Print Date & Time : 21 June 2025 Saturday 4:20 pm

২৩ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৪টির শেয়ারদর ১০ টাকার নিচে!

সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় (এনবিএফআই) অপব্যবস্থাপনা ও জাল-জালিয়াতির নেতিবাচক প্রভাব এখনও অব্যাহত রয়েছে। এতে এসব প্রতিষ্ঠানে সব শ্রেণির গ্রাহকসংখ্যা কমে যাচ্ছে। গত এক বছরের ব্যবধানে আমানতধারীর হিসাব কমেছে ১৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ এবং ঋণ বা বিনিয়োগ হিসাব কমেছে ২ দশমিক ৫২ শতাংশ। এগুলোর প্রভাবে পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত ২৩টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৪টির শেয়ারদর ফেস ভ্যালুর (অভিহিত দর) নিচে অবস্থান করছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্যমতে, বর্তমানে দেশের ৩৫টি ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর মধ্যে পুঁিজবাজারের তালিকাভুক্ত ২৩টি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৪টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ারদর ফেস ভ্যালুর নিচে অবস্থান করছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলোÑবে লিজিং, ফারইস্ট ফাইন্যান্স, ফাস ফাইন্যান্স, ফার্স্ট ফাইন্যান্স, জিএসপি ফাইন্যান্স, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, ইসলামিক ফাইন্যান্স, ফিনিক্স ফাইন্যান্স, পিপলস লিজিং, মাইড্যাস ফাইন্যান্স, প্রিমিয়ার লিজিং, প্রাইম ফাইন্যান্স, ইউনিয়ন ক্যাপিটাল এবং ইউনাটেড ফাইন্যান্স।

গত বৃহস্পতিবার সর্বশেষ লেনেদেন হওয়া দর অনুসারে, বে লিজিংয়ের শেয়ারদর ছিল ৯ টাকা ১০ পয়সা, ফারইস্ট ফাইন্যান্স তিন টাকা ৭০ পয়সা, ফাস ফাইন্যান্স তিন টাকা ৬০ পয়সা, ফার্স্ট ফাইন্যান্স চার টাকা ৩০ পয়সা, জিএসপি ফাইন্যান্স ৯ টাকা ১০ পয়সা, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং চার টাকা ১০ পয়সা, ইসলামিক ফাইন্যান্স আট টাকা ৯০ পয়সা, ফিনিক্স ফাইন্যান্স ছয় টাকা ৬০ পয়সা, পিপলস লিজিং তিন টাকা ১০ পয়সা, মাইড্যাস ফাইন্যান্স আট টাকা ৩০ পয়সা, প্রিমিয়ার লিজিং ছয় টাকা ৭০ পয়সা, প্রাইম ফাইন্স্যাস ছয় টাকা ৭০ পয়সা, ইউনিয়ন ক্যাপিটাল ছয় টাকা ৯০ পয়সা এবং ইউনাটেড ফাইন্যান্স ছিল ছয় টাকা ৬০ পয়সা।

অপরদিকে বিডি ফাইন্যান্স, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফসি), ডিবিএইচ, ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি), আইডিএলসি, লংকাবাংলা ফাইন্যান্স, আইপিডিসি, ন্যাশনাল হাউজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স এবং উত্তরা ফাইন্যান্সের শেয়ারদর ছিল ফেস ভ্যালুর ওপরে।

গত ডিসেম্বর পর্যন্ত তথ্যের ভিত্তিতে ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০২২ সালের ডিসেম্বরে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় মোট আমানত হিসাব ছিল পাঁচ লাখ ২২ হাজারটি। গত বছরের (২০২৩) ডিসেম্বরে তা কমে দাঁড়িয়েছে চার লাখ ৩১ হাজারটি। গত এক বছরের ব্যবধানে আমানতের হিসাব কমেছে ৯১ হাজার বা ১৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কমেছে ব্যক্তি আমানতের হিসাব। তবে বেড়েছে উদ্যোক্তা আমানতের হিসাব। তারা একই প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেয়ার বিপরীতে আমানত রাখে বলে এ হিসাব বেড়েছে।

অপরদিকে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে এনবিএফআইগুলোর ঋণ বা বিনিয়োগ হিসাব ছিল দুই লাখ ২৫ হাজার ৩৯২টি। গত বছরের ডিসেম্বরে তা কমে দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ১৯ হাজার ৭০৫টিতে। এক বছরের ব্যবধানে ঋণ হিসাব কমেছে পাঁচ হাজার ৬৮৭টি বা ২ দশমিক ৫২ শতাংশ।

আমানত ও ঋণ হিসাব কমলেও পরিমাণের দিক থেকে দুটোই সামান্য বেড়েছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে আমানত ছিল ৪৩ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা। গত বছরের ডিসেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৪ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা। এক বছরে আমানত বেড়েছে মাত্র ১০৯ কোটি ২৯ লাখ টাকা। বৃদ্ধির হার শূন্য দশমিক ২৪ শতাংশ।

আর ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বিনিয়োগ ছিল ৭০ হাজার ৩২২ কোটি টাকা। গত বছরের ডিসেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৩ হাজার ৭৫৯ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে ঋণ প্রদান বেড়েছে ৪২০ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। বৃদ্ধির হার মাত্র শূন্য দশমিক ৫৭ শতাংশ। আগে আমানত ও ঋণ দুটোই আরও অনেক বেশি হারে বাড়ত। কোনো বছর তা ডাবল ডিজিটের ওপরে থাকত।

খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, আর্থিক খাতের বহুল আলোচিত ব্যক্তি প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদার বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে যে অনিয়ম করেছেন, পুরো খাতই এখন তার জের টানছে। পিকে হালদারের মালিকানা আছে বা ছিল, এমন কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি। পাশাপাশি এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও খেলাপি ঋণ বাড়ছে, যে কারণে সার্বিকভাবে এ খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েই চলেছে। এতে কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বড় ধরনের সংকটে পড়ে। তারা আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছিল না। ফলে আমানতকারীরা বিক্ষোভ ও মিছিল-মিটিং করেন। এর প্রভাবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত কমছিল। তবে গ্রাহকসংখ্যা জালিয়াতির পর থেকেই কমছিল। কমার সংখ্যা এখনও অব্যাহত রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কমেছে আমানত হিসাব।

চট্টগ্রাম ইনভেস্টর’স ফোরামের সভাপতি কবির আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, আর্থিক খাতের নানা অনিয়মের কারণে দেশের পুঁজিবাজারে তিন মাস ধরে প্রতিনিয়ত সূচকের পতন হচ্ছে। এতে একজন বিনিয়োগকারী প্রতিদিন ক্যাপিটাল লসে আছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কয়েক বছর ধরে তো ক্যাপিটাল গেইন হয়নি। পাশাপাশি কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া বাকিরা গণহারের নো ডিভিডেন্ট দিয়েছে, যার কারণে বিনিয়োগকারীরা ব্যাপক লোকসানে আছে। অথচ এসব বিনিয়োগকারীকে সুরক্ষায় তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। এভাবে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অবহেলা পৃথিবীর কোনো স্টক এক্সচেঞ্জ করে না।

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে বাজার পরিস্থিতি বিনিয়োগকারীদের জন্য বিনিয়োগ-উপযোগী। অনেক প্রতিষ্ঠানের শেয়ারদর ফেস ভ্যালুর নিচে অবস্থান করছে। বিশেষ করে তো নন-ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলোর। আবার পরিাচলকদের সম্মিলিত শেয়ার ধারণ ৩০ শতাংশ নেই। তাদের জন্য বাই-ব্যাক আইন কার্যকর করা উচিত।  

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলএফসিএ) এক নেতা এবং একটি শিল্পগ্রুপের পরিচালক বলেন, ফেসভ্যালুর নিচে থাকা ১৪টি নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পাঁচ-ছয়টি প্রতিষ্ঠানের অবস্থা শোচনীয়। তাদের আর্থিক অবস্থার জন্য পুরো খাত এখন সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে। সেসব প্রতিষ্ঠানকে সংস্কার করে দিয়ে নতুন নিয়ম-নীতির মাধ্যমে সাপোর্ট করা উচিত হবে।

তিনি আরও বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট আমানতের সাড়ে ৯২ শতাংশই ঢাকাকেন্দ্রিক। চট্টগ্রামকেন্দ্রিক মাত্র সাড়ে চার শতাংশ। বাকি তিন শতাংশ অন্যান্য অঞ্চলে। সুতরাং ঢাকার বাইরে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নিয়ে তাদের কাজ করতে হবে। ব্যবসায় বৈচিত্র্য আনতে হবে।