২০১০ সালের ধস-পরবর্তী ছয় বছর: বহুজাতিক কোম্পানির শেয়ারদর সর্বোচ্চ ৩৩৩ শতাংশ বেড়েছে

 

পুঁজিবাজারে ধসের ছয় বছর পেরিয়ে গেলো। ২০১০ সালের ধসের পর প্রায় শতভাগ কোম্পানির দরপতন হয়। গত ৬ বছরে আগের দরে ফিরতে পারেনি বেশিরভাগ কোম্পানি। শতাধিক কোম্পানির দর এখনও ফেসভ্যালুর আশপাশে ওঠানামা করছে। তবে বহুজাতিক কোম্পানি এর ব্যতিক্রম। এসব কোম্পানির দর এ সময়ে সর্বোচ্চ ৩৩৩ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। মহাধসের আগে ও পরের শেয়ারদর এবং বর্তমান বাজার পরিস্থিতি নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজকে থাকছে বহুজাতিক কোম্পানি।

নাজমুল ইসলাম ফারুক: বহুজাতিক কোম্পানিগুলো ২০১০ সালের ধসে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও খুব দ্রুত কাটিয়ে ওঠে তারা। চাহিদার তুলনায় শেয়ারসংখ্যা কম থাকায় এসব কোম্পানির দর বেড়ে দ্বিগুণ ও তিনগুণ হয় গত ছয় বছরে। এসব কোম্পানি বাজারের সূচক বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখলে বিনিয়োগকারীদের তেমন কোনো সুবিধা দিতে পারেনি। বছরে ৫০০-৭০০ শতাংশ লভ্যাংশ দিলেও বিনিয়োগকারীরা প্রকৃত লভ্যাংশ পাচ্ছে ১-৩ শতাংশের কাছাকাছি। শেয়ার বিজের অনুসন্ধানে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

জানা যায়, ধস-পূর্ববর্তী ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকোর শেয়ারদর ছিল ৫৭৫ টাকা। ডিসেম্বরে বাজারে বড় ধরনের পতন হয়। পরের বছর ফেব্রুয়ারি মাসে কোম্পানিটির দর কমে দাঁড়ায় ৬৪২ টাকা। ছয় বছর পর গতকাল কোম্পানির শেয়ার সর্বশেষ দুই হাজার ৪৮৮ টাকায় বেচাকেনা হয়েছে। অর্থাৎ ধস-পরবর্তী ছয় বছরে কোম্পানির শেয়ারদর সর্বোচ্চ ৩৩৩ শতাংশ বেড়েছে। পাশাপাশি ধারাবাহিকভাবে কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দিয়ে যাচ্ছে।

শুধু ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো নয়, বহুজাতিক কোম্পানির বেশিরভাগই ধস-পরবর্তী সময়ে ধারাবাহিকভাবে দর বেড়েছে। অন্য যেসব বহুজাতিক কোম্পানির শেয়ারদর ধস-পরবর্তী সময়ে বেড়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেড, বাটা সু লিমিটেড, লিন্ডে বাংলাদেশ লিমিটেড, গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইন (জিএসকে) বাংলাদেশ লিমিটেড, ম্যারিকো বাংলাদেশ লিমিটেড।

শেয়ারদর বাড়লেও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর প্রকৃত মুনাফার হার ৫ শতাংশের নিচে। ২০১৫ সালের সমাপ্ত বছরে কোম্পানিগুলোর লভ্যাংশ পর্যালোচনায় এমনটি জানা গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানির। ২০১৫ সালের সমাপ্ত বছরে প্রতিষ্ঠানটি বিনিয়োগকারীদের জন্য ৫৫০ শতাংশ লভ্যাংশ দেয়। এতে প্রকৃত লভ্যাংশের হার দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৮৬ শতাংশ। এছাড়া বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেডের প্রকৃত লভ্যাংশ হার ১ দশমিক ৯৪ শতাংশ, বাটা সু কোম্পানি লিমিটেড ২ দশমিক ৪৩, লিন্ডে বাংলাদেশ লিমিটেডের ২ দশমিক ৭২, গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইন বাংলাদেশ লিমিটেডের ৩ দশমিক শূন্য ছয় শতাংশ, ম্যারিকো বাংলাদেশ লিমিটেডের হার ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ।

এদিকে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করলে গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইনের কোম্পানি সচিব নিজাম উদ্দীন শেয়ার বিজকে বলেন, পুঁজিবাজারে শেয়ারের দর বাড়ছে না কমছে, সেটা আমাদের দেখার বিষয় নয়। তবে এতটুকু বলতে পারি, আমাদের কোম্পানিতে ইনভেস্টরের সংখ্যা বেশি। তারা শেয়ার বিক্রি করতে চান না।

তথ্যমতে, ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর দেশের পুঁজিবাজারে লেনদেনের ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছিল। ওইদিন প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) লেনদেন হয়েছিল তিন হাজার ২৪৯ কোটি টাকা। লেনদেনের পাশাপাশি সূচকও রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু এর পরদিনই বাজারে লেনদেনের পতন হয়। এক দিনের ব্যবধানে বাজারে ধস নেমে আসে। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ারদর কমে যায়। এতে লাখ লাখ বিনিয়োগকারী লোকসানের মুখে পড়ে। আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন তারা।

এদিকে দীর্ঘ পাঁচ বছর পর ২০১৬ সালের শেষ দিকে বাজারে লেনদেনের গতি ফিরে আসে। চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি বাজারে লেনদেন দুই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। পাশাপাশি সূচকও পাঁচ হাজার ৭০০ পয়েন্টের ওপরে অবস্থান করে। কিন্তু এক দিন পরই লেনদেনে পতন হয়। আবারও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে বাজারে।

আলোচিত উত্থান-পতনেও বাজারে বহুজাতিক কোম্পানিরগুলোর শেয়ারে তেমন নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। এ সময় দেশি দুর্বল ও লোকসানি কোম্পানির শেয়ারদরে সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ফলে বিনিয়োগকারীরা বহুজাতিক কোম্পানি থেকে খুব বেশি মুনাফা করতে না পারলেও বড় ধরনের লোকসানে পড়েনি।

বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর শেয়ারদর পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১০ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেডের শেয়ারদর ৬৬৬ টাকায় বেচাকেনা হয়েছে। ধসের পরে ফেব্রুয়ারি মাসে কোম্পানির শেয়ারদর দাঁড়ায় ৭৬০ টাকা। গতকাল সর্বশেষ দুই হাজার ২৭৬ টাকায় বেচাকেনা হয়েছে। অর্থাৎ ধস-পরবর্তী ছয় বছরে কোম্পানির শেয়ারদর বেড়েছে প্রায় ২৪২ শতাংশ।

বাটা সু লিমিটেডের শেয়ারদর ধসের আগে ফেব্রুয়ারিতে ৬৫৯ টাকায় বেচাকেনা হয়েছে। ধস-পরবর্তী ফেব্রুয়ারি মাসে কোম্পানির শেয়ারদর কমে ৫৩৯ টাকায় বেচাকেনা হয়েছে। গতকাল কোম্পানির শেয়ার সর্বশেষ এক হাজার ১৩৯ টাকা ১০ পয়সায় বেচাকেনা হয়েছে। অর্থাৎ কোম্পানির শেয়ার ধস-পরবর্তী সময়ে বেড়েছে প্রায় ৭৩ শতাংশ।

লিন্ডে বাংলাদেশ লিমিটেডের শেয়ারদর ধসের আগে ফেব্রুয়ারিতে ৬৪৭ টাকা বেচাকেনা হয়েছে। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে কোম্পানির শেয়ারদর কমে ৫৭৭ টাকায় বেচাকেনা হয়েছে। কোম্পানির শেয়ার গতকাল সর্বশেষ বেচাকেনা হয়েছে এক হাজার ৩০২ টাকা ২০ পয়সা। অর্থাৎ ধস-পরবর্তী সময়ে কোম্পানির শেয়ারদর বেড়েছে প্রায় ১০১ শতাংশ।

গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইন (জিএসকে) বাংলাদেশ লিমিটেডের ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ৮৩৯ টাকায় বেচাকেনা হয়েছে। ধস-পরবর্তী ফেব্রুয়ারি মাসে ৭৮৫ টাকায় বেচাকেনা হয়েছে। গতকাল কোম্পানির সর্বশেষ দর ছিল এক হাজার ৫৭৪ টাকা ৭০ পয়সা। অর্থাৎ গত ছয় বছরে কোম্পানির শেয়ারদর বেড়েছে প্রায় ৮৮ শতাংশ।

ম্যারিকো বাংলাদেশ লিমিটেডের শেয়ারদর ধসের পরে ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ৫২৭ টাকায় বেচাকেনা হয়েছে। গতকাল কোম্পানির শেয়ার সর্বশেষ এক হাজার ২৩ টাকা বেচাকেনা হয়েছে। ধস-পরবর্তী ছয় বছরে কোম্পানির শেয়ারদর ৯৪ শতাংশ বেড়েছে।

বহুজাতিক কোম্পানির শেয়ার ধারণ করে এমন একজন বিনিয়োগকারী তৌহিদুল ইসলাম পলাশ। তিনি বলেন, একটি বহুজাতিক কোম্পানির শেয়ারে লাখ টাকা বিনিয়োগ রয়েছে। বছর শেষে মুনাফা পাওয়া যায় মাত্র তিন হাজার টাকা, যা ব্যাংকের সুদের হারের চেয়ে কম। এসব কোম্পানির চেয়ে ব্যাংক বিমা কোম্পানির শেয়ার অনেক ভালো।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ধসের সময় তালিকাভুক্ত বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ারদর কমেছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে লাখ লাখ বিনিয়োগকারী। তবে অন্যান্য কোম্পানির তুলনায় বহুজাতিক কোম্পানির শেয়ার বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির পরিমাণ ছিল অনেকটা কম। এছাড়া কোম্পানিরগুলো দীর্ঘ মন্দা বাজারেও ধারাবাহিকভাবে লভ্যাংশ দিয়ে যাচ্ছে। এতে বিনিয়োগকারীরা ক্যাপিটাল ও ডিভিডেন্ড গেইন করতে পারছেন।

এ সম্পর্কে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, ২০১০ সালে ধসের আগে বহুজাতিক কোম্পানির শেয়ারদর অনেকটা কম ছিল। সে সময় আমাদের লোকাল কোম্পানির শেয়ারদর যতটা লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে; বহুজাতিক কোম্পানির শেয়ারদর সেভাবে বাড়েনি। ফলে ধসের কারণে এসব কোম্পানির শেয়ারহোল্ডাররা ক্ষতির কবলে পড়েনি।

তিনি আরও বলেন, বহুজাতিক কোম্পানির দর একটা লেভেলে অবস্থান করছে। সম্প্রতি উত্থান-পতনেও এসব কোম্পানির শেয়ারহোল্ডারদের তেমন কোনো সমস্যা হয়েছে বলে মনে হয় না। এসব শেয়ারের বেশিরভাগ ক্রেতা বিদেশিরা। যদি ডিভিডেন্ড ইল্ড ভালো হয়, তবে কোম্পানিগুলোর শেয়ার কিনে বিনিয়োগকারীরা লাভবান হতেন।

 

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০