আবদুর রহিম, নারায়ণগঞ্জ: নারায়ণগঞ্জে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরঘেঁষে প্রাকৃতিক পরিবেশের মাঝে গড়ে উঠেছে ঐতিহ্যবাহী কাইকারটেকের হাট। প্রায় ৫০ বিঘা জমির ওপর ২০০ বছর ধরে প্রতি রোববার নিয়মিত এখানে হাট বসে।
জেলার সোনারগাঁ উপজেলার মোগরাপাড়া ইউনিয়নে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী কাইকারটেক হাট অবস্থিত। কোষা নৌকা, পুতা মিষ্টি, কাঠ, বাঁশ ও কৃষিজাত পণ্যের জন্য কাইকারটেক হাট নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ ও কুমিল্লা জেলায় সুপরিচিত। এছাড়া গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি থেকে শুরু করে মৌসুমি ফল, চাল, ডালসহ কৃষকদের উৎপাদিত বিভিন্ন পণ্য পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করা হয় এ হাটে। প্রতি রোববার এই হাটটি ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চালু থাকে। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, কুমিল্লাসহ আশপাশের নানা জেলা থেকে হাটবারে অনেকেই ছুটে আসেন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে।
স্থানীয়রা জানান, নৌপথ ও সড়কপথে পণ্য আনা-নেয়ার সুবিধার্থে নদনদীর তীরে হাট বসানো হয়। সোনারগাঁ উপজেলা ছাড়াও পাশের বন্দর, আড়াইহাজার, কুমিল্লার মেঘনা, দাউদকান্দি ও মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার বাসিন্দারা এ হাটে নানা পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করেন।
হাটে বিক্রি হওয়া মজার মজার খাবারের স্বাদ মুগ্ধ করে আগন্তুকদের। ঐতিহ্যবাহী এই কাইকারটেক হাট ইতিহাস-ঐতিহ্যের জন্য বিখ্যাত হলেও এ হাটের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হলো বিশেষ এক ধরনের মিষ্টি। ওজন আর পরিমাপে অন্যান্য মিষ্টির তুলনায় এই মিষ্টি চার থেকে পাঁচগুণ বড়। এর ওজন এক থেকে দুই কেজি হয়ে থাকে। অনেকটা শিলপুতার মতো দেখতে এই মিষ্টির নাম দেওয়া হয়েছে ‘পুতা মিষ্টি’। এ হাটের মতোই পুতা মিষ্টির ঐতিহ্যও অনেক পুরোনো। শুধু এ মিষ্টির স্বাদ নেয়ার জন্য দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসেন অনেক মিষ্টিপ্রেমী। তবে এ মিষ্টি কবে, কে, কীভাবে তৈরি শুরু করে, এ ব্যাপারে তেমন কোনো তথ্য দিতে পারেননি স্থানীয়রা।
পুতা মিষ্টির বাইরে তালের রস, কালোজাম, রসগোল্লা, জিলাপি, মোহনভোগ, লালভোগ, বালুশাহ্সহ নানা ধরনের মিষ্টি থেকে শুরু করে দই, পরোটা-ভাজি, ডালসহ নানা পদ এখানে পাওয়া যায়। শুধু মিষ্টি নয়, এখানে বিক্রি হয় টক দই ও আখের গুড় দিয়ে বানানো লাচ্ছি, বিশেষ ঝালমুড়ি, মুরালি, বুট, পেঁয়াজু, নিমকি, চানাচুর, মোয়াসহ নানা ধরনের খাবার। এ ছাড়া এ হাটের মাছের শুঁটকি খুব নামকরা। অনেকেই চ্যাপা ও ইলিশ শুঁটকি কিনতে এ হাটে ছুটে আসেন।
বর্ষা মৌসুমে এ হাটের নৌকা বেচেকেনা হয়। কম দামে ভালো মানের কোষা নৌকা বিক্রির জন্য প্রসিদ্ধ কাইকারটেক হাট। নৌকা কিনতে বর্ষাকালে ভিড় জমান নারায়ণগঞ্জসহ আশপাশের জেলার শত শত ক্রেতা।
হাট ঘুরে দেখা গেছে, দোকান বসেছে, পসরা সাজানো হয়েছে হাটে। দলে দলে লোকজন আসছেন কেনাকাটা করতে। কবুতর, জাল, দা, কুড়াল, জামা-কাপড়, গরু-ছাগল, মাছ, হাঁস-মুরগিসহ নিত্য ব্যবহার্য সবকিছুই রয়েছে।
এছাড়া ঈদুল আজহার সময় নারায়ণগঞ্জের অন্যতম একটি পশুর হাট এখানে বসে। দুই শত বছরের পুরোনো এই হাট এখনো ঐতিহ্য ধরে রেখেছে।
হাটে আসা ষাটোর্ধ জসিমউদ্দীন জানান, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াকালে থেকে বাবার সঙ্গে এ হাটে আসা শুরু হয়। আমার বাবাও দাদার সঙ্গে এ হাটে আসতেন। জসিমউদ্দীনের মতো আরও অনেকে যুগ যুগ ধরে এ হাটে আসা-যাওয়া করেন।
পুরোনো ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে হাটটির চারপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ অপরূপ। হাটের পাশেই রয়েছে কাইকেরটেক ব্রিজ। এই ব্রিজ থেকে পুরো হাট দেখা যায়। তবে কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে চলেছে এই হাটটির পুরোনো ঐতিহ্য। এখন আর সব ধরনের পণ্য নিয়ে বাজারজাত করার সেই সরগরম দেখা যায় না।