নয়ন খন্দকার, ঝিনাইদহ: ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম ভারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান মোবারকগঞ্জ চিনিকলে চলছে চরম দৈন্যদশা। মিলের গোডাউনে ২১ কোটি টাকার চিনি অবিক্রীত অবস্থায় পড়ে আছে। এছাড়া মিলের ট্যাংক ও পুকুরে পড়ে রয়েছে সাত কোটি টাকার চিটাগুড়। অন্যদিকে আখচাষিদের পাওনা আছে সাড়ে চার কোটি টাকা। চিনি বিক্রি না হওয়ায় মিলের ৮৫০ শ্রমিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না।
কলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনোয়ার কবীর জানিয়েছেন, ধীরগতিতে চিনি বিক্রির কারণে এমন অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। তারপরও পর্যায়ক্রয়ে শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন ও চাষিদের আখের বকেয়া টাকা পরিশোধ করা হচ্ছে। চিনি বিক্রি হলে সব সমস্যা কেটে যাবে বলে জানান তিনি। এদিকে চিনিকলের আখ দিয়ে সময়মতো টাকা না পাওয়ায় অনেক চাষি আখ চাষ থেকেও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।
চিনিকল সূত্রে জানা গেছে, চিনি বিক্রি না হওয়ায় কলের গোডাউনে ২১ কোটি টাকার তিন হাজার ৫০০ টন চিনি পড়ে আছে। এছাড়া মিলের ট্যাংক ও পুকুরে পড়ে আছে সাত কোটি টাকার ৩৫০ হাজার টন চিটাগুড়। এসব চিনি ও চিটাগুড় ঠিকমতো বিক্রি না হওয়ায় কলের ৮৫০ শ্রমিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীর তিন মাসের বেতন-ভাতা বকেয়া রয়েছে পাঁচ কোটি ১০ লাখ টাকা।
চিনিকলের প্রশাসন বিভাগের অফিস সহকারী আব্দার রহমানসহ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মচারী জানান, সর্বশেষ তারা মে মাসের বেতন পেয়েছেন। চলতি মাস ধরে প্রায় চার মাস বেতন-ভাতা বন্ধ রয়েছে। তারা আরও জানান, কলের গোডাউনে ২১ কোটি টাকার চিনি অবিক্রীত অবস্থায় পড়ে আছে। চিনি বিক্রি হচ্ছে না বলে তারা বেতন পাচ্ছেন না। এতে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন তারা। বাজারে অনেকেরই দেনা হয়ে গেছে।
অন্যদিকে গত মৌসুমে চিনিকলের আখ বিক্রি করে কৃষকরা তাদের বিক্রীত আখের মূল্য এখনও পাননি। বকেয়া টাকার জন্য তারা প্রায়ই মিলে ধরনা দিচ্ছেন। কিন্তু চিনি বিক্রি না হওয়ায় মিল কর্তৃপক্ষও তাদের বকেয়া টাকা দিতে পারছে না। এ কারণে অনেক চাষি আখ রোপণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। দিন দিন কমছে আখ চাষ। এতে কলটি আরও আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে বলে অভিজ্ঞরা মনে করছেন।
জানা গেছে, ২০১০-১১ মৌসুমে ১২ হাজার একর জমিতে আখ রোপণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। সেখানে অর্জিত হয় সাত হাজার ৪৫৪ একর। ২০১১-১২ মৌসুমে ১২ হাজার একর লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও অর্জিত হয় সাত হাজার আট একর। ২০১২-১৩ মৌসুমে ১১ হাজার একরের স্থলে অর্জিত হয় আট হাজার ৫০০ একর। এছাড়া ২০১৩-১৪ মৌসুমে ১১ হাজার একরের স্থলে তিন হাজার ৩২৬ একর, ২০১৪-১৫ মৌসুমে ১০ হাজার একরের স্থলে চার হাজার ৮৮৩ একর, ২০১৫-১৬ মৌসুমে ১০ হাজার ৫০০ একরের স্থলে চার হাজার ৯৪১ একর, ২০১৬-১৭ মৌসুমে ৯ হাজার একরের স্থলে ছয় হাজার ৮০ একর, ২০১৮-১৯ মৌসুমে ১০ হাজার ৫০০ একরের স্থলে ছয় হাজার পাঁচ একর এবং সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১১ হাজার একরের স্থলে অর্জিত হয় আট হাজার ৪০০ একর। গত ১০ মৌসুমে আখ চাষের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি।
মোবারকগঞ্জ চিনিকলের ডিজিএম আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘যথাসময়ে চাষিদের আখের টাকা দিতে না পারায় আখ চাষ কমে যাচ্ছে। গত মৌসুমের প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। যথাসময়ে টাকা দিতে পারলে আখ রোপণ বেড়ে যেত। এছাড়া পরিবহন, শ্রমিক সমস্যাসহ বর্তমানে কৃষকরা স্বল্পমেয়াদি ফসল করতে আগ্রহী হওয়ায় দীর্ঘমেয়াদি ফসল চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।’ এ সময় আখ রোপণ কমে যাওয়ায় কলের আটটি সাবজোন থেকে কমিয়ে এখন ছয়টি করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
কলের এ কর্মকর্তা জানান, চাষির স্বার্থ বিবেচনা করে ২০১৮-১৯ আখ মাড়াই মৌসুম থেকে মিল গেট ও আখ ক্রয় কেন্দ্রে মণপ্রতি ১৫ টাকা বেশি দরে আখ কেনা হচ্ছে। ২০১৭-১৮ আখ মাড়াই মৌসুম থেকে মিলগেটে আখ কেনা হচ্ছে প্রতি মণ (৪০ কেজি) ১২৫ টাকায়, আর বহিঃকেন্দ্রে প্রতি মণ (৪০ কেজি) ১২২ টাকা ৩৬ পয়সা দরে। বর্তমানে আখচাষিরা মণপ্রতি ১৫ টাকা করে দাম বেশি পাচ্ছেন। তার পরও চাষিদের ধরে রাখা যাচ্ছে না টাকা দিতে না পারায়।
এ বিষয়ে মোবারকগঞ্জ চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনোয়ার কবীর বলেন, মিলে ২১ কোটি টাকার চিনি ও সাত কোটি টাকার চিটাগুড় অবিক্রীত রয়েছে। ৮৫০ শ্রমিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী তিন মাসের বকেয়া বেতনভাতা বাবদ পাবেন পাঁচ কোটি ১০ লাখ টাকা। আর চাষিরা আখ বিক্রির বকেয়া পাবেন সাড়ে চার কোটি টাকা।
তিনি জানান, চিটাগুড় বিক্রির টেন্ডার দেওয়া হয়েছিল। টনপ্রতি ১৮ হাজার টাকা দর পাওয়া গেছে। কিন্তু চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের নির্দেশ রয়েছে টনপ্রতি ২২ হাজার টাকার নিচে বিক্রি করা যাবে না। তাই চিটাগুড়ও বিক্রি করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া ধীরগতিতে চিনি বিক্রির কারণে চাষিদের বকেয়া টাকা ও শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধে দেরি হচ্ছে। চিনি বিক্রি হলে সব সমস্যা কেটে যাবে বলে তিনি জানান।