ইসমাইল আলী: দেশের গ্যাসের মজুদের সাড়ে ৫২ শতাংশ শেষ হয়ে গেছে। বিদ্যমান ২৬টি গ্যাসক্ষেত্র থেকে সরবরাহ বাড়ার কোনো সম্ভাবনাও নেই। তবে নতুন ক্ষেত্র আবিষ্কার ও সমুদ্রসীমায় নতুন গ্যাস পাওয়া গেলে তা যুক্ত হবে মজুদের সঙ্গে। এসব গ্যাসও ২০৪১ সালের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। অর্থাৎ ওই সময় গ্যাসশূন্য হয়ে পড়বে বাংলাদেশ। যদিও গ্যাসের চাহিদা ওই সময় বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাবে।
সম্প্রতি পেট্রোবাংলায় অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে ‘ন্যাচারাল গ্যাস ডিমান্ড অ্যান্ড সাপ্লাই সিনারিও অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। এতে গ্যাসের সরবরাহ ও মজুদের এ তথ্য উঠে আসে।
তবে পেট্রোবাংলার হিসাবের সঙ্গে একমত নন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, প্রতি বছর বাড়ছে গ্যাসের চাহিদা। তবে গত কয়েক বছরে নতুন কোনো ক্ষেত্র আবিষ্কার হয়নি। ফলে স্থবির হয়ে পড়েছে গ্যাসের জোগান। ফলে গ্যাসের ঘাটতি বেড়ে চলেছে। তবে এখনও সমুদ্রসীমায় গ্যাস অনুসন্ধানই শুরু হয়নি। ফলে মজুদ কতটা রয়েছে তা নিশ্চিত নয়। এমনকি স্থলভাগেও মজুদের পরিমাণও নিরূপণ হয়নি। তাই মজুদ কবে শেষ হবে তা নিশ্চিত করা এখনই সম্ভব নয়।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বর্তমানে দৈনিক গড়ে ২ হাজার ৮৫৮ মিলিয়ন আদর্শ ঘনফুট (এমএমএসসিএফডি) সরবরাহ করা হচ্ছে। এর মধ্যে বাপেক্সের পুরোনো ক্ষেত্রগুলোয় মিলছে দুই হাজার ৭৯৪ মিলিয়ন ঘনফুট। আর বাপেক্সের নতুন ক্ষেত্র থেকে পাওয়া যাচ্ছে ৬৪ এমএমসিএফডি। আগামী বছর বাপেক্সের পুরোনো ও নতুন উভয় ধরনের ক্ষেত্র থেকে গ্যাস সরবরাহ কিছুটা বাড়বে। এতে মোট সরবরাহ তিন হাজার মিলিয়ন ঘনফুট ছাড়িয়ে যাবে। তবে এরপর থেকে বাপেক্সের পুরোনো ক্ষেত্রগুলোর গ্যাস সরবরাহ কমতে শুরু করবে। আর নতুন ক্ষেত্রগুলো থেকে কমতে শুরু করবে ২০২৫-২৬ সালের পর থেকে।
২০২০-২১ অর্থবছরে অগভীর সমুদ্র থেকে ২০০ মিলিয়ন গ্যাস যুক্ত হবে জাতীয় গ্রিডে। সে বছর মোট গ্যাস সরবরাহ বেড়ে দাঁড়াবে তিন হাজার ৭৩১ মিলিয়ন ঘনফুট। পরের কয়েক বছর অগভীর সমুদ্র থেকে প্রাপ্ত গ্যাসের সরবরাহ বাড়বে। তবে এ খাত থেকে সর্বোচ্চ ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি গ্যাস পাওয়া যাবে না। আর ২০২৬-২৭ অর্থবছরে মিলবে গভীর সমুদ্রের গ্যাসও। সে বছর জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। তবে এ খাত থেকে গড়ে সর্বোচ্চ ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি গ্যাস পাওয়া সম্ভব নয়।
এতে আরও বলা হয়, ২০৩৫-৩৬ অর্থবছরের পর বাপেক্সের পুরোনো ক্ষেত্রগুলোর গ্যাস ন্যূনতম পর্যায়ে এসে পৌঁছবে। নতুন ক্ষেত্রগুলোর সরবরাহ সে বছর শূন্য হয়ে যাবে। গভীর ও অগভীর সমুদ্রের গ্যাসও ওই বছর সরবরাহ অনেক কমে যাবে। আর ২০৪০-৪১ অর্থবছরে সব ধরনের মজুদ শেষ হবে যাবে।
জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল আলম শেয়ার বিজকে বলেন, দেশের গ্যাসের মজুদ নিয়ে এখনও বিস্তারিত কোনো সমীক্ষা হয়নি। আর স্থলভাগে গত পাঁচ-ছয় বছরে কোনো ধরনের এক্সপ্লোরেশন হয়নি। এতে বিদ্যমান ক্ষেত্রগুলোর উৎপাদন আগামীতে কমবে— এটা ঠিক। তবে সমুদ্রসীমায় এখনও সমীক্ষাই শুরু হয়নি। ফলে সেখানে কতটা গ্যাস মজুদ আছে তার কোনো ধারণাই নেই। তাহলে কোনো তথ্যের ভিত্তিতে পেট্রোবাংলা এ হিসাব করছে সেটা তারাই ভালো বলতে পারবে।
এদিকে গ্যাসের সরবরাহের নিম্নমুখী এ চিত্রের পাশাপাশি চাহিদার ঊর্ধ্বমুখী চিত্রও প্রতিবেদনে তুলে ধরে পেট্রোবাংলা। সংস্থাটির তথ্যমতে, চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দৈনিক গড়ে দুই হাজার ৮৫৮ এমএমএসসিএফডি গ্যাস সরবরাহের বিপরীতে চাহিদা রয়েছে তিন হাজার ৮০৪ এমএমএসসিএফডি। অর্থাৎ গ্যাসের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। যদিও বছর দুই আগে এ ঘাটতি ছিল ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট।
বর্তমানে গ্যাসের সবচেয়ে রয়েছে বেশি চাহিদা বিদ্যুৎ উৎপাদনে। এ খাতে ১ হাজার ৭৯৬ মিলিয়ন ঘনফুট চাহিদা রয়েছে। তবে চাহিদা অনুপাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস সরবরাহ করা যাচ্ছে না। এতে বসে রয়েছে বেশকিছু বিদ্যুৎ কেন্দ্র। আর ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে। এ ছাড়া শিল্পে গ্যাসের চাহিদা রয়েছে ৫৪২, ক্যাপটিভে ৪৮০, আবাসিকে ৪২৫, সারে ৩১৬, সিএনজিতে ১৩২ ও অন্যান্য খাতে ১১৩ মিলিয়ন ঘনফুট।
আগামীতে ধারাবাহিকে গ্যাসের চাহিদা বাড়বে। এতে ২০২০-২১ অর্থবছরে চাহিদা বেড়ে দাঁড়াবে ৪ হাজার ৮৫১ মিলিয়ন ঘনফুট। আর গ্যাসের জোগান বেড়ে দাঁড়াবে তিন হাজার ৫২৮ মিলিয়ন ঘনফুট। এতে ঘাটতি বেড়ে ১ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট ছাড়িয়ে যাবে। পরের দুই বছরও গ্যাসের জোগান বাড়বে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে গ্যাসের জোগান সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাবে। সে বছর এর পরিমাণ দাঁড়াবে ৩ হাজার ৭৯৪ মিলিয়ন ঘনফুট। আর ওই বছর চাহিদা বেড়ে দাঁড়াবে ৪ হাজার ৯৫৬ মিলিয়ন ঘনফুট। এর পরের বছর থেকে গ্যাসের চাহিদা বাড়লেও জোগান কমতে শুরু করবে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে গ্যাসের জোগান কমে দাঁড়াবে ৩ হাজার ৫১০ মিলিয়ন ঘনফুট। পরের বছর তা আরও কমে হবে তিন হাজার ২৪৬ মিলিয়ন ঘনফুট। আর চাহিদা দাঁড়াবে পাঁচ হাজার ঘনফুট ছাড়িয়ে যাবে। ফলে গ্যাসের ঘাটতি দাঁড়াবে প্রায় ১ হাজার ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট। আর ২০২৫-২৬ অর্থবছরে গ্যাসের সরবরাহ ও চাহিদা দাঁড়াবে যথাক্রমে ২ হাজার ৮৬২ ও ৫ হাজার ১১৪ মিলিয়ন ঘনফুট।
২০৩০-৩১ অর্থবছরে গ্যাসের সরবরাহ কমে দুই হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের নিচে নেমে আসবে। সে বছর সরবরাহের পরিমাণ দাঁড়াবে ১ হাজার ৭৬৬ মিলিয়ন ঘনফুট। আর চাহিদা বেড়ে দাঁড়াবে ৫ হাজার ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট। মজুদ ফুরিয়ে আসতে শুরু করায় ২০৩৫-৩৬ অর্থবছরে গ্যাসের সরবরাহ কমে দাঁড়াবে ৬২৮ মিলিয়ন ঘনফুট। আর চাহিদা বেড়ে ছয় হাজার ৬০৯ মিলিয়ন ঘনফুট। আর ২০৪০-৪১ অর্থবছরে চাহিদা দাঁড়াবে ৭ হাজার ১৪৫ মিলিয়ন ঘনফুট। তবে সে সময় গ্যাসের জোগান দাঁড়াবে শূন্য।
জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান আবুল মনসুর মো. ফয়জুল্লাহ বলেন, আগামীতে গ্যাসের চাহিদা ও জোগান কী হবে তার পূর্ণাঙ্গ চিত্র জানা নেই। তবে কিছু সমীক্ষা আর প্রক্ষেপণের ভিত্তিতে গ্যাসের চাহিদা ও সরবরাহ পরিস্থিতি নিরূপণ করা হয়েছে। মূলত ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতির অংশ হিসেবে এটি প্রণয়ন করা হয়েছে। বাস্তবিক চিত্র এর চেয়ে কিছুটা ভিন্ন হতে পারে। তবে খুব বেশি ভিন্ন হওয়ার সুযোগ নেই।