১ বছরে বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতি কমেছে ৮ হাজার কোটি টাকা

শেখ আবু তালেব: এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংক খাতের কাছে থাকা বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতি অর্ধেকে নেমে গেছে। পাশাপাশি কমেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক সম্পদের পরিমাণও। বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কাছে বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। সামনের দিনগুলোয় বড় ধরনের আমদানি দায় মেটাতে হলে ধার অথবা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে দ্বারস্থ হতে হবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয়।

এদিকে চাহিদা মেটাতে প্রতিনিয়ত বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে ডলার কিনছে ব্যাংকগুলো। এতে অতিরিক্ত তারল্য কমে যাচ্ছে ব্যাংক খাতে। এক বছরের ব্যবধানে তারল্য কমে গেছে ১২ হাজার ৭২৩ কোটি টাকা। এদিকে বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ এত পরিমাণে কমে যাওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন ব্যাংক খাতের পাশাপাশি অর্থনীতিবিদরাও। তারা বলছেন, এতে ডলারের বিপরীতে টাকার মান আরও কমে যাবে। মূল্যস্ফীতি বাড়বে। এটি নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন।

এমন পরিস্থিতিতে গতকাল বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর কাছে থাকা বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণের বিস্তারিত জানতে নতুন ছকে তথ্য দিতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন ছকে বিভিন্ন মুদ্রার ক্যাটেগরিভিত্তিক লেনদেনের তথ্য চাওয়া হয়েছে। এতে দৈনিক ভিত্তিতে সহজেই বুঝা যাবে ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনের পরিমাণ ও গতিপ্রকৃতি। বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে এমন তথ্য।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশের ব্যাংকগুলোর কাছে বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ ছিল ১৫ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকার সমপরিমাণের। এক বছর পর ২০২১ সালের শেষে তা দাঁড়িয়েছে সাত হাজার ৪৫২ কোটি টাকার সমপরিমাণের। অর্থাৎ এক বছরে বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ কমে গেছে আট হাজার ১২১ কোটি টাকা বা অর্ধেকেরও বেশি।

বৈদেশিক মুদ্রার মধ্যে ২০২১ সাল শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কাছে রয়েছে ৩২৮ কোটি ৮৮ লাখ টাকার সমপরিমাণের। ২০২০ সাল শেষে যেখানে ছিল তিন হাজার ৭৮ কোটি ৯০ লাখ টাকার সমপরিমাণের। এ সময়ে ব্যাংকগুলোর কাছে নতুন বৈদেশিক মুদ্রা এলেও তা আমদানি দায় মেটাতে গিয়ে পরিশোধ করতে হয়েছে।

বৈদেশিক মুদ্রার এমন অবস্থার জন্য দায়ী করা হচ্ছে উচ্চহারে আমদানি ব্যয়। গত কয়েক মাস ধরেই প্রায় ৫৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে রয়েছে দেশের আমদানি চিত্র। এ বিষয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি ও মেগা প্রকল্পগুলোর বৈদেশিক পেমেন্ট অর্থাৎ পণ্য আমদানির দায় পরিশোধ করে থাকে সরকারি ব্যাংকগুলোই। বিশেষ করে সম্প্রতি জ্বালানি তেল, কেমিক্যাল, সার ও টিকার আমদানি বেড়েছে। বৈশ্বিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি বিল বেশি পরিশোধ করতে হচ্ছে। যদিও পরিমাণগত দিক দিয়ে জ্বালানি তেলের আমদানি খুব একটা বৃদ্ধি পায়নি। এ জন্য বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ কমে গেছে।’

তথ্য অনুযায়ী, মোট বৈদেশিক মুদ্রার মধ্যে গত ডিসেম্বর শেষে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর কাছে রয়েছে দুই হাজার ৭৬৪ কোটি ৩০ লাখ টাকার সমপরিমাণের। আর ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোর কাছে এক হাজার ১০৮ কোটি ৪৬ লাখ টাকার সমপরিমাণের। অবশ্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের দিক দিয়ে বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে বিদেশি ব্যাংকের শাখাগুলো। ৯টি বিদেশি ব্যাংকের কাছেই রয়েছে তিন হাজার ১৮০ কোটি ২২ লাখ টাকার সমপরিমাণের, যা ব্যাংকগুলোর কাছে থাকা বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় ৪৩ শতাংশ।

এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মানসুর বলেন, ‘আমদানির পরিমাণ এখন ৫৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে রয়েছে। কিন্তু রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি সেভাবে নেই। রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে গেছে। এই চাপে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এক বছরে প্রায় আড়াই বিলিয়ন ডলার কমে গেছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় মূল্য নিয়ন্ত্রণে চাপে পড়বে বাংলাদেশ ব্যাংক। আমদানি দায় মেটাতে গিয়ে ব্যাংকগুলোর কাছে প্রচুর পরিমাণ ডলার বিক্রি করতে হবে। এতে ব্যাংকের টাকার পরিমাণ কমে যাবে, যার প্রভাব পড়বে বিনিয়োগে। ডলারের বিনিময় মূল্য আরও বাড়বে।’

বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ কমে যাওয়াকে সাময়িক উল্লেখ করে শামস-উল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের রপ্তানি বাড়ছে। সম্প্রতি আকুর (এশিয়ান ক্লিয়ারিং হাউস) সদস্য রাষ্ট্রগুলোর আমদানি দায় পরিশোধ করতে হয়েছে। এতে সাময়িক চাপে রয়েছে বৈদেশিক মুদ্রা বিশেষ করে ডলারের পরিমাণ। কিন্তু দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে এটি সমন্বয় তথা পূরণ হয়ে যাবে।’

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আমদানি পণ্যের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে আনার পরামর্শ দিয়ে আহসান এইচ মানসুর বলেন, ‘টাকার বিপরীতে ডলারের বিনিময় মূল্য বাড়িয়ে দিতে হবে। টাকার অবমূল্যায়ন আরও করতে হবে ধীরে ধীরে। নইলে বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবস্থাপনা নিয়ে বড় চাপে পড়বে ব্যাংক খাত।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ডিসেম্বর শেষে দেশের ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত তারল্য দাঁড়িয়েছে ৩২ হাজার কোটি টাকা। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে যা ছিল ৪৪ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে অতিরিক্ত তারল্য কমেছে ১২ হাজার ৭২৩ কোটি টাকা।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০