বেলায়েত সুমন, চাঁদপুর: চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলায় চলমান ‘প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন প্রকল্প’ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। আদি ক্ষুদ্র পেশায় নিয়োজিত কামার, কুমার, নাপিত, বাঁশ-বেত, কাঁসা-পিতল ও জুতা মেরামত ও প্রস্তুতকারী প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে সরকার এ প্রকল্পটি হাতে নিলেও ফরিদগঞ্জে স্বজনপ্রীতি ও দলপ্রীতির কারণে পিছিয়ে পড়া ক্ষুদ্র পেশাজীবীদের উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত করার কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়েছে। ফলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিতসহ কাজের সুযোগ সৃষ্টি ও আত্মকর্মসংস্থানের ক্ষেত্র প্রস্তুতকরণে প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হচ্ছে না। প্রকল্প এলাকায় একটি সংঘবদ্ধ চক্রের কারসাজিতে প্রকল্পের অর্থ লোপাটের অভিযোগ ওঠে। অভিযোগের ভিত্তিতে শেয়ার বিজের অনুসন্ধানে উঠে আসে প্রকল্পে অনিয়মের আদ্যোপান্ত।
সূত্রমতে, ২০১৭ সালে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় সমাজসেবা অধিদপ্তর কর্তৃক বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন প্রকল্পটি হাতে নেয় সরকার। ওই বছরের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গৃহীত প্রকল্পটি পরে ২০১৯ সালের জুন মাসে প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে জুন ২০২২ পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। প্রথম পর্যায়ে সারাদেশের আটটি বিভাগের আটটি জেলার ৮২টি উপজেলায় পরে আটটি বিভাগের ২০টি জেলার ১০২টি এলাকায় কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে প্রকল্পে প্রথম সংশোধন করা হয়। পরে আবারও দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রকল্পে সংশোধন এনে আটটি বিভাগের ২৭টি জেলার ১১৭টি উপজেলাকে প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর মধ্যে চাঁদপুর জেলার শুধু ফরিদগঞ্জ উপজেলায় প্রকল্পের কার্যক্রম চালু হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৭-২০ সাল পর্যন্ত চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ধরা হয়েছে ৭৩৫ জন। এর মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী সফট স্কিল প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের ১২৫ জনকে ২০২০ সালের ২৩ ডিসেম্বর তিন দিনের নামমাত্র প্রশিক্ষণ শেষে ১৮ হাজার টাকা হারে ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকা অনুদান দেয়া হয়। অনুদানপ্রাপ্তদের মধ্যে কামার সাতজন, কুমার দুজন, মুচি ১০ জন, বাঁশবেত প্রস্তুতকারী ১০ জন ও নাপিত পেশার ৯৬ জনকে প্রকল্পের মাধ্যমে অনুদান দেয়া হয়। সফট স্কিলে অনুদানপ্রাপ্তদের নিজ নিজ পেশায় থাকা ওস্তাদদের প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘমেয়াদি হাতে-কলমে তিন থেকে ছয় মাসব্যাপী ওস্তাদ সাগরেদ প্যাটার্নে দুই সাগরেদের প্রশিক্ষণের সুযোগ রাখা হয়। সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী সাগরেদ ও ওস্তাদদের তিন মাসের প্রশিক্ষণ ভাতা ও সম্মানী প্রদান এবং প্রশিক্ষণ ভাতা ও সম্মানী প্রদান ছাড়া আরও তিন মাস ওস্তাদদের প্রতিষ্ঠানে সংযুক্ত রেখে অধিকতর দক্ষতা অর্জনের সুযোগ রাখা হয়।
আর ২০২০-২১ অর্থবছরে দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ খাতে ওস্তাদ-সাগরেদদের প্রশিক্ষণ ভাতা ও সম্মানী বাবদ ফরিদগঞ্জ উপজেলায় বরাদ্দ দেয়া হয় পাঁচ লাখ ১০৬ টাকা। প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা ফরিদগঞ্জ উপজেলায় সফট স্কিলে অনুদানপ্রাপ্তদের নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে ওস্তাদ-সারগেদ প্রশিক্ষণ চলমান রয়েছে বলে কাগজে-কলমে দেখিয়ে প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। অনুসন্ধানে এর সত্যতাও খুঁজে পাওয়া যায়। অনুসন্ধানে সফট স্কিলে অনুদানপ্রাপ্তদের বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানেই সাগরেদদের দেখা পাওয়া যায়নি। এমনকি অনেক প্রতিষ্ঠানে সাইনবোর্ডের হদিস পাওয়া যায়নি।
প্রকল্পের নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, ফরিদগঞ্জ সমাজসেবা অফিস থেকে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে যে নথি পাঠানো হয়েছে, সেখানে সফট স্কিলে অনুদানপ্রাপ্ত ওস্তাদ-সাগরেদসহ সর্বমোট ২৪৬ জনের তালিকা রয়েছে, যাদের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৪৪ লাখ ২৮ হাজার টাকা। এ তালিকায় কে ওস্তাদ আর কে প্রশিক্ষণ নেয়া সাগরেদ, তার উল্লেখ নেই। অভিযোগ ওঠে সফট স্কিলে অনুদানপ্রাপ্তদের যোগসাজশে সাগরেদদের প্রশিক্ষণের বরাদ্দকৃত অর্থের একটা অংশ আত্মসাৎ করা হয়েছে।
অনুদানপ্রাপ্তদের মধ্যে অধিকাংশ নরসুন্দর বলেছেন, ২০১৯ সালে অনুদান পেয়েছেন যদিও প্রকল্পের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে অনুদান দেয়া হয়েছে ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে। অনুদানের তালিকাভুক্ত অনেকেই আধিপেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকলেও অনুদান পেয়েছেন। আবার ২১ বছর থেকে ৪১ বছর পর্যন্ত আদি পেশায় সম্পৃক্ত থাকা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নরসুন্দর পেশার অনেকের ভাগ্যে জোটেনি এই প্রকল্পের সুযোগ-সুবিধা। চলমান জরিপেও তাদের নাম ওঠেনি প্রকল্পের তালিকায়। এছাড়া প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অন্যান্য পেশার অধিকাংশ মানুষকেও প্রকল্পের আওতাভুক্ত করা হয়নি নিয়ম অনুযায়ী।
ফরিদগঞ্জের ভাটিরগাঁয়ের আরিফ নামে এক অনুদানপ্রাপ্ত জুতা তৈরির কারিগর শেয়ার বিজকে বলেন, তিনি ২০১৯ সালে ৯ হাজার টাকা অনুদান পেয়েছেন। পরে আবার ১৮ হাজার টাকা অনুদান পেয়েছেন। কিন্তু ২০১৯-২০ সালের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সফট স্কিলে অনুদানপ্রাপ্তদের তালিকায় মাস্টাররোলে আরিফের নাম নেই, নাম আছে ২০২২ সালের অনুদানপ্রাপ্তদের মধ্যে মুচি পেশার তালিকায়। ৯ হাজার টাকা তিনি কীভাবে পেলেন, সে প্রশ্নের উত্তর তিনি দিতে পারেননি।
নিসার উদ্দিন নামের ফরিদগঞ্জের আরেক নির্মাণ শ্রমিক বলেন, তিনি ইমারত নির্মাণের কাজ করেন। প্রকল্প থেকে তিনি একবার ১৮ হাজার পরে আবার চার হাজার টাকা অনুদান পেয়েছেন। নিসার উদ্দিন সফট স্কিলে কোনো ওস্তাদের আওতায় থেকে কাজ শিখে ওস্তাদের যোগ্যতা অর্জন করলে প্রকল্পের নিয়ম অনুযায়ী পাঁচ হাজার টাকা না পেয়ে চার হাজার টাকা পেয়েছেন।
ফরিদগঞ্জের সাহার বাজারের জীবন চন্দ্র শীল ৪১ বছর যাবৎ নরসুন্দর পেশায় আছেন। বাবার আধিপেশাকে ধরে রেখেছেন। একই বাজারের ভাষান চন্দ্র শীল ২১ বছর পর্যন্ত এ পেশায় আছেন। প্রকল্পে সাম্প্রদায়িক স্বজনপ্রীতির কারণে তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়নি। সেলুন মালিকদের নিয়ন্ত্রণে যারা আছেন, তাদেরই এ প্রকল্পের অনুদান দেয়া হয়েছে এবং আদি পেশায় থাকায় অনেকেরই স্বজনপ্রীতির কারণে বাদ পড়ারও অভিযোগ রয়েছে।
২০২২ সালের মে মাসে অনুরূপভাবে ফরিদগঞ্জে ১২১ জনকে ১৮ হাজার টাকা হারে মোট ২১ লাখ ৭৮ হাজার টাকা অনুদান দেয়া হয়েছে। নাসিমা আক্তার নামে চরবসন্ত গ্রামের বাঁশ-বেতের কাজ করা এক নারী বলেন, তিন দিন প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি প্রশিক্ষণ ভাতা কত পেয়েছেন, তা জানেন না। এককালীন পেয়েছেন ১৮ হাজার টাকা। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণের এককালীন অনুদানপ্রাপ্তদের ২৪৬ জনের তালিকায় এ নারীর নাম রয়েছে। আবার সফট স্কিলে অনুদানপ্রাপ্তদের তালিকাতেও এ নারীর নাম রয়েছে। সচেতন মহলে প্রশ্ন উঠেছে, এ উপজেলায় সফট স্কিলে প্রশিক্ষণ নেয়া ওস্তাদদের কাছে দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ নেয়া সাগরেদরা এখন কোথায়?
২০১৭-২০২০ সাল পর্যন্ত অনুদানপ্রাপ্তদের তালিকা প্রস্তুতকালে ফরিদগঞ্জ সমাজসেবা কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন শাহাদাত হোসেন। বর্তমানে তিনি হাজীগঞ্জ উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। প্রকল্পের অর্থ প্রকৃত উপকারভোগীদের মাঝে সঠিকভাবে বণ্টন করা হয়নি কেনÑএমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তালিকা যাচাই-বাছাই শেষে অনুদান দেয়া হয়েছে। এখানে অনিয়মের কোনো সুযোগ নেই।
অপরদিকে একই কথা বলেছেন ফরিদগঞ্জ উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মুহাম্মদ মাহমুদুল হাসান। তিনি বলেন, দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ গ্রহণকারীদের তালিকা নিতে হলে একটা দরখাস্ত দিয়ে নিতে হবে। যদিও এ কর্মকর্তা দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী ও সফট স্কিলে ২৪৬ জনের একই অনুদানপ্রাপ্তদের একটি তালিকা ক্রমিক পরিবর্তন করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানোর পর প্রকল্পের বাস্তবায়ন অগ্রগতি শতভাগ দেখানো হয়েছে।
বর্তমানে চাঁদপুর জেলাব্যাপী প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ডেটা এন্ট্রি জরিপ কার্যক্রম চলমান। এ জরিপ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রকল্প থেকে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে এক লাখ ৩০ হাজার টাকা। এর মধ্যে হাজীগঞ্জ, কচুয়া, চাঁদপুর সদর, ফরিদগঞ্জ, মতলব উত্তর মতলব দক্ষিণ ও শাহরাস্তি উপজেলাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, এসব উপজেলায়ও আদি পেশার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত না করে ডেটা এন্ট্রির কাজ চলমান রয়েছে। ফলে অতিদরিদ্র আদি পেশার একটা বড় অংশ এখনও এ কর্মসূচির আওতায় আসতে পারেনি। এমনকি প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মূল উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হচ্ছে না।