Print Date & Time : 18 June 2025 Wednesday 11:35 pm

১৯৭১ গণহত্যা: মে

কাজী সালমা সুলতানা

(গতকালের পর)সাতবাড়িয়া গণহত্যা: ১৯৭১ সালের ১২ মে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী পাবনার সুজানগরের সাতবাড়িয়া ইউনিয়নের কুড়িপাড়া, শ্যামনগর, নিশ্চিন্তপুর, কাচুরী, তারাবাড়ীয়া, ফকিৎপুর, সাতবাড়ীয়া, নারুহাটি, সিন্দুরপুর, হরিরামপুর, ভাটপাড়া, কন্দর্পপুর এবং গুপিনপুরসহ প্রায় ১৫-২০টি গ্রামে নিষ্ঠুর গণহত্যা চালায়। ওইদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত গ্রামের পর গ্রাম সশস্ত্র হামলা চালিয়ে প্রায় ৬০০ নারী-পুরুষ-শিশুকে লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে গণহত্যা চালায়। এরপর দুই শতাধিক লাশ পার্শ্ববর্তী পদ্মা নদীতে ভাসিয়ে দেয়। হানাদার বাহিনী এদিন গণহত্যা করার পাশাপাশি গোটা ইউনিয়নে ব্যাপক লুটপাট, ধর্ষণ ও গান পাউডার ছিটিয়ে বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়।

ডেমরা গণহত্যা: ১৩ মে দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনী পাবনা জেলার বর্তমান ফরিদপুর উপজেলার ডেমরা ইউনিয়নের অন্তর্গত গ্রামের নিরস্ত্র হিন্দু বাসিন্দাদের ওপর নির্মম এই গণহত্যা চালায়। এক দিনেই তারা সেখানে প্রায় ৯০০ গ্রামবাসীকে হত্যা করে। সেই সঙ্গে তারা নারী ধর্ষণ ও লুণ্ঠনও করে এবং গ্রামের মসজিদ, মন্দির, স্কুল ও ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা চলে যাওয়ার পর পার্শ্ববর্তী দিঘুলিয়া, রতনপুর, নাগডেমড়া, ছোট পাথাইলহাট, কালিয়ান, বারোয়ানি গ্রামের মানুষ ছুটে আসে। তারা হত্যাযজ্ঞে নিহতদের গণকবর দেয়।

ঘাঘটপাড়ের গণহত্যা : ১৪ মে রংপুর শহরের ক্যান্টনমেন্ট সংলগ্ন নিসবেতগঞ্জ ও আশপাশ এলাকায় বর্বর হত্যাকাণ্ড চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। সেদিন শহিদদের সবার পরনে ছিল খাকি পোশাক। শহিদরা সবাই ছিল ইপিআর বাহিনীর সদস্য। পাকিস্তানি সেনারা ঘাঘটপাড় গণহত্যায় পঞ্চাশ থেকে ষাট জনকে হত্যা করে।

বাড়িয়া গণহত্যা: ১৪ মে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশের বর্তমান গাজীপুর সদর উপজেলার বাড়িয়া গ্রামে নিরস্ত্র বাঙালি হিন্দুদের ওপর নির্মম গণহত্যা চালায়। এ গণহত্যায় বাড়িয়া এবং নিকটবর্তী কামারিয়ায় প্রায় ২০০ বাঙালি হিন্দকে নির্মমভাবে হত্যা করে এবং পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে কয়েকশ মানুষ আহত হয়। ১৪ মে ১টার দিকে বিকালে স্থানীয় সহযোগীরা আউয়াল, হাকিম উদ্দিন এবং মজিদ মিয়া সেনানিবাস থেকে ভাওয়াল এস্টেটে বাড়িয়া পর্যন্ত প্রায় ৫০০ পাকিস্তানি সেনার একটি দলকে নেতৃত্ব দিয়ে গ্রামে নিয়ে আসে। গ্রামে  ঢোকার পরপর সেনারা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং গ্রামবাসীর ওপর গুলি চালায়। নির্বিচারে গোলাগুলির ঘটনায় বাড়িয়া ও কামারিয়ার প্রায় ২০০ গ্রামবাসী মারা যায়; যাদের মধ্যে নারী-শিশুরাও মারা যায় এবং কয়েকশ মানুষ আহত হয়।

ইতনা গণহত্যা: ১৫ মে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার পূর্বাঞ্চলের ইতনা গ্রামে গণহত্যা চালায় ও একের পর এক ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এ এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা ইতনা স্কুলে প্রশিক্ষণকেন্দ্র গড়ে তোলে এবং সেখানে স্থানীয় যুবকরা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। গ্রামের স্বাধীনতাবিরোধীরা ইতনা স্কুলে স্থাপিত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের খবর পাকিস্তানিদের কাছে পৌঁছে দেয়। ফলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাই ইতনা গ্রামে আক্রমণ চালানোর জন্য প্রস্তুত হয়। একাত্তরের ১৫ মে প্রথম পাকিস্তান সেনাবাহিনী ইতনা গ্রামে অভিযান চালায়। বিশেষ করে গ্রামের বিভিন্ন হিন্দু বাড়িগুলো খুঁজে তাতে অগ্নিসংযোগ করে। সুশীল সেনের বাড়িতে অগ্নিসংযোগের সময় তারা ওই বাড়ির অতুল পালকে খড়ের গাদার মধ্যে নিক্ষেপ করে অগ্নিসংযোগ করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ইতনা গ্রামের ৫০ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে পাকিস্তানবাহিনী হত্যা করে।

রমানাথপুর গণহত্যা : ১৬ মে পাকিস্তানি সেনারা খবর পায় ঝালকাঠির রমানাথপুরের মসজিদের সামনে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে। ট্রেনিং দেয়া হচ্ছিল ক্লাবঘরের মসজিদের সামনে। পাকিস্তানি সেনাদের তারা ৫০-৬০ জন ভুল বুঝে শরিফবাড়ি মসজিদে মুসল্লিদের ঘেরাও করে এবং মসজিদ থেকে নিরীহ মুসল্লিদের ধরে এনে গুলি করে হত্যা করে। ১৬ মে গণহত্যায় রমানাথপুরের ৩ হাজার হাজার বাসিন্দা ও শরণার্থীর ওপর তিনবার গণহত্যা-নির্যাতন চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এদিন ২০-২৫ জনকে হত্যা করা হয়। ঝালকাঠি জেলার ২৪টি বধ্যভ‚মি, ৩টি গণকবর পাওয়া যায়; যেখানে পাকিস্তানি সেনারা গণহত্যায় নিহত মানুষকে হত্যা করে ফেলে গেছে।

যুগীশো ও পালশা গণহত্যা : ১৬ মে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে রাজশাহীর যুগীশো ও পালশা গ্রামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও স্থানীয় রাজাকার কর্তৃক বাঙালি হিন্দুদের ওপর চালিত পূর্বপরিকল্পিত গণহত্যার ঘটনা ঘটে। এদিন পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা ৪২ জন বাঙালি হিন্দুকে হত্যা করে। গণহত্যার পর তারা ও এদেশীয় দালালরা মিলে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘর লুটপাট করে।

কাঠিপাড়া গণহত্যা: ১৭ মে। পাকিস্তানি হানাদাররা ঝালকাঠির রাজাপুরের কাঠিপাড়ায় আসে। নৈকাঠি ইউনিয়নের সাতুরিয়া গ্রামের চেয়ারম্যান হামেদ জমাদার ও তার দুই ছেলে বেলায়েত জমাদার ও মিল্লাত জমাদ্দার এ সময় হানাদারদের খবর দিলে হানাদাররা জঙ্গল ঘেরাও করে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এই গ্রামে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে পুরুষদের হত্যা করে। এরপর তারা এলাকার নারীদের ওপর পৈশাচিক নির্যাতন চালায়। এই গণহত্যায় শহিদ হন প্রায় অর্ধশত মানুষ।

শিবচর গণহত্যা : ১৭ মে বেলা ১১টার দিকে ৪০-৪২ জনের পাকিস্তানি হানাদারদের একটি দল কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে মাদারীপুর ক্যাম্প থেকে লঞ্চে করে শিবচরের উৎরাইলে নামে। এরপর স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় হানাদাররা শিবচরের চর শ্যামাইল হয়ে গুলালতা, বাহেরচর, উমেদপুর গ্রামে ঢুকে নির্বিচারে গণহত্যা চালায়। তারা এলাকার পুরুষদের একত্র করে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে, নারীদের ধর্ষণ করে। সবশেষে শতাধিক বাড়িতে লুটপাট করে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। এই গণহত্যায় ২০ জনের বেশি মানুষ শহিদ হন।

জলাপুকুরপাড় গণহত্যা : বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় দিনাজপুর জেলায় বেশ কয়েকটি গণহত্যার ঘটনা ঘটে। এ পর্যন্ত সাতটি গণহত্যার খোঁজ পাওয়া যায়, এর মধ্যে সুজালপুর ইউনিয়নের জলাপুকুরপাড় গণহত্যা অন্যতম। ১৭ মে আনুমানিক ১০টার দিকে স্থানীয় কিছু বিহারি শুজালপুর ইউনিয়নের সাহাপাড়া গ্রাম থেকে ১০ জনকে গাড়িতে করে জলা পুকুরপাড়ে নিয়ে যায় ও সেখানে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে। গুলির আওয়াজ শুনতে পেয়ে জীবন বাঁচাতে গ্রামের লোকজন বাড়িঘর ছেড়ে যে যেদিকে পারে পালিয়ে যায়। নিহত গ্রামবাসীর মৃত্যু নিশ্চিত হয়ে বিহারিরা ওই এলাকা ছেড়ে চলে যায়। পরে বর্ষা গ্রামের ৩ জন লোক এসে জলাপুকুর পাড়েই লাশগুলোকে মাটি চাপা দেয়।

জিন্দাপীর গণহত্যা : ১৭ মে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জ উপজেলার সাত্যের ইউনিয়নের আরাজি চৌপুকুরিয়া গ্রামে গণহত্যা চালায়। তারা নিরপরাধ ঘুমন্ত সাধারণ মানুষকে ডেকে এই গণহত্যা সংঘটিত করে। এটাই জিন্দাপীর গণহত্যা। পাকিস্তানি সেনারা গুলি করে ও খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে ১৭ জন নিরীহ মানুষকে। তারা গ্রামের নারীদের নির্যাতন করে, তাদের জিনিস লুট করে ও গ্রামের প্রায় সব বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এ কাজে সহায়তা করে আমাদের দেশীয় তাদের দোসর রাজাকার ও স্বাধীনতাবিরোধী শান্তি কমিটির সদস্যরা।

চুকনগর গণহত্যা: ২০ মে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগরে ঘটে, যা বিশ্বের কোনো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ একক গণহত্যা। ২০ মে বেলা ১১টা। পাকিস্তানি মিলিটারি বাহিনীর দুটি দল একটি ট্রাক ও একটি জিপ গাড়িতে এসে সাতক্ষীরা থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর দুই-তিনটি গাড়ি এসে থামে চুকনগর বাজারের ঝাউতলায় (তৎকালীন পাতখোলা) এসে থামে। তাদের সঙ্গে ছিল হালকা মেশিনগান ও সেমি-অটোমেটিক রাইফেল। সাদা পোশাকে মুখঢাকা লোকজনও আসে। স্থানীয় রাজাকার, আলবদর ও অবাঙালির (বিহারি) সহায়তায় পাকিস্তানি বাহিনী শুরু করে হত্যাযজ্ঞ। ট্রাক থেকে নেমে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে। ওইদিন যাদের হত্যা করা হয়েছে, তাদের বেশিরভাগ পুরুষ হলেও অনেক নারী ও শিশুকে হত্যা করে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী। হত্যাযজ্ঞ থেকে বাঁচার আশায় অনেকে নদীতে লাফিয়ে পড়েন। তাদের অনেকেই নদীতে ডুবে মারা যান। চুকনগরে সেদিন ১০ থেকে ১২ হাজার মানুষ গণহত্যার শিকার হয়। [চলবে]

গণমাধ্যমকর্মী

salma15august@gmail.com