সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: অপ্রতিরোধ্য গতিতে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। কোনো উদ্যোগে তা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। প্রতি মাসে পুরোনো খেলাপিদের সঙ্গে তালিকায় যুক্ত হচ্ছে নতুন একাধিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি। সদ্য গত ২০১৯ সালে চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতে সবগুলো ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান খেলাপি পাওনা আদায়ে ৫৬৬টি মামলা করে।
৫৬৬ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দায়ের করা এসব মামলার বিপরীতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পাওনার পরিমাণ প্রায় তিন হাজার ৬৬০ কোটি টাকা।
ব্যাংক মামলার নথি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বড় বড় খেলাপি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ছিল গুঁড়া দুধ আমদানির বড় প্রতিষ্ঠান চিটাগাং সিন্ডিকেট, সান ডেইরি অ্যান্ড এগ্রো প্রোডাক্টস, মমতা ডেইরি অ্যান্ড ফুডস, ভোজ্যতেল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মেরিন ভেজিটেবল অয়েল লিমিটেড, নূরজাহান সুপার অয়েল লিমিটেড, জাসমির সুপার অয়েল লিমিটেড, বাদশা গ্রুপের জাহাজ ভাঙা প্রতিষ্ঠান ঝুমা এন্টারপ্রাইজ এবং মুসা অ্যান্ড ইসা ব্রাদার্স, রাইজিং গ্রুপের রাইজিং স্টিল, সেভেন বি অ্যাসোসিয়েট, আম্বিয়া স্টিল রি-রোলিং মিলস, এসএ পাল্প অ্যান্ড পেপার প্রোডাক্টক লিমিটেড, সুপার স্টিল, সুপার সিক্স স্টিল, ডায়নামিক স্টিল, আহমেদ মুস্তবা স্টিল, আকতার এন্টারপ্রাইজ, আহমেদ ট্রেডার্স, যমুনা এন্টারপ্রাইজ, নর্থ আউটশিট অ্যান্ড অ্যাকসেসরিজ, আজিজ ইদ্দিন ইন্ডাস্ট্রিজ, মাওলানা অ্যান্ড সন্স, সানোয়ারা ডেইরি ফুডস লিমিটেড, গোল্ডেন হরাইজন, জেসি ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেড প্রভৃতি। এ সময়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের নামে পাঁচ শতাধিক মামলা হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে বেসরকারি উদ্যোগে ভারী শিল্পায়নের কালে সবচেয়ে বেশি শিল্প-কারখানা, ট্রেডিং ব্যবসা, পোশাক কারখানা, তেল ও চিনি রিফাইনারি, জাহাজ ভাঙা শিল্প ইত্যাদি গড়ে ওঠে চট্টগ্রামে। এসব খাতের ব্যবসায়ীরা নেতৃত্ব দিতেন শিল্প-বাণিজ্যের সবক্ষেত্রে। কিন্তু সময়ে বিবর্তনে নেতৃত্বের অদক্ষতায়, অদূরদর্শী, পারিবারিক দ্বন্দ্ব, ব্যবসায়িক সাংস্কৃতির অভাব, ব্যবসায়িক জ্ঞানের অভাব, অর্থ ব্যবস্থাপনার অভাবের ব্যবসায় পিছিয়ে পড়তে হয়। এতে সংকোচিত হয় ব্যবসা। এসব উদ্যোক্তাদের নগদ অর্থ প্রবাহের কারণে বন্ধ হচ্ছে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। এতে প্রতি মাসে খেলাপি তালিকায় যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি। আর পাওনা আদায়ে বেড়েছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মামলাও।
অর্থঋণ আদালত সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালে চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতে প্রায় সবগুলো ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান খেলাপি পাওনা আদায়ে মোট ৫৬৬টি মামলা করে। এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে ১৬৯ কোটি টাকা আদায়ে ২০টি, ফেব্রুয়ারি মাসে ৮০ কোটি টাকা আদায়ে ৩১টি, মার্চে ৪৪৭ কোটি আদায়ে ৫২টি, এপ্রিলে ৬৯ কোটি আদায়ে ৪১টি, মে মাসে ২৫৯ কোটি টাকা আদায়ে ৪৫টি, জুন মাসে ৫৪৯ কোটি টাকা আদায়ে ৬৪টি, জুলাইয়ে ৯৫৭ কোটি টাকা আদায়ে ৪৮টি, আগস্ট মাসে ৩০ কোটি টাকা আদায়ে ২৮টি, সেপ্টেম্বরে ১৩০ কোটি আদায়ে ৪২টি, অক্টোবর মাসে ২১৮ কোটি টাকা আদায়ে ২৪টি, নভেম্বরে ৬৯৩ কোটি টাকা আদায়ে ১৩৫টি ও ডিসেম্বরে ৫২ কোটি টাকা আদায়ে ৩৫টি মামলা করে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। সব মামলার বিপরীতে খেলাপি ঋণের পাওনার পরিমাণ প্রায় তিন হাজার ৬৬৮ কোটি টাকা।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলেন, প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসায়িক প্রয়োজনের বিভিন্ন সময় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ঋণ নিয়ে সময়মতো পরিশোধ করতে না পেরে খেলাপি হয়ে পড়ে। এসব খাতের ব্যবসায়ী ও পাইকারদের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা করেও ঋণ ফেরত পাওয়ার আশ্বাস মিলছে না। আবার অনেক ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা শীর্ষ কর্মকর্তারাও সরাসরি দেখা দিচ্ছেন না।
চট্টগ্রামে ব্যবসায়ীদের খেলাপি হয়ে পড়া প্রসঙ্গে সাদ মুসা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মহসিন শেয়ার বিজকে বলেন, আজ চট্টগ্রামের ভালো ভালো গ্রুপ কিংবা প্রতিষ্ঠানের অবস্থা খারাপ। এর প্রধান কারণ অত্যধিক ব্যাংকঋণের সুদ, ব্যবসায়িক অদক্ষতা, টানা লোকসান, ব্যাংকের দায় পরিশোধে ব্যর্থতার দায়ে নতুনভাবে ঋণ না পাওয়া ও আন্তর্জাতিক বাজারে ধারাবাহিক পতন। আসলে ব্যবসায়ের অবস্থা অনেক খারাপ। তাই এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করতে হবে। ঋণ প্রদান ক্ষেত্রে গুণগত মান, সঠিক ব্যবসায়ী যাচাই, রপ্তানি ও উৎপাদন খাতে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ইত্যাদি বিবেচনা করতে হবে।
এদিকে গত বছর সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংকসহ আরও কয়েকটি ব্যাংক ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানের বন্ধকি সম্পদ নিলামে বিক্রয়ের জন্য ২০০-এর অধিক নিলাম অনুষ্ঠান আয়োজন করে। কিন্তু এসব নিলামে পায়নি কোনো আগ্রহী ক্রেতা বা প্রতিষ্ঠান। ফলে সব মিলিয়ে বিপাকে ঋণ প্রদানকারী ব্যাংকগুলো। আর ঋণ আদায় নিয়েও শঙ্কা ও চিন্তিত অধিকাংশ ব্যাংক ব্যবস্থাপকরা।
পদ্মা ব্যাংক লিমিটেড খাতুনগঞ্জ শাখা ব্যবস্থাপক খোরশেদ আলম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঋণ আদায়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে অফিসে গিয়েও ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকদের সঙ্গে দেখা মিলছে না। আর ফোনে তো পাওয়া যায় না। ফলে এসব পাওনা আদায়ে খুব চিন্তিত আছি। এক্ষেত্রে কয়েকবার প্রতিষ্ঠানগুলোকে নোটিশ প্রদান করা হলেও কোনো সাড়া মিলছে না। এছাড়া গত কয়েক বছরে কিছু ব্যবসায়ী আত্মগোপনে চলে যাওয়ার প্রবণতা দেখা গেছে। ফলে মামলা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। যদিও অনেক সময় নিলামে কিংবা পাওনা আদায়ে মামলা করতে যাবÑএমন সময়ে গ্রাহক স্টে অর্ডার নিয়ে আসে। ফলে অনেক সময় পাওনা আদায়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়। এসব নিয়ে প্রতিনিয়ত চিন্তায় আছি।’