মেজবাহ হোসেন: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারি। তাই সরকারের গ্রিন সিগন্যাল ও নির্বাচন কমিশনের কর্মপরিকল্পনায় সেটি জানুয়ারি’ ২৪-এ অনুষ্ঠিত হওয়ার পথেই আপাত অগ্রসরমান। সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের কাঁধে বন্দুক রেখে আওয়ামী লীগ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে যে সংকটের জš§ দিয়েছিল সেটা বাংলাদেশকে ক্রমাগত ঠেলতে ঠেলতে খাদের কিনারে এনে দাঁড় করিয়েছে, এখন শুধু অপেক্ষা শেষ ধাক্কার। সরকার যদি ২০২৪-এর নির্বাচন চলতি কৌশলে করিয়ে নিতে সক্ষম হয় তাহলে দেশ সেই খাদে মুখ থুবড়ে পড়বে। কেন ঠিক এই নির্বাচনের পরেই দেশ খাদে পড়বে, কেন এতদিনের কর্মকাণ্ডেও দেশ খাদে পড়েনি বলা হয়?
এক-এগারোর সরকার থেকে অদ্যাবধি এমন অনেক সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছে, যা দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থের বিপরীত। এসবের ফলে দেশের অনেক ক্ষতি হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না কিন্তু রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামোর বড় একটা অংশ এখনও নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্র স্থবির হয়ে পরলেও এই দণ্ডায়মান অংশের ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রের পুনঃমেরামত করা সম্ভব। কিন্তু আসন্ন নির্বাচন সরকারি নীলনকশায় সফল হলে আমাদের জাতীয় জীবনে বহুমাত্রিক ও অপূরণীয় যেসব ক্ষতি হবে তার মধ্যে প্রথম হলো অর্থনৈতিক অচলাবস্থা। এর ফলে দেশ দেউলিয়া হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল এবং এই প্রভাব জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলবে খুবই অল্প সময়ের মধ্যে। বর্তমানে দেশের যে পরিমাণ বৈদেশিক ঋণ রয়েছে এবং সেগুলোর সুদসহ প্রথম কিস্তি পরিশোধের সময় ইতোমধ্যে হয়ে এসেছে। সরকারের হাতে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে তা দিয়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোই কষ্টসাধ্য, অনেক কাটছাঁট করে সরকার আমদানি করছে। এরপর আছে বিভিন্ন আমদানি পণ্যের (তেল, গ্যাস, কয়লা) শত শত কোটি ডলারের বকেয়া বিল যেগুলো পরিশোধে সরকার দফায় দফায় সময় বাড়িয়ে চলছে। বিজিএমইএ ও সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়ে দিয়েছে যে, তাদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ পোশাক রপ্তানির অর্ডার কমে গেছে। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পোশাকের মান নিয়ে অফিশিয়ালি অভিযোগ জানিয়েছে। সুতরাং অনুমান করা খুব কঠিন নয় যে তারা বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক ক্রয় বন্ধ করে দিতে পারে যদি না সরকার সত্যিকার গণতান্ত্রিক পথে হাঁটে। আর যুক্তরাষ্ট্র যে পথে হাঁটবে তার মিত্র কানাডা ও ইউরোপও একই পথে হাঁটবে। সুতরাং নির্বাচন-উত্তর অর্থনীতির গতি কী হবে তা বোঝার জন্য অর্থনীতিবিদ হওয়ার প্রয়োজন নেই।
দ্বিতীয়ত, বর্তমানে পুলিশ, প্রশাসন ও বিচার বিভাগের ভূমিকায় মনে হয় তারা যেন রাষ্ট্রের সেবক থেকে বেশি আওয়ামী লীগ সরকারের সেবক। পাশাপাশি ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ অন্যান্য লীগের লোকজন যেভাবে গায়ের জোরে চাঁদাবাজি, অন্যের সম্পদ জবর দখল, যাকে ইচ্ছা তাকে হুমকি দেয়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাদের কথামতো মিছিল-মিটিং বা সমাবেশে যোগ দিতে বাধ্য করা, যোগ না দিলে মারধর করে হল থেকে বের করে দেয়া প্রভৃতি অলিখিত নির্বাহী ক্ষমতা তারা ভোগ করছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সমর্থকেরা আওয়ামী লীগকে যেভাবে ক্ষমতাবান এবং আওয়ামী লীগের কথাই শেষ কথা মনে করে, জানুয়ারির বৈতরণী পার হতে পারলে তাদের এই ক্ষমতা ও মনোভাব দুটোই আরও লাগামহীনভাবে বেড়ে যাবে এবং তারা অকল্পনীয় রকম অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবে। অন্যদিকে পশ্চিমাদের সমর্থন পাওয়ার সুবাদে বিরোধীরা আর অহিংস নাও থাকতে পারে, সেক্ষেত্রে দুটি চরম বিবদমান পক্ষ মাঠে অবস্থান নিলে সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে; জননিরাপত্তা ও সামাজিক শৃঙ্খলা অকল্পনীয় রকমভাবে বিনষ্ট হবে। এর বাইরে দলীয় আনুকূল্য পাওয়া সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা তো মুখিয়েই আছে।
এই পরিস্থিতি তো আর এক দিনে, একহাতে সৃষ্টি হয়নি; এক-এগারোর নামে আন্তর্জাতিক মহল এই আগুন লাগিয়েছিল ২০০৮-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসনে জিতিয়ে দিয়ে (এই নির্বাচনের কিছুটা গ্রহণযোগ্যতা থাকলেও শেখ হাসিনা যখন নিজের মুখে অন রেকর্ড বলেন যে তারা চাইলে বিরোধী দলে বিএনপির পরিবর্তে অন্য কেউ থাকত তখন আর কিছু বাকি থাকে না)। এই আগুনে ঘি ঢেলেছে অভ্যন্তরীণ নানান পক্ষ (বাম দলগুলো, বিচার বিভাগ, প্রশাসনের বড় একটা অংশ আর গৃহপালিত জাতীয় পার্টি)। মোটা দাগে কয়েকটি পক্ষের দায় আলোচনা করা যাকÑ
আমেরিকার দায় : পশ্চিমা বিশ্বের নেতা ও গণতান্ত্রিক বেল্টের প্রধান পরাশক্তি আমেরিকা এই পরিস্থিতির প্রধান কুশীলব। আজকের আমেরিকা যেভাবে সরকারের প্রতি বিরূপ ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় রাত-দিন এক করে ফেলছে তাতে এদের বন্ধু মনে করার কোনো অবকাশ নেই। তবে তাদের এই ভূমিকা থেকে গণতন্ত্রকামী গোষ্ঠীকে ফায়দা নিতেই হবে। আমেরিকার চরিত্র ঠিক ‘সর্প হইয়া দংশন কর, ওঝা হইয়া ঝাড়ো’ ধরনের। সে কারণেই নাইন-ইলেভেনের ষড়যন্ত্রের পর সন্ত্রাস নিধনের নামে ইসলাম কোপানোর ধান্দায় বাংলাদেশে ওয়ান-ইলেভেন ঘটিয়ে জনগণের প্রতি প্রতিশ্রুতিশীল ইসলামি ভাবধারাপুষ্ট বিএনপি ও তার মিত্রদের দমন করতে ভারতের পরিকল্পনায় আওয়ামী লীগকে নিরঙ্কুশ বিজয়ে গদিনসিন করে (প্রণব মুখার্জির নিজের বইতে স্বীকারোক্তি দেওয়ার পর বোধহয় আর কোনো তর্ক করার সুযোগ থাকে না), এই কাজে আমেরিকার পূর্ণ সমর্থন ছিল। যার ফলে আওয়ামী লীগ (শেখ হাসিনা নিজে) বাংলাদেশের সংবিধানকে নিজের মর্জিমাফিক সংশোধন করে সরকারি মেনুফেস্টোতে পরিণত করে নিজে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে আর সব ঝামেলার জš§ দেয়, সামাজিক আপস ছিন্ন করে (সর্বজনস্বীকৃত তত্ত্বাবধায়ক সরকার)। এরপর আরও কত কি ঘটে গেল, পিলখানা ট্র্যাজেডি, বিচারের নামে প্রহসন, গ্রামীণ ব্যাংক, ২০১৪ আর ২০১৮-এর ভণ্ডামির নির্বাচন, শাপলা চত্বরে আলেম নিধন কিন্তু আমেরিকার দেখা নেই। তারা যখন দেখল যে ইসলামপন্থিরা মোটামুটি সোজা হয়ে গেছে আর বাংলাদেশ তার দুর্নীতির কারণে ক্রমেই চীনের বলয়ে ঢুকে পড়ছে যেটা রুখে দেয়া ভারতের পক্ষে সম্ভব নয়, তখন মহাশয় গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ঝাণ্ডা নিয়ে হাজির; বাংলাদেশের মানুষের প্রেমে পড়ে নয়। এভাবে ২০০৮-এ সর্প হয়ে দংশন করে এখন তেনারা ওঝার ভূমিকায় অবতীর্ণ। মাঝখান থেকে ১৫ বছর দেশ আর জনগণ বিষের জ্বালায় কাতর সময় পার করল।
আওয়ামী লীগের দায় : আওয়ামী লীগের সব থেকে বড় দায় হলো তার বর্বর মাত্রায় ক্ষমতা লিপ্সা। ক্ষমতায় তাকে যেতেই হবে/থাকতেই হবে, তা পন্থা যেটাই হোক। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে যে বাকশাল গঠন করা হয়েছিল সেটিও আসন্ন নির্বাচনে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা থেকেই। ১৯৮৬-এর নির্বাচনে ১০ কোটি টাকা উৎকোচের বিনিময়ে শেখ হাসিনা নিজেই নিজেকে জাতীয় বেঈমান উপাধি দিলেন (এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জনাব আব্দুল জলিল ও বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের জবানবন্দির কথা কারও অজানা নয়), ১৯৯৬-এ জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে আজীবনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে একটি সাংবিধানিক সরকারকে আনস্ট্যাবল করা, ১৭৩ দিন হরতাল করে জনজীবন ও জাতীয় অর্থনীতি ধ্বংস করে দেয়া, ৯৬-০১ আমলে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, আমরা যখন নির্বাচন দিলে জিততে পারব তখনই নির্বাচন দেব, অতঃপর ২০০৯-এর পর কোনো প্রকার জাতীয় ঐক্য ছাড়াই বিচারের নামে বিরোধীদের ফাঁসি দেয়া ও সম্পূর্ণ একক ব্যক্তির ইচ্ছায় সর্বজনবিদিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা। ক্ষমতার জন্য এভাবেই আওয়ামী লীগ নিজের বিরোধিতা নিজেই করেছে অসংখ্য বার। আগে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সহিংসতাকে পিকেটিং হিসেবে বিবেচনা করা হলেও ২০০৯ থেকে সেটাকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ২০১৪-এর নির্বাচনকে নিয়ম রক্ষার নির্বাচন এবং শিগগিরই সবাইকে নিয়ে একটি ভালো নির্বাচন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা, কিন্তু তিনি সেই কথা রাখেননি। ৫০০ টাকার বাজেটে ১০০ টাকার কাজ করে সেই টাকা জনগণের পকেটে হাত ঢুকিয়ে বের করে নেয়া হয়েছে, তাই আওয়ামী লীগের পক্ষে আর একটিবার জনগণের কাছে যাওয়ার জন্য কোনো নীতি, আদর্শ বা রাজনৈতিক বয়ান অবশিষ্ট নেই। রাজনীতির মাঠে প্রতিপক্ষকে যেভাবে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে তাদের দমন করেছে, তাতে আওয়ামী লীগ আর কখনও লগি বৈঠা নিয়ে রাজপথে মানুষ হত্যার খেলায় মেতে ওঠার সুযোগ পাবে না। যার দরুন ক্ষমতা ছেড়ে রাজনীতির মাঠে পুনরায় প্রবেশ করা তাদের পক্ষে অসম্ভব; তাই চলতি মেয়াদকে যেকোনো উপায়ে ১ মিনিটের জন্য হলেও বাড়ানো ছাড়া শেখ হাসিনার হাতে আর কোনো বিকল্প নাই।
বিএনপির দায় : ৭ই নভেম্বরের সিপাহী জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত হন জেনারেল জিয়া। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও পরে প্রেসিডেন্ট থেকে অল্প সময়ের ব্যবধানে হয়ে ওঠেন জনতার জিয়া। শেখ মুজিবের কবর দেয়া গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে দেয়ার কোনো দায়বদ্ধতা ছিল না প্রেসিডেন্ট জিয়ার, কিন্তু দেশের মানুষকে তার স্বপ্নের গণতন্ত্র ফিরিয়ে দিলেন তিনি। যেই ক্ষমতাকে জেনারেল জিয়া বাধাহীনভাবে কুক্ষিগত করতেই পারতেন সেটি তিনি অবলীলায় জনগণের কাছে সমর্পণ করলেন, সবার জন্য রাজনীতিকে উš§ুক্ত করে দিলেন, সসম্মানে শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে তার সব সম্পত্তি বুঝিয়েও দিলেন। তার পূর্বসূরি যারা গণতন্ত্রের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল তাদের নৈতিকভাবে পরাজিত করে এভাবেই এক অনন্য উচ্চতায় আসীন হন প্রেসিডেন্ট জিয়া। এরপর এরশাদের বিপক্ষে বেগম জিয়ার দৃঢ়তা ও আপসহীনতা তাকেও শেখ হাসিনার সাপেক্ষে গ্রহণযোগ্যতা এনে দেয়। বেগম জিয়া ৯৬-এ জনগণ ও বিরোধীদের দাবির প্রতি সম্মান দেখিয়ে কোনো ধানাইপানাই না করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস করে ক্ষমতা ছেড়ে দেন। এত কিছুর পর যেটুকু দায় বিএনপি বা বেগম জিয়াকে দেয়া যায় সেটা হলো ২০০১-২০০৬ সাল মেয়াদে সরকার তেমন কোনো কারিশমা দেখাতে পারেনি। অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নিয়মতান্ত্রিক শাসনের পরিবর্তে কারিশমাটিক শাসন দেখানো জরুরি যেমন সাধারণ মানুষ দেশের রিজার্ভ, সামরিক ও কূটনৈতিক সক্ষমতা, শিক্ষার মান, টাকার মান এগুলো অনুধাবন করতে পারে না কিন্তু সেতু বা রাস্তার উন্নয়ন বোঝে। বিএনপির সব থেকে বড় দায় হলো সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের বয়স বাড়ানো। উদ্দেশ্য যেন পছন্দের বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক প্রধান করা যায়। এই বুদ্ধি ঠিক কোন ব্যারিস্টারের মস্তিষ্কপ্রসূত তা জানা না গেলেও এটি ছিল বিএনপির জন্য বড় ভুল। তবে সেখান থেকে পিছু হাটতে বাধ্য হয় বিএনপি; নিজের ভুলের ওপর অবিচল না থেকে, গোঁয়ার্তুমি না করে আপসমূলক ফয়সালার পথেই ফিরে আসে। যে কারণে রাজনীতির মাঠে বিএনপি তার পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়নি; বরং জনগণের কাছে গিয়ে তারা জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। বর্তমান সংকট হলো শেখ হাসিনা নিজেকে ছাড়া আর দ্বিতীয় কাউকে ভরসা করেন না, কিন্তু বিএনপি শেখ হাসিনা ছাড়া দ্বিতীয় যেকোনো গ্রহণযোগ্য ব্যক্তির ব্যাপারেই ইতিবাচক।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দায় : বাংলাদেশে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা ৭-৮% হলেও তারা একটি গুরুত্বপূর্ণ এনটিটি। এরা ঐতিহাসিকভাবেই আওয়ামী লীগের সমর্থক। তার একটা বড় কারণ ভারতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সুসম্পর্ক। আর দ্বিতীয় কারণ সম্ভবত প্রেসিডেন্ট জিয়া কর্তৃক ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা। ভারতের অনুকরণে আমাদের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা নিজেদের সংখ্যালঘু হিসেবে পরিচয় দেয় অনেক ক্ষেত্রে যা একেবারেই অনুচিত ও অসাংবিধানিক। রাষ্ট্র ও সংবিধান যেসকল নাগরিককে তার সর্বোচ্চ ও সমান অধিকার দেয় তারা কেউই সংখ্যালঘু নয়। খুব লক্ষণীয় বাংলাদেশে ধর্মের কারণে কোনো সামাজিক বিভাজন নেই, যেটা ভারতে ভয়ংকর রকম প্রকট এবং সেটি শুধু ইসলাম বা খ্রিষ্টান ধর্মের জন্যই নয়; বরং নিচু কাস্টের হিন্দুদের ক্ষেত্রেও লক্ষণীয় (খুব সম্প্রতি মনিপুর রাজ্যের জাতিগত দাঙ্গার কথা সবার জানা)। তবে বিভিন্ন পূজা-পার্বণে মন্দির বা মণ্ডপে যে হামলা হয় সেটিও অস্বীকার করার উপায় নেই। এই হামলা কখনই সামাজিক অসম্প্রীতির কারণে হয় না, এগুলো রাজনৈতিক ফায়দা লুফে নেয়ার জন্য সংগঠিত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আর কারা এগুলো ঘটায় সেটা সনাতন ধর্মের লোকদের কাছে পরিষ্কার। ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে যদি শত শত আলেমকে জেলে বন্দি করে রাখা যায়, শাপলা চত্বর ঘটানো যায়, ইসলামি নেতাদের বিচারের নামে ফাঁসি দেয়া যায়, ওয়াজের মঞ্চে ধারালো অস্ত্র নিয়ে বক্তাকে আক্রমণ করা যায় তাহলে হিন্দুদের মন্দিরে হামলাকে কোন যুক্তিতে সাম্প্রদায়িক ট্যাগ দেয়ার চেষ্টা করা হয়? ভারতে জাতিগত বৈষম্যের পরেও মুসলমানদের দেশ ত্যাগের প্রবণতা দেখা যায় না কিন্তু আমাদের দেশে কোনো জাতিগত বৈষম্য না থাকার পরেও হিন্দুদের দেশ ছাড়ার একটা প্রবণতা লক্ষণীয়, কেন? বাবরি মসজিদ বা গুজরাট দাঙ্গার সিকি ভাগও কি এদেশে ঘটেছে? কোনো দিন আর ঘটবেও না কখনও। একটি রাষ্ট্রের বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর মধ্যে চাওয়া-পাওয়ার তারতম্য থাকেই, আর যার যার চাওয়া পাওয়া ও অধিকার তাদেরকেই আদায় করে নিতে হয় নিজেদের সক্ষমতার বলে (যেমন বিসিএস পরীক্ষায় কোটা সংস্কার আন্দোলন)। তাই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেই কেবল বাংলাদেশের হিন্দুরা নিরাপদ এমন ধারণা কেবল হিন্দুদের অবস্থানকেই দুর্বল করে। জামায়াত ও হেফাজতে ইসলাম সংগ্রাম করতে গিয়ে জীবন দিতে পারলে হিন্দুদের পূর্ণ অধিকার রক্ষায় তাদেরকেও সংগ্রাম করেই তা অর্জন করতে হবে। কক্সবাজারের রামু থেকে ২০২১ সালের কুমিল্লা ও গাইবান্ধার ন্যকারজনক ঘটনার পর অন্তত হিন্দুদের আওয়ামীপ্রীতি থেকে বের হয়ে আশা উচিত। কারণ এই প্রেম তাদের সুরক্ষা দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। সুতরাং তাদের সুরক্ষার আন্দোলন তাদেরকেই করতে হবে আর এতে মুসলিম প্রতিবেশীরা তাদের সঙ্গেই থাকবে।
সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা যেভাবে প্রশ্নবিদ্ধ বিচার করে জামায়াত নেতাদের ফাঁসি দিয়েছে (বই লিখে সেটা আবার স্বীকারও করছে), কক্সবাজারের ওসি প্রদীপ যেভাবে একজন মেজরকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে, একজন হিন্দু নারী আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে গিয়ে যেভাবে কথা বলেছে, স্বাভাবিকভাবেই এসব কাজের দায় হিন্দুদের ওপরেও কিছুটা বর্তায়। তাই হিন্দু ভাই-বোনদেরকেই এই দায় থেকে নিজেদের মুক্ত করতে হবে (এই কথা বলার কারণ হলো ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি যেভাবে শিখ দেহরক্ষীদের দ্বারা নিহত হন, অনুরূপ জাতিগত দায়)। আর যেকোনো হামলা হলেই চোখ বন্ধ করে সেটিকে সাম্প্রদায়িক হামলা বলে অভিযোগ না করে সংঘাতে জড়িত সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করে তাদের রাজনৈতিক পরিচয় সামনে আনতে হবে। ব্যাঙের ছাতার নিচে থেকে সরে এসে হিন্দু সম্প্রদায়কে সব পক্ষকে তাদের গুরুত্ব বোঝাতে হবে; আলাপ-আলোচনা ও দর কষাকষির মাধ্যমে নিজেদের দাবি-দাওয়া আদায় করতে হবে। এর বিকল্প অন্যকিছু নেই।
এছাড়া প্রজাতন্ত্রের সব স্তরের কর্মচারী, সাধারণ জনগণ ও তরুণ প্রজন্মের লোভ লালসা ও রাজনৈতিক উদাসীনতা বর্তমান পরিস্থিতির জন্য সমানভাবে দায়ী।
[এই নিবন্ধে প্রকাশিত বক্তব্য সম্পূর্ণরূপে
লেখকের নিজস্ব মত]
শিক্ষক, রসায়ন বিভাগ
হাবিপ্রবি (যুক্তরাষ্ট্র থেকে)