ইসমাইল আলী: বেড়েই চলেছে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়। দাম বাড়িয়েও আয়-ব্যয়ের বড় ঘাটতি পোষানো যাচ্ছে না। এতে লোকসান বাড়ছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি)। ঘাটতি মেটাতে বড় অঙ্কের ভর্তুকি দিতে হচ্ছে সরকারকে। তবে তহবিল সংকটে ভর্তুকির অর্থ সময়মতো ছাড় করছে না অর্থ মন্ত্রণালয়। এতে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে সংস্থাটি। সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ খাতের নাজুক অবস্থা ক্রমেই জটিল হচ্ছে।
তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে পিডিবির লোকসান দাঁড়িয়েছে ৫১ হাজার ৩০০ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। এ ঘাটতি পূরণে সরকারের কাছে ভর্তুকি চাওয়া হয় ৩৯ হাজার ৫৩৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। যদিও গত জুন পর্যন্ত ছাড় হয়েছে মাত্র সাত হাজার ৩৫৯ কোটি টাকা। বাকিটা চলতি অর্থবছর ধীরে ধীরে ছাড় করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে ভর্তুকি বাদেও বিদায়ী অর্থবছর ১১ হাজার ৭৬৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা ঘাটতি রয়ে গেছে পিডিবির।
এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছর পিডিবি লোকসান গুনেছিল ৩২ হাজার ৮৯১ কোটি ১৭ লাখ টাকা। এ হিসাবে গত অর্থবছর সংস্থাটির লোকসান রেকর্ড বেড়েছে ১৮ হাজার ৪০৯ কোটি ২৮ লাখ টাকা বা ৫৫ দশমিক ৯৭ শতাংশ। আর ২০১১-২২ অর্থবছর পিডিবিকে ভর্তুকি বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল ২৯ হাজার ৬৫৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। অর্থাৎ গত অর্থবছর ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ বেড়েছে ৯ হাজার ৮৭৬ কোটি ৫২ লাখ টাকা। তবে ওই অর্থবছরও ভর্তুকি বকেয়া রয়ে যায়; যা গত অর্থবছর ছাড় করা হয়।
সূত্র জানায়, ২০০৯ সাল থেকে বেশকিছু রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেয় সরকার। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয় ডলারে। যদিও বর্তমানে কুইক রেন্টালের সংখ্যা কমে এসেছে। তারপরও বিদ্যমান কেন্দ্রগুলোকে ডলারেই ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে। রেন্টাল-কুইক রেন্টালের পর বেসরকারি খাতে বড় বেশকিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমোদন দেয়া হয়।
ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার (আইপিপি) নামক এসব কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ সরাসরি ডলারে পরিশোধ করা হয় না। তবে আইপিপিগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ ডলারের বিনিময় হার ধরে টাকায় পরিশোধ করতে হয়। এক্ষেত্রে বিনিময় হার নির্ধারিত হয় সোনালী ব্যাংকের বিনিময় হারে। ফলে সরাসরি ডলার না লাগলেও টাকার অবমূল্যায়নে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ ব্যয় বেড়ে গেছে। এছাড়া ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির বিল ডলারে পরিশোধ করতে হয়। আদানি যুক্ত হওয়ায় ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি বেড়েছে। ফলে এ খাতে ব্যয়ও অনেক বেড়েছে।
পিডিবির গত ১৫ বছরের আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০০৮-০৯ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত পিডিবি লোকসান গুনেছে এক লাখ ৬০ হাজার ৯৬৩ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। তবে মাত্র শেষ দুই অর্থবছর ৮৪ হাজার ১৯১ কোটি ৬২ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছে পিডিবি। অর্থাৎ ১৫ বছরে পিডিবির লোকসানের ৫২ দশমিক ৩০ শতাংশই ছিল ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে। আর ২০০৮-০৯ অর্থবছরের সঙ্গে তুলনা করলে গত অর্থবছর লোকসান প্রায় ৬১ গুণ বেড়েছে পিডিবির।
সংস্থাটির তথ্যমতে, ২০০৮-০৯ অর্থবছর পিডিবি লোকসান গুনেছিল মাত্র ৮২৮ কোটি ৬১ লাখ টাকা। পরের (২০০৯-১০) অর্থবছর তা কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৬৩৫ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। তবে ২০১০-১১ অর্থবছর লোকসান এক লাফে সাতগুণের বেশি বেড়ে হয় চার হাজার ৬২০ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছর তা আরও ৪৪ শতাংশ বেড়ে হয় ছয় হাজার ৬৯৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। তবে ২০১২-১৩ অর্থবছর তা কিছুটা কমে দাঁড়ায় পাঁচ হাজার ৪৩ কোটি ৮৪ লাখ টাকা।
পরের দুই অর্থবছর পিডিবির লোকসান আবারও বাড়ে। এর মধ্যে ২০১৩-১৪ অর্থবছর লোকসান ৩৫ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ছয় হাজার ৮০৯ কোটি ২৫ লাখ টাকা। আর ২০১৪-১৫ অর্থবছর প্রায় সাত শতাংশ বেড়ে হয় সাত হাজার ২৮২ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। তবে ২০১৫-১৬ অর্থবছর পিডিবির লোকসান প্রায় ৪৭ শতাংশ কমে দাঁড়ায় তিন হাজার ৮৭৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। তবে ২০১৬-১৭ অর্থবছর পিডিবির লোকসান আবারও বাড়ে। ওই অর্থবছর লোকসান দাঁড়ায় চার হাজার ৪৩৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা।
২০১৭-১৮ অর্থবছর পিডিবির লোকসান অনেকখানি বাড়ে। ওই অর্থবছর ১১০ শতাংশ বাড়ে সংস্থাটির। এতে পিডিবির লোকসান দাঁড়ায় ৯ হাজার ৩১০ কোটি ১৫ লাখ টাকা। তবে পরের দুই অর্থবছর তা আবার কমে। এর মধ্যে ২০১৮-১৯ অর্থবছর লোকসান হয় আট হাজার ১৪১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা ও ২০১৯-২০ অর্থবছর সাত হাজার ৪৪৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। তবে ২০২০-২১ অর্থবছর পিডিবির লোকসান বেড়ে দাঁড়ায় ১১ হাজার ৬৪৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা।