২০২১ নিয়ে আসুক সুস্থ বার্তা

কাজী সালমা সুলতানা: বিদায় ২০২০ সাল। বিশ্বব্যাপী মানবজীবনে এক সংকট নিয়ে পার হলো বছরটি। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহানে করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের পর থেকে বিশ্বব্যাপী আতঙ্ক বিরাজ করছিল। প্রথমদিকে চীন থেকে অনেক শিক্ষার্থী, কর্মজীবী দেশে ফিরে আসেন, সে সময় তাদের বিমানবন্দরে কোনো ধরনের পরীক্ষা ছাড়া শুধু তাপমাত্রা পরীক্ষা করেই দেশে প্রবেশ করানো হয়। তখনও দেশে এই মহামারি নিয়ে তেমন কোনো প্রস্তুতি নেয়া হয়নি। বাংলাদেশে মার্চ মাসের ৮ তারিখে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে সেই আতঙ্ক বাস্তবে রূপ নেয়। ক্রমেই রোগটি বিস্তার লাভ করে। প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু হয় ১৬ এপ্রিল ২০২০।  এই পরিস্থিতিতে সরকার ২৬ মার্চ থেকে সারা দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। জনগণকে করোনা থেকে রক্ষা পেতে ঘরে থাকার আহ্বান জানায়। বন্ধ হয়ে যায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য আমদানি রপ্তানি, খেলাধুলা, বিনোদন কেন্দ্র, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড অনেকগুলো সংবাদপত্রসহ সব প্রতিষ্ঠান। সাধারণ ছুটি দুবারে ৩০ মে পর্যন্ত বাড়ানো হয়। ১৫ মার্চ থেকে ধাপে ধাপে বিভিন্ন দেশের ফ্লাইট বন্ধ করে এবং পরে ২৮ মার্চ থেকে চীন ছাড়া সব আন্তর্জাতিক রুটে চলাচলকারী ফ্লাইট বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

বাংলাদেশের মানুষ প্রতি বছর ডেঙ্গুর সঙ্গে চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছিল। এতেই দেশের মানুষ পেরে উঠছিল না, হঠাৎ করে করোনা মহামারির কারণে বন্ধ হয়ে যায় দৈনিক কাজে যাওয়া মানুষের কাজ। দ্রুত বাড়তে থাকে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা। যারা কখনাও দান গ্রহণ করেননি এমন ভদ্র পরিবারগুলোকেও দান নিতে দেখা যায়। প্রতিটা পরিবার যেন একঘরে হয়ে যায়। অনেক পবিবার নতুনভাবে জীবনকে উপলব্ধি করতে শেখে। আবার  অনেক পরিবারেই দ্বন্দ্ব বাড়তে দেখা যায়। দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতি দেখা দেয়।   রাজধানী ঢাকা ছেড়ে সহস্য পরিবার শুধু জীবন বাঁচাতে গ্রামে ফিরে যায়। সরকার করোনা প্রাদুর্ভাবকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে কিন্তু সেই উদ্যোগ জনগণের কাছে অনেক ক্ষেত্রে না পৌঁছানোর কারণে সে উদ্যোগ কোথাও কোথাও সমালোচিত হয়। করোনার প্রথম দিকে নকল মাস্ক পিপিই নিয়ে ও করোনার পরীক্ষা নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতি প্রকাশ হলে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ব্যাপক সমালোচিত হয়। করোনার নমুনা নিয়ে পরীক্ষা না করেই অনেক হাসপাতাল ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে আরেক বিপত্তি সৃষ্টি করে। হাসপাতালকেন্দ্রিক একের পর এক দুর্নীতি প্রকাশিত হতে থাকে, যা মানুষের জীবনযাপনে অস্বস্তি এনে দেয়।

এসব অস্বস্তির মাঝেও করোনাকালে পবিবারের গুরুত্ব জীবনের মূল মন্ত্র হয়ে ওঠে। একসঙ্গে টেবিলে বসে খাওয়া, ঘরের কাজগুলো ভাগ করে নেয়া, বাগান করা, রান্না করা এসব ফিরে এসেছে আমাদের পারিবারিক জীবনে। মানুষ বুঝতে শিখেছে জীবনে কত কম চাহিদায় খুশি থাকা যায়।

বিশ্বব্যাপী এখন করোনা প্রতিরোধে অপরিহার্য মাস্ক ভবিষ্যতেও ধুলা প্রতিরোধে ও সুস্থ থাকার ক্ষেত্রে ব্যবহারে দীর্ঘমেয়াদি হবে। ‘এ জন্য ইতোমধ্যে সরকারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’ চালু করেছে। ফলে মাস্ক সামনের দিনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।

করোনাকালে বেড়েছে ইন্টারনেট ব্যবহার। টেলিমেডিসিন ডাক্তার দেখানো, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় থাকা, বন্ধু-আত্মীয় সবার সঙ্গে অডিওভিডিও কলে যোগাযোগ রাখা, হোম অফিসের কাজ ও ভিডিও কনফারেন্সে মিটিং করা, ছাত্রদের অনলাইনে ক্লাস করাÑএসবই বাড়িয়ে দিয়েছে প্রযুক্তির অপরিহার্যতা। দুনিয়াজুড়েই অনলাইনে খাবার, খাদ্যসামগ্রী ও প্রয়োজনীয় সবকিছু বাসায় হোম ডেলিভারি আনার প্রবণতা বেড়েছে। মাস্ক পরা, স্বাস্থ্য সচেতনতা, পরিবারকেন্দ্রিক জীবনযাপন, জনসচেতনতা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এ বিষয়গুলোই হয়তো ২০২১ সালে বিশ্বের সব সচেতন ও দায়িত্বশীল নাগরিকের জীবনযাত্রার অনুষঙ্গ হয়ে থাকবে।

ধারাবাহিক সব উদ্যোগের ফলে ব্ল–মবার্গ জানায়, করোনা নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ এশিয়ার মধ্যে শীর্ষে অবস্থান করছে। বিশ্বে যার অবস্থান ২০। বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস মোকাবিলা করে আর্থসামাজিক উন্নতিসহ বসবাস উপযোগী নিরাপদ শীর্ষ ২০ দেশের তালিকায় স্থান পেয়েছে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ সংস্থা ব্ল–মবার্গের এক সূচকে এ তথ্য উঠে এসেছে। এ তালিকায় শীর্ষ রয়েছে নিউজিল্যান্ড। এরপর পর্যায়ক্রমে তাইওয়ান, অস্ট্রেলিয়া, নরওয়ে, সিঙ্গাপুর, ফিনল্যান্ড, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, ডেনমার্ক, কানাডা, ভিয়েতনাম, হংকং, থাইল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইসরাইল, রাশিয়া ও নেদারল্যান্ডসের পর বাংলাদেশ এই তালিকায় স্থান পেয়েছে। যেসব দেশ সফলভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে তাদের মধ্যে প্রথমেই আসে ভিয়েতনামের নাম। যে দেশে করোনা আক্রান্ত হয়ে একজন মানুষের মৃত্যুও হয়নি।

‘কভিড সহনশীলতা র‌্যাংকিং’ শীর্ষক তালিকা অনুসারে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশ সব দেশের মধ্যে শীর্ষস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশের পর পর্যায়ক্রমে রয়েছে মিসর, চীন ও ভিয়েতনাম। ব্ল–মবার্গ বলছে, আক্রান্ত এবং মৃত্যুহার নিয়ন্ত্রণেও বাংলাদেশ সফল। করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা করে জিডিপি ধরে রাখার ঘটনাকে বাংলাদেশের সরকারের সাফল্য বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। মহামারি করোনোয় আক্রান্ত ও মৃত্যুহারের পাশাপাশি জিডিপি প্রবৃদ্ধির দিক থেকে বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে।

প্রথম প্রথম চিকিৎসকরা নিজেরাই করোনা নিয়ে সঠিক তথ্য জানতেন না। ফলে রোগীদের সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে নানা সীমাবদ্ধতা দেখা দিয়েছিল। কোথাও কোথাও রোগীর কাছে চিকিৎসক-নার্সরা যেতেনই না। ফলে অনেকেরই করুণ মৃত্যু ঘটে; এদের মধ্যে চিকিৎসকদের মৃত্যুর সংখ্যাটাও জনগনের মাঝে বেশ আতঙ্কের সৃষ্টি করে। হাসপাতালে শয্যা, ভেন্টিলেটর আইসিইউ, অক্সিজেন অব্যবস্থাপনার কারণে মৃত্যু বেড়েছে অনেক।

করোনার কারণে দেখা দিয়েছে মানসিক ব্যাধি। প্রায় অনেক পরিবারের সদস্যরা আক্রান্ত হচ্ছেন এই ব্যাধিতে। ভবিষ্যতে বিশ্বে মানুষের মানসিক সুস্থতা রক্ষা করার যুদ্ধটাও আমাদের সামনে প্রকট হবে। আজ পর্যন্ত মহামারি করোনায় বিশ্বব্যাপী মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৮ কোটি ২৮ লাখ, তাদের মধ্যে সুস্থ ৪ কোটি ৬৮ লাখ, মৃত্যু ঘটেছে ১৮ লাখ ১০ হাজার। এর মধ্যে আমরা হারিয়েছি ৭ হাজার ৫৫৯ জন।

মহামারি করোনায় আমরা অনেক খ্যাতনামা ব্যক্তি, শিল্পপতি, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, চিকিৎসক, পুলিশ-র‌্যাব-বিজিবি সদস্য, সেনাসদস্য, ব্যবসায়ী, আমলা, ব্যাংক কর্মকর্তা, দুদক কর্মকর্তা, সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ব্যক্তিত্ব  হারিয়েছি। তাদের মধ্যে স্বনামখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব, বীর মুক্তিযোদ্ধা আলী যাকের। মঞ্চ, বেতার, টেলিভিশন ও সিনেমার অভিনেতা কেএস ফিরোজ। বাংলাদেশ টেলিভিশনের অবসরপ্রাপ্ত উপমহাপরিচালক, বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এনটিভির অনুষ্ঠান বিভাগের প্রধান মোস্তফা কামাল সৈয়দ, বাংলাদেশ টেলিভিশনের অসংখ্য জনপ্রিয় নাটকের নির্মাতা ও টিভিব্যক্তিত্ব মোহাম্মদ বরকত উল্লাহ। শিক্ষাবিদ, লেখক ও জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম।

আওয়ামী লীগ নেতা এবং সাবেক এমপি হাজী মকবুল হোসেন, সানবিমস স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল নিলুফার মঞ্জুর, দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের পরিচালক মোরশেদুল আলম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ভিসি, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা ড. নাজমুল করিম, শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি ও সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস (প্রা.) লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইমামুল কবীর শান্ত, খ্যাতিমান প্রকৌশলী জাতীয় অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী, সাবেক অর্থ এবং বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী মেজর জেনারেল (অব.) আনোয়ারুল কবির তালুকদার।

সময়ের নিয়মে ২০২০ সালকে হারানোর মাঝে বিদায় জানিয়ে ২০২১ সালকে স্বাগত জানাচ্ছি। নতুন বছরে মহামারি করোনা থেকে মুক্ত হয়ে  এক সুস্থ পৃথিবী তার স্বাভাবিকতায় ফিরে যাক। ইতোমধ্যে টিকা আবিষ্কার হয়েছে। হয়তো জানুয়ারির শেষ অথবা ফেব্রুয়ারির শুরুতে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা চলে আসবে। বিভিন্ন দেশে টিকা দেয়া শুরু হয়েছে  কোথাও কোথাও বিনামূল্যে টিকা দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশেও টিকা আমদানির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ব্যাধিমুক্ত সুন্দর পৃথিবীতে শিশুরা  বন্দিজীবন থেকে মুক্ত হবে। শিক্ষার্থীরা তাদের স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্টিটিতে পড়াশোনায় মনোয়োগী হবে। সিনেমা হল, নাট্য প্রাঙ্গণ, পর্যটন কেন্দ্র আবার মেতে উঠবে কোলাহলে। লেখার মাঠে আবার ফিরবে ফুটবল, ক্রিকেটের আসর। স্যানিটাইজার আর জীবাণু সন্দেহ মন থেকে চিরবিদায় নেবে। এমন দিনের প্রত্যাশা পূরণ হোক ২০২১-এ।

গণমাধ্যম কর্মী 

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০