগান গণহত্যা: ১৯৭১-এর ১ মে পাকিস্তানি সেনারা শ্রীমঙ্গলের ভাড়াউড়া চা বাগানের ৫২ জন চা শ্রমিককে হত্যা করে। ভাড়াউড়া চা বাগানের প্রাক্তন সর্দার জয়রাম হাজরা বলেন, পাকিস্তানি সেনারা এসে ‘চলো, তুমলোক কাজ করেগা’ (চলো, তোমরা কাজ করবে) বলে অনেক মানুষকে নিয়ে বটগাছের নিচে জড়ো করে। তারপর সে সময় নতুন উদ্বোধন হওয়া কালিবাড়ীর সামনে নিয়ে চা শ্রমিকদের গুলি করে হত্যা করে।

জান্দী গ্রাম গণহত্যা : ২১ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ফরিদপুর জেলায় প্রবেশ করে, ফরিদপুরের শ্রী-অঙ্গনে তারা ৮ জন সাধুকে হত্যা করে। ২ মে ’৭১ রাত ৩টার সময় রাজাকার শাহজাহান মাস্টার, এমদাদ কাজী, জৈনক হারুন মেম্বার ও টনিক সেনের ড্রাইভারসহ প্রায় শতাধিক পাকিস্তানি সেনা ভাঙ্গা উপজেলার তুজারপুর ইউনিয়নের জান্দী গ্রাম ঘিরে ফেলে। তারা  সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যকারী টনিক সেনকে গুলি ও বেয়নেট দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। ওইদিন তারা একসঙ্গে ১৮ জন ব্যক্তিকে বেঁধে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার ও পরে বেয়নেট দিয়ে কোপায়। এতে ১৭ জন ঘটনাস্থলেই নিহত হন। সেদিন জান্দী গ্রামে ৪১ জনের বেশি পুরুষকে হত্যা করে তারা। অনেক নারীকেও নির্যাতন করে। এরপর তারা মালামাল লুট করে ভাঙ্গা থানায় চলে যায়।

গাভা নরেরকাঠী গণহত্যা : ২ মে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দেশীয় সহযোগী রাজাকার বরিশালের গাভা নরেরকাঠী গ্রামে প্রায় ১০০ জন বাঙালি হিন্দুকে হত্যা করে। হত্যাকাণ্ডের পর  পাকিস্তানি সেনারা চলে যাওয়ার পর এলাকাবাসী সরকার বাড়ির পুকুর পাড়ে ২৮ জনের লাশ গণকবর দেয়।

৬ মে, তৎকালীন পিরোজপুর মহকুমার এসডিপিও কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমদের পিতা ফায়জুর রহমান আহমেদ, প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট ও দায়িত্বরত মহকুমা প্রশাসক সাইফ মিজানুর রহমানসহ একাধিক সরকারি কর্মকর্তাকে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা।

মুজাফফরাবাদ গণহত্যা: ১৯৭১ সালের ৩ মে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী স্থানীয় সহযোগীদের সহায়তায় বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার খারনা ইউনিয়নের অধীনে মুজফফারাবাদের মূলত হিন্দু গ্রামের বাসিন্দাদের ওপরে গণহত্যা সংগঠিত হয়। তারা পুরোহিতদের গুলি করে হত্যা করা হয়। সমাজসেবক নির্মল সেন, মোজাফফরাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক  ও তার ছেলেকেও তারা হত্যা করে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী চলে যাওয়ার পর স্থানীয় রাজাকাররা বাকি বাড়ি গুলি লুট করে। ৩ মে গণহত্যায় আনুমানিক ৩০০ বাঙালি  সেদিন গণহত্যার শিকার হয়। এই গণহত্যায় ৫ বছরের শিশু থেকে শুরু করে ৮০ বছরের বয়সী নারী-পুরুষ নিহত হয়। ৫ শতাধিক ঘর পুড়ে ছাই হয়ে যায়।

গোপালপুর গণহত্যা : ৫ মে নাটোর জেলার লালপুর উপজেলার গোপালপুর সদরে নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলে গণহত্যা সংঘটিত হয়। এই গণহত্যার শিকার হন উত্তরবঙ্গ চিনিকলে কর্মরত বাঙালিরা। এ ঘটনায় আনোয়ারুল আজিমসহ চিনিকলের ৪৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীও শহীদ হন। ১৯৭১ সালের ৫ মে সকালে হানাদার বাহিনী নাটোরের লালপুর উপজেলার গোপালপুর নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলে প্রবেশ করে। তারা সেখানে নিয়ন্ত্রণ নিয়েই প্রায় ২০০ চিনিকলের কর্মচারীকে জড়ো করে তাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। সে সময় মুক্তিযোদ্ধাদের নেতা অবসরপ্রাপ্ত লে. আনোয়ারুল আজিম সেনাবাহিনীর হাতে ধরা দেন এবং অনুরোধ করেন যেন নিরীহ লোকজনকে ছেড়ে দেয়া হয়। কিন্তু  সবাইকে অফিসার্স কোয়ার্টারের পুকুরঘাটে নিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ১৩টি মেশিনগানের গুলিতে হত্যা করা হয়। মুহূর্তের মধ্যে পুকুরঘাট লাশের স্ত‚পে পরিণত হয়। পরে লাশগুলোকে পুকুরের পানিতে ফেলে দেয় । পাকিস্তানি সেনারা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে আরও বহু মানুষকে এই পুকুর পাড়ে গুলি করে হত্যা করে।

কাতলামারী গণহত্যা : ৬ মে ’৭১ দিনাজপুর জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার খোশালপুর গ্রামের কাতলামারী গণহত্যায় সংঘটিত হয়। সেদিন সকাল ৭টার সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে ১০০ থেকে ১৫০ জন বিহারি ও জেলা  ফুলবাড়ী ও পার্বতীপুরের রামপুর গ্রাম ঘিরে ফেলে, তারা বাড়ি বাড়ি প্রবেশ করে যাকে পেয়েছে তারে ধরে মণ্ডল বাড়ির সামনে চৌরাস্তায় একত্র করে। এরপর তাদের নিয়ে এসে ওই গ্রামের মান্নান শেঠের বাড়িতে ঢুকায়। সবাইকে ঢুকানোর পর বাড়ির দরজা আটকে দেয় এবং হাতবোমা নিক্ষেপ করে। হাতবোমা বিস্ফোরিত না হওয়ায় তারা সবাইকে আবার ওই বাড়ি থেকে বের করে পরবর্তী সময়ে কাতলমারী গ্রামে নিয়ে গিয়ে  দুই লাইনে  দাঁড় করিয়ে স্টেনগানে গুলি করে হত্যা করে ও মেয়েদের আটকে রেখে নিষ্ঠুর নির্যাতন চালায়।

মির্জাপুর গণহত্যা: ৭ মে পাকিস্তান সেনাবাহিনী টাঙ্গাইল মির্জাপুরের বাজারটি ঘিরে ফেলে এবং ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। তারা সেদিন প্রায় ৬৯ জন বাঙালিকে হত্যা করে। পাকিস্তানি বাহিনী প্রথম গণহত্যা সংঘটিত করে মির্জাপুর ও আন্ধরা গ্রামে। পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের স্থানীয় দোসররা গণহত্যা চালিয়ে এশিয়া খ্যাত দানবীর কুমুদিনী হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা রণদা প্রসাদ সাহাসহ নিরপরাধ গ্রামবাসীকে হত্যা করে। প্রথমে তারা ব্যবসায়ী কমল সাহাকে গুলি করে হত্যা করে। পরে তারা ৩৫ জন নিরীহ বাঙালিকে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা। এরপর চলে অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ।

লাহিড়ীরহাট গণহত্যা : ৭ মে রংপুর শহরের লাহিড়ীরহাটে গণহত্যা চালায় পাকিস্তানি  হানাদার বাহিনী। সেদিন জুমার দিনে তারা সাতগাড়া ইউনিয়নের দামোদারপুর ও দেওডোবাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে ৩২ জন বাঙালিকে ধরে এনে লাহিড়ীরহাট পুকুরের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম পাড়ে গুলি করে হত্যা করে।

পাঁচগাঁও গণহত্যা : ৭ মে মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁও গ্রামে গণহত্যা সংঘটিত হয়। সেদিন  রাতে পাকিস্তানি বাহিনী একটি দল রাজাকার আলাউদ্দিন চৌধুরীর বাড়িতে আসে। ভোররাতে পাকিস্তান বাহিনীর ৫০-৬০ জন সদস্যের সঙ্গে স্থানীয় রাজাকাররা গ্রামটি ঘিরে ফেলে। তার গ্রামবাসীদের শান্তি কমিটির মিটিং আছে বলে হিরণ বাবুর বাড়ির পাশে জড়ো করে। এরপর  গ্রামবাসীকে একজনের মাথার সঙ্গে অন্যজনের পা বেঁধে লাথি মেরে পানিতে ফেলে দেয়া হয়। এরপর শুরু হয় নির্বিচারে গুলি। পাকিস্তানি বাহিনী চলে যাওয়ার পর পাশের গ্রামের মানুষ এসে দীঘির পানিতে জাল বেঁধে মৃতদেহগুলো উদ্ধার করে গণকবরে সমাহিত করে। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে পাঁচগ্রামের লোককে হত্যা করা হয়।

কানাইপুর সিকদারবাড়ি গণহত্যা : ৮ মে বিহারি ও রাজাকারদের একটি সশস্ত্র দল ফরিদপুর সদর উপজেলার কানাইপুর গ্রামে প্রবেশ করে গ্রামের সিকদারবাড়িসহ কয়েকটি বাড়িতে চড়াও হয়। তারা ১৮ জন গ্রামবাসীকে গলা কেটে হত্যা করে। এ নির্মম হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি চালানো হয় ব্যাপক লুটপাট।

গজারিয়া গণহত্যা : ৯ মে পাকিস্তানি বাহিনী মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় লোমহর্ষক হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ৩৬০ জন ছাত্র, জনতা, মুক্তিযোদ্ধা, বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এ এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের আস্তানা ও ট্রেনিং ক্যাম্প গড়ে ওঠে। স্বাধীনতাবিরোধীদের দোসররা এ খবর পাঠায় পাকিস্তানি সেনাদের কাছে। তিন দফা খবরের ভিত্তিতে এ বর্বরতম হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। সেদিন পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণে নিহত হন ৩৬০ জন। সেদিন এই বর্বরতা থেকে রেহাই পায়নি শিশুরাও। (চলবে)

গণমাধ্যমকর্মী

salma15august@gmail.com

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০