নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামে হঠাৎ করে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ডাকা ধর্মঘটে অচল হয়ে যায় স্বাস্ব্যসেবা। এতে ভোগান্তিতে পড়ে নগরবাসী। এ নিয়ে জনমনে ক্ষোভ ও ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তবে প্রশাসনের চাপে ২০ ঘণ্টার মধ্যে ধর্মঘট স্থগিত করেছে বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান মালিক সমিতি। গতকাল দুপুর ১২টার দিকে এ ধর্মঘট স্থগিত করা হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেন বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান সমিতির সভাপতি ডা. আবুল কাশেম।
সূত্রমতে, গত রোববার চট্টগ্রাম মহানগরের স্বাস্থ্য খাতে বিশৃঙ্খলা, অনিয়ম ও অপব্যবস্থাপনা রোধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান পরিচালনা করেন। দিনভর মেহেদীবাগ এলাকার ম্যাক্স হাসপাতাল, ওআর নিজাম রোডের মেট্রোপলিটন হাসপাতাল আর প্রবর্তক মোড়ের সিএসসিআর হাসাপাতালে একযোগে র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালিত হয়। এতে বেশকিছু ভয়াবহ অপরাধ চিহ্নিত ও জরিমানাও করা হয়। আর এ অভিযানের প্রতিবাদে সব বেসরকারি হাসপাতাল ও ল্যাব ঘোষণা করে প্রাইভেট হসপিটাল অ্যান্ড ল্যাব ওনারস অ্যাসোসিয়েশন।
এতে বিপাকে পড়েন আসা শত শত রোগীরা। নগরসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো বন্ধ থাকায় সেবাপ্রার্থীরা সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েন। এতে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। গত রোববার (৮ জুলাই) বিকাল ৫টা থেকে সোমবার (৯ জুলাই) দুপুর ১টা পর্যন্ত সাড়ে চার হাজার রোগী চমেক হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভর্তি হয়েছেন।
বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান সমিতির সভাপতি ডা. আবুল কাশেম বলেন, ‘আমরা অনেক কষ্টের মাধ্যমে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো প্রতিষ্ঠা করেছি। এসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আমরা সুষ্ঠুভাবে চালাতে চাই। এসব প্রতিষ্ঠানের ভুল-ভ্রান্তি আমরা সংশোধন করব। কিন্তু এসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে যদি লাখ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়, তা পরিশোধ কীভাবে করবে? এসব বিবেচনায় আমরা ধর্মঘট ডেকেছিলাম। সাময়িক দুর্ভোগের জন্য আমরা রোগীদের কাছে মাফ চাই।’
কেন ধর্মঘট স্থগিত করলেনÑএমন প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘পরিবেশ-পরিস্থিতি ও রোগীদের দুর্ভোগের বিষয় চিন্তা করে আমরা চট্টগ্রামের সব বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ডাকা ধর্মঘট সাময়িক স্থগিত করেছি।’
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চিকিৎসক ও একটি বেসরকারি হাসপাতালে পরিচালক শেয়ার বিজকে বলেন, এ ধর্মঘট পালন অবশ্যই মানবতাবিরোধী অপরাধ। আর এটা আসলে কিছু ব্যক্তিকে অন্যায়ভাবে সমর্থন দেওয়ার জন্য এ ধর্মঘট পালন করা হয়। পৃথিবীর কোথাও এভাবে রোগীদের জিম্মি করে দাবি আদায় করা হয় না। এটা নৈতিকতাবিরোধী কাজ। এজন্য তাদের সর্বোচ্চ শান্তি দেওয়া উচিত। তিনি আরও বলেন, এ ধর্মঘট পালনে ন্যূনতম ৫০ লাখ টাকা আর্থিক লোকসান হয়েছে এ খাতের উদ্যোক্তাদের। আর রোগীর অপূরণীয় ক্ষতি কে বহন করবে।
র্যাব ম্যাজিস্ট্রেট মো. সারওয়ার আলম বলেন, এভাবে রোগীদের জিম্মি করে সাধারণ মানুষের চিকিৎসাসেবা বন্ধ করে দেওয়া খুব অন্যায়। এত অপরাধ করার পরও সংশোধন না হলে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া উচিত। কারণ কেউ সরকারের চেয়েও বড় নন। সুতরাং অন্যায় করে পার পাওয়ার সুযোগ নেই। বিদেশে হলে তো সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ ঘোষণা দিত। আমাদের দেশে অনেক সুযোগ দেওয়া হয়।
উল্লেখ্য, গত ২৯ জুন শিশু রাইফা খান ভুল চিকিৎসায় মারা যাওয়ার পর থেকে আলোচনায় আসে ম্যাক্স হাসপাতাল। আর এ হাসপাতাল নিয়ে সরকারি একাধিক তদন্ত ও পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, চার বছরের অধিক সময় ধরে হাসপাতাল পরিচালনা করলেও নেওয়া হয়নি স্বাস্থ্য অধিদফতর, ওষুধ প্রশাসন, জয়েন্ট স্টক রেজিস্ট্রারের নিবন্ধন এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষেরও প্রয়োজনীয় অনুমোদন। শুধু সিটি করপোরেশনের ট্রেড লাইসেন্স চলছে বিতর্কিত এ হাসপাতাল। এমন তথ্য জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো। র্যাব ও ওষুধ প্রশাসনের অভিযানে ম্যাক্স হাসপাতালটির রোগ নিরূপণ কেন্দ্র (ল্যাব), ফার্মেসিসহ বিভিন্ন বিভাগে ব্যাপক অনিয়ম দেখতে পান ম্যাজিস্ট্রেট। তাদের পর্যবেক্ষণে উঠে আসে বিতর্কিত এ হাসপাতালের প্যাথলজি অনুমোদন নেই গত দুই বছর ধরে। সেখানে রোগীদের বিভিন্ন রিপোর্ট দেখে অসঙ্গতি পাওয়া যায়। কিন্তু রোগ নিরূপণ কেন্দ্রে (ল্যাব) কোনো পরীক্ষা না হলেও প্রতিদিন প্রচুর রিপোর্ট হয়। যে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সইতে এসব রিপোর্ট দেওয়া হতো তা-ও ছিল জাল। আর এসব রিপোর্ট তৈরি করত উচ্চ মাধ্যমিক পাস পিয়নরা। এ বিভাগে নেই বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ও কেমিস্ট। এছাড়া অপারেশনে ব্যবহৃত মেডিসিনও অবৈধ ও মেয়াদহীন। এসব অপরাধের জন্য ১০ লাখ টাকা জরিমানা করেন র্যাবের ম্যাজিস্ট্রেট মো. সারওয়ার আলম। দিনের অন্য আরেকটি অভিযানে সিএসসিআর হাসপাতালের বেশ কিছু অনিয়ম পান ভ্রামমাণ আদালত। অপারেশন থিয়েটারে কিছু সার্জিক্যাল ইনস্ট্র–মেন্ট পাওয়া গেছে যেগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ। কিছু কিছু ইনস্ট্র–মেন্টের মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১২ সালে। এছাড়া হাসপাতালের দুটি ফার্মেসির মধ্যে একটির লাইসেন্স নেই।

Print Date & Time : 26 June 2025 Thursday 3:56 am
২০ ঘণ্টা পর চট্টগ্রামে বেসরকারি হাসপাতালে ধর্মঘট স্থগিত
পত্রিকা ♦ প্রকাশ: