ইসমাইল আলী: বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ ক্রমশ বাড়ছেই। তবে গত কয়েক বছরে তা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এ সময় সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতেই বিদেশি ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে হঠাৎ সে ধারায় কিছুটা ছেদ পড়েছে। বিদায়ী বছরের সেপ্টেম্বর শেষে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ না বেড়ে উল্টো হ্রাস পেয়েছে। মূলত চলতি (২০২২-২৩) অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতে ঋণ গ্রহণ হ্রাস ও পরিশোধ বৃদ্ধি পাওয়ায় এটি হয়েছে।
যদিও গত দুই অর্থবছর (২০২০-২১ ও ২০২১-২২) বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ সবচেয়ে বেশি হারে বৃদ্ধি পায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, সেপ্টেম্বর শেষে বাংলাদেশের মোট বিদেশি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯২ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন (৯ হাজার ২৬৯ কোটি) ডলার। এর মধ্যে সরকারি ঋণ ৬৭ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার ও বেসরকারি ঋণ ২৫ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার। গত জুন শেষে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৫ দশমিক ২৩ বিলিয়ন (৯ হাজার ৪৫০ কোটি) ডলার। এর মধ্যে সরকারি ঋণ ছিল ৬৯ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার ও বেসরকারি ঋণ ২৫ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার।
এ হিসাবে তিন মাসের ব্যবধানে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ কমেছে দুই দশমিক ৫৪ বিলিয়ন (২৫৪ কোটি) ডলার বা দুই দশমিক ৬৭ শতাংশ। এর মধ্যে সরকারি ঋণ কমেছে ১ দশমিক ৯৯ বিলিয়ন ডলার বা দুই দশমিক ৮৭ শতাংশ ও বেসরকারি ঋণ কমেছে শূন্য দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার বা দুই দশমিক ১২ শতাংশ। এমনকি মার্চের তুলনায়ও সেপ্টেম্বর শেষে বিদেশি ঋণ কমেছে। মার্চ শেষে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৩ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার।
তথ্যমতে, সেপ্টেম্বর শেষে সরকারের সরাসরি বিদেশি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৫৬ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার। আর রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন সংস্থার ঋণের পরিমাণ ছিল ১০ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি অর্থবছর সরকারের কৃচ্ছ্রসাধন নীতির কারণে উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন গতি অনেক কমে গেছে। এর প্রভাবে সরকারি ঋণ কমেছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে চলমান বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য প্রতিশ্রুত বৈদেশিক ঋণ ছাড় হয়েছে ১৩৪ কোটি ৯২ লাখ ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) এর পরিমাণ ছিল ১৯৩ কোটি ৮০ লাখ ডলার। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসের বৈদেশিক ঋণের ছাড় প্রায় ৫৮ কোটি ৮৮ লাখ ডলার বা ৪৩ দশমিক ৬০ শতাংশ কমেছে।
এদিকে লাইবর (লন্ডন আন্তঃব্যাংক অফার রেট) অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় বেসরকারি ঋণ গ্রহণ কমেছে বলে মনে করা হচ্ছে। তথ্যমতে, গত বছর ডিসেম্বর শেষে ছয় মাস মেয়াদি লাইবর ছিল শূন্য দশমিক ৩১ শতাংশ। গত ডিসেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়ায় পাঁচ দশমিক ১৬ শতাংশ। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে লাইবর বেড়ে প্রায় ১৬ গুণ হয়েছে। মূলত এর প্রভাবে বেসরকারি খাতে ঋণ গ্রহণ কমেছে।
বেসরকারি ঋণের মধ্যে বায়ার্স ক্রেডিট বেড়েছে। তবে ডেফার্ড পেমেন্ট ও ব্যাক টু ব্যাক এলসি কমেছে। সেপ্টেম্বর শেষে বায়ার্স ক্রেডিটের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার, জুন শেষে যা ছিল ৯ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। আর সেপ্টেম্বর শেষে ডেফার্ড পেমেন্ট ও ব্যাক টু ব্যাক এলসির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮১৫ মিলিয়ন ডলার ও ৮৮৫ মিলিয়ন ডলার। জুন শেষে এ দুটির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে এক দশমিক ০২ বিলিয়ন ডলার ও এক দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১৬-১৭ অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪৫ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলার। ২০১৭-১৮ অর্থবছর শেষে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৬ দশমিক ০১ বিলিয়ন ডলার, ২০১৮-১৯ অর্থবছর শেষে ৬২ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলার, ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে ৬৮ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলার ও ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে ৮১ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার ও ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে ৯৫ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার।
এ হিসাবে ২০২১-২২ অর্থবছর বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ বেড়েছে ১৫ দশমিক ৯৬ শতাংশ। এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছর বিদেশি ঋণ বেড়েছিল ১২ দশমিক ৯৮ শতাংশ।
উল্লেখ্য, চলতি অর্থবছর সেপ্টেম্বর শেষে বিশ্বব্যাংক, এডিবির মতো বহুজাতিক ঋণদাতা সংস্থা থেকে নেয়ার ঋণের পরিমাণ ছিল ৩৩ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার। এর প্রায় পুরোটাই সহজ শর্তের ঋণ। জুন শেষে এর পরিমাণ ছিল ৩৩ দশমিক ৯৯ বিলিয়ন ডলার। আর সেপ্টেম্বর শেষে দ্বিপক্ষীয় উৎস থেকে নেয়া ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৪ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার। জুন শেষে এর পরিমাণ ছিল ২৩ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার। এর প্রায় অর্ধেক সহজ শর্তের ঋণ। বাকি ঋণের বেশিরভাগই কঠিন শর্তের।