১৯৭১ গণহত্যা: মে

কাজী সালমা সুলতানা: পিরোজপুর গণহত্যা: ৩ মে ১৯৭১, পিরোজপুরে পাকিস্তানি হানাদারদের বর্বরোচিত গণহত্যা সংঘটিত হয়। এদিন বরিশাল শহর থেকে গানবোটসহ জাহাজে করে ৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের এক প্লাটুন সৈন্য নিয়ে কর্নেল আতিক পিরোজপুরের হুলারহাট আসেন। এসেই তিনি গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন, ধর্ষণসহ নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করে। পিরোজপুর শহরতলির মাছিমপুরের মণ্ডলপাড়া ও মিস্ত্রীপাড়ায় এদিন ৬২ জন হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষকে গুলি করে হত্যা করে তারা। স্থানীয় জামায়াত ও ইসলামী ছাত্র সংঘের সহযোগিতায় পাক সেনারা শহরের খুমুরিয়া শিকদার বাড়ির ১২টি, মুক্তারকাঠীর ছয়টি, বসন্তপুল এলাকায় ১১টি-সহ শতাধিক ঘরবাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ভস্মীভূত করে।

সাতানিখিল গণহত্যা: ১৩ মে মুন্সীগঞ্জের সদর উপজেলার কেওয়ার ১৭ বুদ্ধিজীবীকে ধরে নিয়ে যায় হানাদারেরা। এরপর ১৪ মে সকাল ১০টায় কেওয়ার সাতানিখিল গ্রামের খালের পাড়ে নিয়ে গিয়ে চোখ বেঁধে ১৬ জনকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে হানাদারেরা। এ গণহত্যার দুদিন পর ১৬ মে পাকিস্তানি হানাদারেরা এসে ১৪টি লাশ পার্শ্ববর্তী ব্রহ্মপুত্র নদীতে ভাসিয়ে দেয়।

আবদুল রসুলপুর বাঁশবাড়িয়া গণহত্যা: ১৬ মে বাগেরহাটের আবদুল রসুলপুর বাঁশবাড়িয়া গ্রামে গণহত্যা সংঘটিত হয়। এতে শহিদ হন প্রায় অর্ধশতাধিক মানুষ। ডেমা ইউনিয়নের আবদুল রসুলপুর ও বাঁশবাড়িয়া পাশাপাশি দুটি ছোট গ্রাম। পাক হানাদাররা প্রথমে বাঁশবাড়িয়ায় গণহত্যা চালায়, পরে তারা বাঁশবাড়িয়াতে আসে। এখানে গণহত্যার বিস্তৃতি ছিল বাঁশবাড়িয়া আবদুল রসুলপুর, হেগড়মা, খেজুরমহল-সহ আশেপাশের কয়েকটি গ্রাম নিয়ে। এই গণহত্যার নেতৃত্ব দেয় বাগের হাটের রাজাকার কমান্ডার রজ্জব আলী ফকির। তার সঙ্গে ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন সদস্যসহ কতিপয় রাজাকার। সেদিনকার গণহত্যায় নির্মমভাবে নিহত হন প্রায় অর্ধশতাধিক মানুষ।

হাসামদিয়া গণহত্যা: ১৬ মে তিন শতাধিক পাক সেনার একটি বহর যশোর থেকে রেলযোগে ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার চতুল ইউনিয়নের হাসামদিয়া গ্রামে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সের বৃহত্তর ফরিদপুর জেলা ডিপুটি কমান্ডার শাহ মো. আবু জাফর ও তার নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজে আসে। তাদের না পেয়ে পাক বাহিনীর দোসর, স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় হাসামদিয়া, রামনগর, রাজাপুর, ময়েনদিয়া, রাজাবেনি, মিঠাপুর পোয়াইলসহ কয়েকটি গ্রামের ৩৩ জন গ্রামবাসীকে গুলি করে হত্যা করে। চালানো হয় লুটপাট। জ্বালিয়ে দেয়া হয় ৫০টির অধিক দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।

ঝাউডাঙ্গা গণহত্যা: ২০ মে চুকনগর গণহত্যা চালানোর আগে সেখান থেকে কিছু শরণার্থী পরিবার ত্রিমোহিনী নামক জায়গায় রাত যাপন করে। শরণার্থীরা যখন সাতক্ষীরার ঝাউডাঙ্গা বাজারের পূর্বপাশে পাথরঘাটা গ্রামের ওপর দিয়ে যশোর-সাতক্ষীরা মহাসড়ক অতিক্রম করছিল, তখন যশোর থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দুটো ট্রাক সাতক্ষীরার দিকে যাচ্ছিল। মতিয়ার রহমান পাকিস্তানি সেনাদের বোঝায় যে, ‘তারা ভারতের দালাল। তাদের মধ্যে মুক্তিবাহিনীর লোক আছে এবং তারা অস্ত্র, প্রচুর টাকা-পয়সা ও স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে ভারতে পালিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানি সেনারা গাড়ি থেকে নেমে ব্রাশফায়ার করতে শুরু করে। গুলি ও বেয়োনেট চার্জে ওইদিন প্রায় তিন শতাধিক মানুষ শহিদ হন। ২১ মে কুমিল্লার দক্ষিণে গৌড়িপুর নামক স্থানে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডোরা পাকসেনাদের ওপর অকস্মাৎ আক্রমণ চালান। এতে পাকবাহিনীর ৯ জন সৈন্য নিহত হয়।

ইতনা গণহত্যা: ১৯৭১ সালের ২২ মে পাক সেনারা নড়াইলের ভাটিয়াপাড়া গ্রামের পার্শ্ববর্তী গ্রাম চর ভাটপাড়ার একটি হিন্দুপাড়ায় অভিযান চালায়। এর আগে ১৫ মে প্রথমবার পাকিস্তান সেনাবাহিনী ইতনা গ্রামে অভিযান চালিয়েছিল। ২৩ মে ভোরে পাক সৈন্যরা সেখানে উপস্থিত হয়। তারা পাঁচটি লঞ্চবোঝাই সৈন্য নিয়ে পুরো গ্রামটি ঘিরে ফেলেই ব্যাপক গণহত্যা শুরু করে। মাত্র আধা ঘণ্টায় তারা ৩৯ নিরীহ মানুষকে হত্যা করে এবং বহু ঘরবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। সেদিনের গণহত্যায় গ্রামের ৫০ নিরীহ গ্রামবাসীকে তারা হত্যা করে।

ভীমনলী গণহত্যা: পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলায় ভীমনলী গ্রাম। ২২ মে সকাল ১০টায় প্রায় ৫০০ রাজাকারের সশস্ত্র একটি দল গ্রামটিকে ঘিরে ফেলে। প্রায় ২০০ হিন্দু গ্রামবাসী রাজাকারদের প্রতিহত করতে লাঠি ও বর্শা ওয়াপদা বাঁধে অবস্থান গ্রহণ করেন। রাজাকার বাহিনী ভীমনলী গ্রামের ৮০টি হিন্দু বাড়িতে পালাক্রমে তাণ্ডব চালায়। সেদিন রাজাকারদের গুলিতে শহিদ হন ১৫ জন মুক্তিকামী বীর বাঙালি।

নড়িয়া গণহত্যা: ২২ মে সংঘটিত হয় শরীয়তপুর নড়িয়া গণহত্যা। এদিন পাকিস্তান সেনাবাহিনী ৫০ সেনা নিয়ে লঞ্চে করে মাদারীপুর থেকে শরীয়তপুরের নড়িয়ায় আসে। এখানে এসে তারা ঘড়িসার বাজার, ঝালোপাড়া ও ঘোষপাড়া গ্রামে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। এরপর তারা ঘোষপাড়া গ্রামের নালিত ঘোষকে ধরে একটি গাছের ঝুলিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। সেইসঙ্গে পূর্ব নড়িয়া গ্রামের নাসিমা বেগম, কানাই ছৈয়ালকে গুলি করে হত্যা করে। পরে লোনসিং গ্রামে এসে চার পুরুষ ও তিন নারীকে নির্মমভাবে হত্যা করে।

পালং মধ্যপাড়া গণহত্যা: ২২ মে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকাররা শরীয়তপুরের বর্তমান পালং উপজেলার মধ্যপাড়া গ্রামে আক্রমণ চালায়। তারা সেখানে অসংখ্য নারী-পুরুষকে ধরে নিয়ে নির্যাতন ও হত্যা করে। এই গ্রামে পাকবাহিনীর সহযোগী রাজাকারদের সহযোগিতায় নীলকান্দি ও কাশাভোগ এলাকার ব্যাপক অত্যাচার চালায়। এতে তিন শতাধিক মানুষ গণহত্যার শিকার হয়। হত্যার পর তাদের মনোহর বাজারের আশপাশে গণকবর দেয়া হয়।

হাদল গণহত্যা: ২২ মে হিন্দু অধ্যুষিত হাদল গ্রামে চার শতাধিক নারী, পুরুষ ও শিশুকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নৃশংসভাবে হত্যা করে। শত শত বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়। ১৯৭১ সালের মে মাসে পাকিস্তানি সেনাদের নির্যাতন থেকে বাঁচতে পাবনা সদর, ঈশ্বরদী, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানের সহস্রাধিক মানুষ প্রত্যন্ত হাদল গ্রামে আশ্রয় নেয়। এ সময় গ্রামের শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আবুল হাসান হানাদার বাহিনীকে খবর দেয়। পাক সেনারা গভীর রাতে গ্রামে ঢুকেই ঘুমন্ত মানুষের ওপর ব্রাশ ফায়ার করতে শুরু করে। এ সময় হিন্দুদের বাড়িতে লুটপাট করে অগ্নিসংযোগ করে রাজাকার আলবদর বাহিনী। পাকিস্তানি সেনারা চার শতাধিক নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে।

দৌমোহনী ঘাট গণহত্যা: পাকিস্তানি সৈন্যরা রাজাকারদের সহযোগিতায় বেশ কয়েকটি গণহত্যা চালায় দিনাজপুরের বোচাগঞ্জ উপজেলার দৌমোহনী ঘাট ঘিরে। ২২ মে সকাল থেকে ২৩ মে সকাল পর্যন্ত এই গণহত্যা চলে। এতে প্রায় ২৫ জনের মতো নিহত হন এবং তারা দুই শতাধিক পুরুষকে তুলে নিয়ে যায়। ১২ দিন পর দ্বিতীয়বার শ্রীমন্তপুর গ্রামে সংঘটিত হয় জালিয়াপাড়া গণহত্যা। এই গণহত্যায় আরও পাঁচজনকে হত্যা করা হয়।

বাখরাবাদ গণহত্যা: ২৪ মে পাক হানাদার বাহিনী রাজাকারদের সহযোগিতায় উপজেলার রামচন্দ্রপুর বাজারসংলগ্ন হিন্দু অধ্যুষিত বাখরাবাদ গ্রামে নৃশংস গণহত্যা চালায়। এতে প্রায় দেড় শতাধিক হিন্দু নারী-পুরুষ নির্মমভাবে নিহত হন। পাক হানাদার বাহিনী তাদের হত্যা করে তাদের বাড়িঘরে আগুন দেয় ও লুটপাট করে। তারা হিন্দু সম্প্রদায়ের ২১ ব্যক্তিকে পার্শ্ববর্তী দেবিদ্বার ক্যাম্পে ধরে নিয়ে পরদিন ১৮ জনকে একসঙ্গে গুলি চালিয়ে হত্যা করে। হত্যাকাণ্ড চলে বেলা ২টা পর্যন্ত। পাক সেনারা বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং লুটপাটসহ ধর্ষণ করে।

বুরুঙ্গা গণহত্যা: ২৬ মে সিলেট জেলার ওসমানীনগরের বুরুঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ের (বর্তমান ইকবাল আহমেদ হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ) আঙিনা রঞ্জিত হয়েছিল ৭৮ নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালির রক্তে। পাকিস্তানি হায়নারা নিরীহ মানুষদের গুলি করে মেরেও ক্ষান্ত হয়নি, মৃতদেহের ওপর তারা কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়।

বরগুনা গণহত্যা: ২৯ ও ৩০ মে বরগুনা জেলখানায় ৭৬ স্বাধীনতাকামী নিরপরাধ বাঙালিকে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। পাক হানাদার বাহিনীর মেজর নাদের পারভেজের নেতৃত্বে স্থানীয় শান্তি বাহিনীর প্রধান এমএলএ আ. আজিজ মাস্টারের সহযোগিতায় এ নৃশংস গণহত্যা সংঘটিত হয়। কারা অভ্যন্তরে ২৯ মে সকালে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করা হয় ৪২ মুক্তিকামী জনতাকে। পরের দিন সকালে একইভাবে আরও ৩৪ জনকে হত্যা করা হয়। এই শহিদদের লাশ জেলখানার পশ্চিম পাশে গণকবরে মাটি চাপা দেয়া হয়। গুলি খেয়েও যারা সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন, তাদের বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে ও কোদাল দিয়ে পিটিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়।

গণমাধ্যমকর্মী

salma15august@gmail.com

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০