Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 7:22 pm

২০২২-২৩ অর্থ বছরে নিট এফডিআই কমেছে ৭.১১%

নিজস্ব প্রতিবেদক: বৈদেশিক মুদ্রা আসার অন্যতম একটি উৎস হলো প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই। দেশে চলমান ডলার সংকটে এ খাতে বড় কোনো সুখবর দিতে পারেনি। বরং বিদায়ী অর্থবছর প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) কমেছে ৭ শতাংশের বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের এফডিআই বিষয়ক সর্বশেষ প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্বাচনের আগের বছরে স্বাভাবিকভাবেই বিদেশি বিনিয়োগ কমে। এর মধ্যে অর্থনৈতিক ও ডলার সংকট, বিদ্যুৎ-জ্বালানি সরবরাহে ঘাটতি ও অনিয়ন্ত্রিত মূল্য বৃদ্ধি, বিনিময় হারের দ্রুত পরিবর্তন ইত্যাদি কারণেও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আস্থা পান না। এছাড়া ব্যবসা সহজীকরণ সূচকে পিছিয়ে থাকা, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা, তথ্যের ঘাটতি, দক্ষ শ্রমিকের অভাবসহ বিভিন্ন কারণে বিদেশিরা এ দেশে বড় মূলধনি বিনিয়োগে এগিয়ে আসছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেনদন অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে নিট এফডিআই এসেছে প্রায় ৩.১৯৫ বিলিয়ন (৩১৯ কোটি ৫০ লাখ) ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে নিট এফডিআই আসে প্রায় ৩.৪৪০ বিলিয়ন (৩৪৪ কোটি) ডলার। অর্থাৎ গত অর্থবছর এফডিআই প্রবাহ কমেছে ৭ দশমিক ১১ শতাংশ। যদিও ২০২১-২২ আগের অর্থবছর নিট এফডিআই বেড়েছিল রেকর্ড ৩৭ দশমিক ২২ শতাংশ। কারণ ২০২০-২১ অর্থবছর এফডিআই আসে ২.৫০৭ বিলিয়ন (২৫০ কোটি ৭০ লাখ) ডলার। আর ২০১৯-২০ অর্থবছর দেশে এফডিআই আসে ২.৩৭০ বিলিয়ন (২৩৭ কোটি) ডলার।

সূত্রমতে, দেশে মহামারি করোনার আঘাত পর থেকে বিদেশি বিনিয়োগ নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তবে করোনার প্রকোপ কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছরে টানা বেড়েছিল বিদেশি বিনিয়োগ। তবে বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে এসে একপ্রকার হোঁচট খেয়েছে এই সূচকটি। এর প্রভাব দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও পড়েছে।

এফডিআই প্রবাহ কমার পাশাপাশি নতুন পুঁজি তথা ইক্যুইটি বিনিয়োগও গত অর্থবছর এসেছে কম। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিদায়ী অর্থবছরে বিদেশিরা মূলধন (ইক্যুইটি) হিসেবে প্রায় ৭৯৬ মিলিয়ন বা ৭৯ কোটি ৬০ লাখ ডলার বিনিয়োগ করেছেন। এটি তার আগের গত অর্থবছরের চেয়ে ৪০ দশমিক ৯১ শতাংশ কম। ২০২১-২২ অর্থবছর ইক্যুইটি বিনিয়োগ এসেছিল ১.৩৪৭ বিলিয়ন ডলার।

যদিও গত অর্থবছর বিদেশিদের পুনর্বিনিয়োগের পরিমাণ বেড়েছে ১৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ। এ সময়ে পুনর্বিনিয়োগ হিসেবে এসেছে ২.৩৭ বিলিয়ন বা ২৩৭ কোটি ডলার। এটি ২০২১-২২ অর্থবছরের ছিল ২.০৪৫ বিলিয়ন বা ২০৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার। আর গত অর্থবছর আন্তঃকোম্পানি (ইন্ট্রা-কোম্পানি) ঋণ হিসেবে এসেছে প্রায় ২৯ মিলিয়ন ডলার। আগের অর্থবছর যার পরিমাণ ছিল প্রায় ৪৮ মিলিয়ন ডলার।

প্রসঙ্গত, সাধারণত তিন পদ্ধতিতে বিদেশি কোম্পানিগুলো বিনিয়োগ করে থাকে। এগুলো হলোÑ নতুন পুঁজি তথা মূলধন হিসাবে, বিদ্যমান ব্যবসা থেকে অর্জিত মুনাফা পুনর্বিনিয়োগ করে এবং এক কোম্পানি অন্য কোম্পানি থেকে ঋণ নিয়ে, যা ইন্ট্রা-কোম্পানি লোন নামে পরিচিত। প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, ২০২২-২৩ যুক্তরাজ্যের উদ্যোক্তারা বাংলাদেশে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ করেছেন। এ সময়ে যুক্তরাজ্য থেকে প্রায় ৫৬ কোটি ৫০ লাখ ডলারের বিনিয়োগ এসেছে, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ৫৬ কোটি ডলার। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪৩ কোটি ৫৫ লাখ ডলার বিনিয়োগ এসেছে নেদারল্যান্ডস থেকে। ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশটি থেকে বিনিয়োগ এসেছিল ৩০ কোটি ৩৩ লাখ ডলার। কোরিয়া থেকে এসেছে ২৯ কোটি ৫২ লাখ ডলার, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৩১ কোটি ২৯ লাখ ডলার। ২৮ কোটি ৯১ লাখ ডলার বিনিয়োগ করে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান চতুর্থ। ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশটি থেকে বিনিয়োগ এসেছে ৩৫ কোটি ৪১ লাখ ডলার। এছাড়া সিঙ্গাপুর থেকে ১৯ কোটি ২০ লাখ ডলার, নরওয়ে থেকে ১৮ কোটি ৪০ লাখ ডলার, হংকং থেকে ১৮ কোটি ৩৮ লাখ ডলার, মাল্টা থেকে ১৭ কোটি ডলার, ভারত থেকে ১১ কোটি ৯৮ লাখ ডলার ও মালয়েশিয়া থেকে ৯ কোটি ৯৫ লাখ ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে।

এদিকে গত অর্থবছরে সর্বোচ্চ বিদেশি বিনিয়োগ হয়েছে টেক্সটাইল তথা বস্ত্র খাতে, এর পরিমাণ ৬৬ কোটি ২২ লাখ ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে এ খাতে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৭০ কোটি ৫৬ লাখ ডলার। এরপরেই আছে টেলিকমিউনিকেশন খাত। এ খাতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে ৪৩ কোটি ৪৩ লাখ ডলার, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৫১ কোটি ১৬ লাখ ডলার। তৃতীয় সর্বোচ্চ ৩৬ কোটি ৪৫ লাখ ডলার এসেছে ব্যাংকিং খাতে, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ৩১ কোটি ৯৯ লাখ ডলার। গ্যাস ও পেট্রোলিয়াম খাতে এসেছে ৩২ কোটি ৫৬ লাখ ডলার, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ৩৪ কোটি ৩২ লাখ ডলার। এছাড়া বিদ্যুৎ খাতে ৩০ কোটি ডলার, খাদ্য খাতে ২৬ কোটি ৫৪ লাখ ডলার, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য খাতে ১২ কোটি ১১ লাখ ডলার, কেমিক্যাল ও ওষুধ খাতে ৭ কোটি ৯৫ লাখ ডলার, নির্মাণ খাতে ৭ কোটি ৬১ লাখ ডলার ও সার খাতে ৬ কোটি ৯৭ লাখ ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে। 

তথ্যমতে, বিদায়ী অর্থবছর দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলে এফডিআই এসেছে মাত্র ৪.১৬ মিলিয়ন ডলার ও ইপিজেডে ৪০৬.৪৬ মিলিয়ন ডলার। আর ইপিজেড ও অর্থনৈতিক অঞ্চলের বাইরে অন্যান্য এলাকাগুলোয় নিট বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে ২.৭৮৫ বিলিয়ন ডলার।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে এফডিআইয়ের বর্তমান অবস্থা ও সম্ভাবনা নিয়ে সনদপ্রাপ্ত হিসাববিদদের সংগঠন দ্য ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি) গত মাসে এক ওয়েবিনারের আয়োজন করে। ওই অনুষ্ঠানে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সাম্প্র্রতিক বছরগুলোয় বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ অনেক কমেছে। অন্যদিকে ভারতসহ প্রতিবেশী দেশগুলোয় বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ছে। অথচ দেশের বর্তমান বাস্তবতায় বিদেশি বিনিয়োগ অনেক বেশি দরকার। বর্তমানে বিদেশিদের মূলধনি বিনিয়োগের পরিমাণ অনেক কমে গেছে। এর মূল কারণ বিদেশিরা এখন নতুন বিনিয়োগে আস্থা পাচ্ছে না। কেন এমনটা হচ্ছেÑতার কারণ অনুসন্ধান করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলেই কেবল এফডিআই বাড়ানো সম্ভব হবে।