Print Date & Time : 18 June 2025 Wednesday 5:33 am

২২ মাসে বিদ্যুতে ভর্তুকি দিতে হবে ১২ বছরের চেয়ে বেশি!

ইসমাইল আলী: ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে বিদ্যুৎ খাতে বড় অঙ্কের লোকসান গুনছে সরকার। বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনে কম মূল্যে বিক্রি করায় এ লোকসান গুনতে হচ্ছে। তবে ঘাটতি পূরণে ১২ বছরে ৯ বার বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। পাশাপাশি মোটা অঙ্কের ভর্তুকি পাচ্ছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। প্রতি বছর এ খাতে ব্যয় বাড়লেও গত অর্থবছর তা অস্বাভাবিক পর্যায়ে পৌঁছায়। ক্রমেই তা আরও ভয়াবহ আকার নিচ্ছে।

পিডিবির তথ্যমতে, ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১১ বছর আট মাসে পিডিবিকে ভর্তুকি দেয়া হয়েছে ৮২ হাজার ১৩৯ কোটি ২৭ লাখ টাকা। তবে মার্চ থেকে ভর্তুকি ছাড় বন্ধ রেখেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এতে গত অর্থবছরের চার মাসেই ভর্তুকি বকেয়া পড়েছে ১৪ হাজার ৪৩৭ কোটি টাকা। আর গত জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৮ মাসে আরও ভর্তুকি লাগবে ৮০ হাজার ৫৩৯ কোটি টাকা।

সব মিলিয়ে আগামী বছর ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্থ মন্ত্রণালয়কে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দিতে হবে ৯৪ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকা। পিডিবির সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। গত সপ্তাহে বিদ্যুতের বাল্ক মূল্যহার বৃদ্ধির প্রস্তাব খারিজের পর এ প্রতিবেদনটি প্রণয়ন করে পিডিবি। এতে বিদ্যুৎ খাতের বর্তমান পরিস্থিতি ও আগামী দুই বছরের সম্ভাব্য গতিবিধি তুলে ধরা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে গত অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। এতে ২০২১-২২ অর্থবছর রেকর্ড লোকসানের মুখে পড়েছে পিডিবি। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত অর্থবছরের জন্য ২৮ হাজার ৯২৫ কোটি টাকা ভর্তুকি চাওয়া হয়েছে। যদিও ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আট মাসের জন্য ভর্তুকি ছাড় করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এর পরিমাণ ১৪ হাজার ৪৮৮ কোটি টাকা। বাকি চার (মার্চ-জুন) মাসের জন্য ভর্তুকি চাওয়া হয়েছে ১৪ হাজার ৪৩৭ কোটি টাকা। তবে গত অর্থবছর বরাদ্দ না থাকায় তা ছাড় করেনি অর্থ মন্ত্রণালয়।

এর আগে ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত ৬৭ হাজার ৬৫১ কোটি ২৭ লাখ টাকা ভর্তুকি দেয়া হয়েছে পিডিবিকে। যদিও এর মধ্যে ঋণ হিসেবে দেয়া হয় ৪৩ হাজার ১৬০ কোটি ১২ লাখ টাকা। তবে লোকসানে থাকায় সে ঋণ আর ফেরত দিতে পারেনি পিডিবি। ওই ঋণকে ভর্তুকি রূপান্তরের জন্য কয়েক দফা অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়া হয়েছে। বাকি ২৪ হাজার ৪৯১ কোটি ১৫ লাখ টাকা ভর্তুকি সরাসরি অনুদান হিসেবে প্রদান করে অর্থ মন্ত্রণালয়।

এদিকে চলতি অর্থবছরের জন্য পিডিবি ভর্তুকি প্রাক্কলন করেছে ৫০ হাজার ১৭ কোটি টাকা। তবে চলতি অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ আছে মাত্র ১৭ হাজার কোটি টাকা। আর আগামী অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসের জন্য ভর্তুকি প্রাক্কলন করা হয়েছে ২৯ হাজার ৫২২ কোটি টাকা। মূলত নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসায় ক্যাপাসিটি চার্জের বোঝা বাড়ছে। এ কারণে ভর্তুকি বাড়ছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে। এজন্যও ভর্তুকির পরিমাণ বাড়াতে হচ্ছে।

জানতে চাইলে পিডিবির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, গত অর্থবছরের জন্য যা ভর্তুকি চাওয়া হয়েছিল, তার অর্ধেক পাওয়া গেছে। চলতি অর্থবছর সাড়ে তিন মাস পেরিয়ে গেলেও বাকি অর্থ ছাড় করা হয়নি। আর চলতি অর্থবছরের জন্য বাজেটে ১৭ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও তা গত অর্থবছরের চাহিদা মেটাতেই শেষ হয়ে যাবে। এ অবস্থায় বিদ্যুৎ উৎপাদন চালিয়ে নেয়াই দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে।

তিনি আরও বলেন, গত জানুয়ারিতে বিদ্যুতের বাল্ক (পাইকারি) মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছিল। গত মে মাসে তার ওপর শুনানি করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। তবে গত সপ্তাহে তা খারিজ করে দেয়া হয়। এরপর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জানানো হয় আগামী নির্বাচনের আগে বিদ্যুতের দাম আর বাড়ানো হবে না। এজন্য ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত পিডিবির সম্ভাব্য ভর্তুকি চাহিদার তথ্য চাওয়া হয়। এজন্য খসড়া হিসাব প্রণয়ন করা হয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম হ্রাস-বৃদ্ধি পেলে ভর্তুকির চাহিদাও পরিবর্তিত হবে।

সূত্র জানায়, গত মার্চ থেকে ভর্তুকির অর্থ ছাড় বন্ধ রাখায় বড় ধরনের আর্থিক সংকটের মুখে পড়েছে পিডিবি। এতে গত পাঁচ মাসেই প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা বকেয়া জমে গেছে পিডিবির। এর মধ্যে সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বকেয়া বিল ৩৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। এ অর্থ ছাড় না করায় বেসরকারি বেশকিছু বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ রাখা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে বড় অঙ্কের লোকসান শুরু করে পিডিবি। সে অর্থবছর সংস্থাটিকে ভর্তুকি দেয়া হয় চার হাজার কোটি টাকা। পরের অর্থবছর (২০১১-১২) তা বেড়ে দাঁড়ায় ছয় হাজার ৩৫৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকায়। ২০১২-১৩ অর্থবছর পিডিবিকে ভর্তুকি দেয়া হয় চার হাজার ৪৮৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা, ২০১৩-১৪ অর্থবছর ছয় হাজার ১০০ কোটি, ২০১৪-১৫ অর্থছর আট হাজার ৯৭৮ কোটি ৯ লাখ, ২০১৫-১৬ অর্থবছর চার হাজার ৩৬৫ কোটি ২৪ লাখ এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছর তিন হাজার ৯৯৪ কোটি ৫২ লাখ টাকা। ওই অর্থবছর পর্যন্ত ভর্তুকির অর্থ ঋণ হিসেবে দেয়া হতো।

২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে অনুদান হিসেবে পিডিবিকে ভর্তুকি দেয়া শুরু হয়। ওই অর্থবছর ভর্তুকি দেয়া হয়েছিল পাঁচ হাজার ৪৮৫ কোটি ৮১ লাখ টাকা। পরের (২০১৮-১৯) অর্থবছর ভর্তুকি দেয়া হয় সাত হাজার ৫০০ কোটি ৪৪ লাখ টাকা, ২০১৯-২০ অর্থবছরে সাত হাজার ৪৩৯ কোটি ৪৪ লাখ এবং ২০২০-২১ অর্থবছর দেয়া হয় ১১ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা।