বিদ্যুৎ খাতের পরিকল্পিত উন্নয়নে মাস্টারপ্ল্যান চূড়ান্ত করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এতে আগের মাস্টারপ্ল্যানের ব্যর্থতা ও ২৫ বছর মেয়াদি নতুন পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়েছে। এ নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজনের তৃতীয় পর্ব
ইসমাইল আলী: ২০৪১ সালে উচ্চ আয়ের দেশে উন্নীত হবে বাংলাদেশ। এ সময় মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ১১ হাজার ডলার। এতে সে সময় দেশে বিদ্যুতের চাহিদা দাঁড়াবে ৫০ হাজার ৯৭৯ মেগাওয়াট। আর সে চাহিদা মেটাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা প্রয়োজন হবে ৫৬ হাজার ৭৩৪ মেগাওয়াট। এর মধ্যে গ্যাস ও কয়লা থেকে আসবে ৭০ শতাংশ। বাকিটা পারমাণবিক, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও আমদানির মাধ্যমে মেটানো হবে।
পাওয়ার সেক্টর মাস্টারপ্ল্যান ২০১৬ সালে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) অর্থায়নে এটি প্রণয়ন করছে টোকিও ইলেকট্রিক পাওয়ার সার্ভিস কোম্পানি। গত মাসে এ-সংক্রান্ত চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে জাইকা। এতে আগের মাস্টারপ্ল্যানের ব্যর্থতার পাশাপাশি ২০৪১ সাল পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহের গতিবিধি তুলে ধরা হয়েছে।
মাস্টারপ্ল্যানে কয়লা ও গ্যাস থেকে প্রায় সমান বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুপারিশ করেছে জাইকা। এতে ২০৪১ সালে কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা দাঁড়াবে ২০ হাজার ১৯৫ মেগাওয়াট। আর গ্যাস থেকে উৎপাদন হবে ১৯ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট। এ ছাড়া ভারত, নেপাল, ভুটান ও মিয়ানমার থেকে ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। আর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ আসবে সাত হাজার ৩২ মেগাওয়াট। এ ছাড়া তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলো থেকে ৭০০ ও হাইড্রো পাওয়ার আসবে ৩৩০ মেগাওয়াট। সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়াবে ৫৬ হাজার ৭৩৪ মেগাওয়াট।
এদিকে ২০২০ সালে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা দাঁড়াবে ১২ হাজার ৯৪৯ মেগাওয়াট। ২০৩০ সালে এ চাহিদা বেড়ে দাঁড়াবে ২৭ হাজার ৪৩৪ মেগাওয়াট। আর ২০৪১ সালে ৫০ হাজার ৯৭৯ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা থাকবে পিক সময়ে।
জাইকা বলছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিল্প খাতে দক্ষ যন্ত্রপাতির ব্যবহার বাড়বে। এতে ২০৪১ সালে ২০ শতাংশ বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে। আর বিদ্যুতের চাহিদা পরিমাপে দুই ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করে সংস্থাটি। প্রথমটি পরিমাণ করা হয় জিডিপি প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করে তার ভিত্তিতে। দ্বিতীয়টি অর্থনীতির খাতভিত্তিক চাহিদার ভিত্তিতে।
এতে দেখা যায়, ২০১৬-২০২০ সালের মধ্যে গড় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হার হবে সাত দশমিক চার শতাংশ। পরের পাঁচ বছরে তা অপরিবর্তিত থাকবে। ২০২৬-২০৩০ সময়ে গড় প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়িয়েছে ছয় দশমিক তিন শতাংশ, ২০৩১-২০৩৫ সময়ে গড়ে পাঁচ দশমিক তিন ও ২০৩৬-২০৪০ সময়ে চার দশমিক চার শতাংশ। তবে খাতভিত্তিক প্রবৃদ্ধি কিছুটা কম-বেশি হতে পারে। এক্ষেত্রে শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধির হার কম হলে বিদ্যুতের চাহিদা কমবে। এতে ২০৪১ সালে বিদ্যুতের চাহিদা দাঁড়াবে ৪৭ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট।
এদিকে তিন ধরনের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বিদ্যুতের সম্ভাব্য চাহিদা নিরূপণ করেছে জাইকা। এতে বলা হয়েছে স্বাভাবিক অবস্থায় ২০৪১ সালে বিদ্যুতের চাহিদা দাঁড়াবে ৫১ হাজার মেগাওয়াট। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি বেশি হলে ও শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হলে ২০৪১-এ বিদ্যুতের চাহিদা দাঁড়াবে ৫৫ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট। আর অর্থনীতি মন্দা কবলিত হলে ও প্রবৃদ্ধির গতি কমে গেলে নি¤œ পর্যায়ে ২০৪১ সালে বিদ্যুতের চাহিদা দাঁড়াবে ৪৮ হাজার মেগাওয়াট।
বিদ্যুতের চাহিদা পূরণে বছরভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন পরিকল্পনাও নির্দেশ করে জাইকা। এতে দেখা যায়, নতুন বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি পুরোনোগুলো অবসরে পাঠাতে হবে। এতে বর্তমানে বিদ্যমান কেন্দ্রগুলোর মধ্যে শুধু কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি থাকবে। এটি থেকে ২০৪১ সালে ২৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। আর ভারত থেকে বর্তমানে আমদানিকৃত ৫০০ মেগাওয়াটও বহাল থাকবে।
এদিকে পরিকল্পনাধীন ও পাইপ লাইনে থাকা বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর বেশিরভাগেরই ২০৪১ সালে কার্যকারিতা শেষ হবে। এতে সে সময় পাইপ লাইন থাকা কেন্দ্রগুলোর মধ্যে ১৩ হাজার ৫০৪ মেগাওয়াট কার্যকর থাকবে। এর মধ্যে প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে আসবে ৬০০ মেগাওয়াট। আর কয়লা থেকে উৎপাদন হবে ছয় হাজার ৭৯৫, গ্যাস থেকে তিন হাজার ৭৭৭, পারমাণবিক থেকে দুই হাজার ৩২ ও হাইড্রো পাওয়ার ১০০ মেগাওয়াট।
এর বাইরে ৪২ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে উদ্যোগ নিতে হবে। এর মধ্যে কয়লা থেকে ১৩ হাজার ৪০০, গ্যাস থেকে ১৫ হাজার ৭০০, তেলভিত্তিক ৭০০, পারমাণবিক চার হাজার ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। আর সাত হাজার ৯০০ মেগাওয়াট আমদানির উদ্যোগ নিতে হবে।
২০৪১ সালের বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি) অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। পাশাপাশি বেসরকারি খাতের বড় বিনিয়োগও লাগবে।
জানতে চাইলে পিডিবির চেয়ারম্যান খালেদ মাহমুদ শেয়ার বিজকে বলেন, ২০৪১ সালে বাংলাদেশ উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হবে। ফলে সে সময় বিদ্যুৎ ব্যবহারের ধরন পরিবর্তন হবে। সম্ভাব্য চাহিদাও অনেক বেড়ে যাবে। জাইকা সে সময়ের সম্ভাব্য চাহিদা প্রাক্কলন করে তার ভিত্তিতে উৎপাদন পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। ফলে এখন থেকে মাস্টারপ্ল্যানের ভিত্তিতে নতুন কেন্দ্র স্থাপন ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রকল্প গ্রহণের ব্যবস্থা করা হবে।
Add Comment