Print Date & Time : 16 June 2025 Monday 9:00 pm

২২ বিদ্যুৎকেন্দ্রে বছরে গচ্চা দুই হাজার ৩০০ কোটি টাকা

বিদ্যুতের ঘাটতি মেটাতে ২০০৯ সালে বেশকিছু রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হয়। অদক্ষ এসব কেন্দ্রের উৎপাদন ব্যয় অনেক বেশি। যদিও করোনার কারণে বর্তমানে বিদ্যুতের চাহিদা কমে যাওয়ায় কেন্দ্রগুলোর বেশিরভাগই বসে থাকছে। ফলে বোঝা হয়ে ওঠা রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা চলছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরকারের আর্থিক ক্ষতির বিষয়ে অনুসন্ধান করেছে শেয়ার বিজ। এ নিয়ে আজ ছাপা হচ্ছে ধারাবাহিকের দ্বিতীয় পর্ব

ইসমাইল আলী: ঘোড়াশালে ১৪৫ মেগাওয়াটের রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ২০১০ সালের আগস্টে নির্মাণ করে এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল। বেসরকারি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটির চুক্তি ২০১৬-১৭ অর্থবছর শেষ হওয়ার কথা ছিল। পরে এ চুক্তি নবায়ন করা হয়। এতে কেন্দ্রটির জন্য প্রতি মেগাওয়াটে দৈনিক ৫০০ ডলার হারে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হচ্ছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি)। এতে উৎপাদন বন্ধ থাকলেও কেন্দ্রটির জন্য মাসে ১৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা দিতে হয় পিডিবি। আর বছরে এ চার্জ পড়ছে ২০৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা।

একই কোম্পানির ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রয়েছে ৮৫ মেগাওয়াটের গ্যাসচালিত আরেকটি রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। চুক্তি নবায়নের পর এটির মেগাওয়াটপ্রতি দৈনিক ক্যাপাসিটি চার্জ পড়ছে ৪৬৬ দশমিক ৬৭ ডলার। এতে কেন্দ্রটির মাসিক ক্যাপাসিটি চার্জ ৯ কোটি ৫২ লাখ টাকা। আর বছরে চার্জ ১১৪ কোটি ২৪ লাখ টাকা।

সিদ্ধিরগঞ্জে দেশ এনার্জির ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ক্যাপাসিটি চার্জ মাসিক ১৫ কোটি ১৬ লাখ টাকা। আর কেন্দ্রটির দৈনিক চার্জ এক্ষেত্রে ৬৩১ দশমিক ৬৭ ডলার। এ হারে বছরে কুইক রেন্টাল কেন্দ্রটির ক্যাপাসিটি চার্জ দাঁড়ায় ১৮১ কোটি ৯২ লাখ টাকা। যদিও মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটির চুক্তি নবায়ন করা হয়।

২০১৭-১৮ অর্থবছরের শুরুর দিকে এভাবেই ২২টি রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি নবায়ন করে সরকার। এসব কেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা এক হাজার ৫৮২ দশমিক ৫০ মেগাওয়াট। এর মধ্যে রয়েছে ৯টি ফার্নেস অয়েল, তিনটি ডিজেল ও ১০টি গ্যাসচালিত কেন্দ্র। এ্রগুলোর মাসিক ক্যাপাসিটি চার্জ ১৯১ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। এতে বছরে এ চার্জ বাবদ পিডিবিকে গুনতে হবে প্রায় দুই হাজার ৩০২ কোটি টাকা। অথচ চাহিদা না থাকায় বেশিরভাগ কেন্দ্রই সারা বছর বসিয়ে রাখা হয়। কখনও কখনও নামমাত্র উৎপাদন করা হয় কেন্দ্রগুলোতে। ফলে ক্যাপাসিটি চার্জের প্রায় পুরোটাই এখন গচ্চা যাচ্ছে।

রেন্টাল-কুইক রেন্টালের এসব চুক্তি নবায়নে যথাযথভাবে দরকষাকষি করা হয়নি বলে মনে করেন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম। তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, ২০১০-১১ সালে চালুর সময় বলা হয়েছিল, মেয়াদশেষে এসব কেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া হবে। তবে অজ্ঞাত কারণে এগুলোর চুক্তি দফায় দফায় নবায়ন করা হলো। আর চুক্তি নবায়নেও ক্যাপাসিটি চার্জ খুব বেশি কমানো হয়নি।

তিনি আরও বলেন, ২২টি বিদ্যুৎকেন্দ্রে নতুন করে কোনো মূলধনি বিনিয়োগ নেই। তাই নবায়নের সময় যে ক্যাপাসিটি চার্জ ধার্য করা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। এসব কেন্দ্রে খাতে সর্বোচ্চ ৪০০ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া উচিত ছিল। এতে বছরে এক হাজার ৯০০ কোটি টাকা সাশ্রয় করা যেত।

পিডিবির হিসাবমতে, প্রাথমিকাভাবে ২২টি কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল দুই হাজার ৯৫৭ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। চুক্তি নবায়নে তা কমানো হয়েছে মাত্র ২২ দশমিক ১৩ শতাংশ। যদিও প্রাথমিক মেয়াদেই (তিন বা পাঁচ বছরে) এসব কেন্দ্রের নির্মাণ ব্যয় উঠে গেছে।
নবায়ন করা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে মেগাওয়াটপ্রতি দৈনিক সর্বোচ্চ ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হচ্ছে পাগলার ডিজেলচালিত ডিপিএ কেন্দ্রটির জন্য। ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটির দৈনিক ক্যাপাসিটি চার্জ ৬৮৬ দশমিক ৬৭ ডলার। মাসিক হিসাবে এ হার পড়ে আট কোটি ২৪ লাখ টাকা আর বছরে ৯৮ কোটি ৮৮ লাখ টাকা।

ঘোড়াশালের ম্যাক্স পাওয়ার কেন্দ্রটিতে বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ ১১২ কোটি ৩২ লাখ টাকা। গ্যাসচালিত কেন্দ্রটির বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৭৮ মেগাওয়াট। এতে মেগাওয়াটপ্রতি দৈনিক ক্যাপাসিটি চার্জ পড়ে ৫০০ ডলার। একই হারে চার্জ গুনতে হচ্ছে আশুগঞ্জের ৫৩ মেগাওয়াট, সিলেটের ৫০ ও ভোলার ৩৪ দশমিক ৫০ মেগাওয়াটের কেন্দ্র তিনটিতে।

এদিকে সামিটের ১০২ মেগাওয়াটের রেন্টাল কেন্দ্রের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে বছরে ১২৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা। আর সামিট-ইউনাইটেড গ্রুপের যৌথ উদ্যোগের কেন্দ্র কেপিসিএল-২ কেন্দ্রটির জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হচ্ছে ১৪৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা। এ কেন্দ্রটির বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ১১৫ মেগাওয়াট। কেন্দ্র দুটির মেগাওয়াটপ্রতি দৈনিক ক্যাপাসিটি চার্জ একই, অর্থাৎ ৪৩৩ দশমিক ৩৩ ডলার। একই হারে চার্জ গুনতে হচ্ছে মেঘনাঘাট ১০০, নোয়াপাড়া ৪০, ঝুলধা ১০০ ও ডাচ্-বাংলার সিদ্ধিরগঞ্জ ১০০ মেগাওয়াট কেন্দ্রগুলোয়।

এর বাইরে ৪৩০ ডলার হারে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে কেরানীগঞ্জ (পাওয়ার প্যাক), আমনুরা ও কাটাখালি কেন্দ্র তিনটিতে। এগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা যথাক্রমে ১০০, ৫০ ও ৫০ মেগাওয়াট। আর ৪৬৬ দশমিক ৬৭ ডলার হারে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে আশুগঞ্জের প্রিসিশন এনার্জি বিদ্যুৎকেন্দ্রে। এটির উৎপাদন ক্ষমতা ৫৫ মেগাওয়াট। একই হারে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে এগ্রিকোর ডিজেলচালিত ৫৫ মেগাওয়াট কেন্দ্রটিতে।
এছাড়া এনার্জিপ্রিমার সিলেট ও হবিগঞ্জের গ্যাসচালিত কেন্দ্র দুটিতেও ক্যাপাসিটি চার্জ ৪৬৬ দশমিক ৬৭ ডলার। এগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা ৫০ মেগাওয়াট করে। একই গ্রæপের বগুড়া কেন্দ্রটির উৎপাদন ক্ষমতা ২০ মেগাওয়াট। এটির জন্য মেগাওয়াটপ্রতি দৈনিক ক্যাপাসিটি চার্জ ৪১৬ দশমিক ৬৭ ডলার। রেন্টাল কেন্দ্রের মধ্যে সবচেয়ে কম ক্যাপাসিটি চার্জ এ কেন্দ্রেই।