রহমত রহমান: মাত্র আট মাসে (জানুয়ারি-আগস্ট) দাবি নিষ্পত্তি হয়েছে ২৬ হাজার ২৩০টি, যাতে ফেরতযোগ্য ভ্যাটের পরিমাণ প্রায় ৯৭ কোটি টাকা। নিষ্পত্তি করা দাবির মধ্যে বিদেশি সুবিধাভোগী ও আন্তর্জাতিক বিশেষায়িত সংস্থার সংখ্যা বেশি। আট মাসের মধ্যে কেবল জুলাই ও আগস্ট মাসে আবেদন নিষ্পত্তির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫০৪ শতাংশ। টিমওয়ার্ক থাকলে সবই সম্ভব। শুল্ক রেয়াত ও প্রত্যর্পণ পরিদপ্তর (ডেডো) এমন অবিশ্বাস্য কাজটি করেছে।
দাবির মধ্যে রয়েছে বেশিরভাগই বিদেশি সংস্থা ও দূতাবাস, যা বছরের পর বছর নিষ্পত্তি হয়নি। আট মাসে বিদেশি সংস্থা ও দূতাবাসকে ভ্যাট ফেরত দেয়া হয়েছে প্রায় ৪৯ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। দ্রুত দাবি নিষ্পত্তিতে ক্রাশ প্রোগ্রামের পাশাপাশি কর্মকর্তাদের দক্ষতা উন্নয়নে দেয়া হয় প্রশিক্ষণ। এর ফলে ডেডোর কাজের গতি কয়েকগুণ বেড়েছে। তবে রয়েছে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতা। ডেডোর এক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৩ হাজার ২৬৪ আবেদন নিষ্পত্তি হয়েছে। একই সময়ে চার হাজার ২২১টি আবেদন অনিষ্পন্ন রয়েছিল। আবেদনের মধ্যে দূতাবাসের ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আবেদন এক হাজার ৮৩৪টি, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫৩৩টিসহ মোট আবেদন দুই হাজার ৩৬৭টি। এর মধ্যে ডিসেম্বর পর্যন্ত এক হাজার ৪১০টি, জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫৪৬টিসহ মোট এক হাজার ৯৫৬টি নিষ্পত্তি হয়েছে। বাকি ৪১১টি নিষ্পত্তি হয়নি। অনিষ্পন্নের কারণ হিসেবে বলা হয়, ২০৯টি মূসক-১১-এর মূল কপি না থাকা এবং ৭৯টি ত্রুটিপূর্ণ আবেদন। মোট ২৬ হাজার ২৩০টি দাবি নিষ্পত্তি করা হয়েছে। এছাড়া একই সময়ে প্রকৃত হার ৬৩৫টি, সমহার আট হাজার ৬৩১টি ও সহগ দুই হাজার ৪২টি আবেদন নিষ্পত্তি করা হয়েছে।
আবেদন নিষ্পত্তির হারে দেখা যায়, দূতাবাসের ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে জুন ৩৫ শতাংশ, জুলাই থেকে ডিসেম্বর ৬০ শতাংশ, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৯৫ শতাংশ এবং জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৩১ শতাংশ নিষ্পত্তি হয়েছে। একই সময়ে প্রকৃত হার ১২ শতাংশ, আট শতাংশ, ১৪ শতাংশ ও ৩৯ শতাংশ। সমহার ৮০ শতাংশ, ৮৮ শতাংশ, ৫১ শতাংশ ও ১৩৫ শতাংশ। সহগ ৭৫ শতাংশ, ৫৬ শতাংশ, ৫১ শতাংশ ও ৩৮ শতাংশ। অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে জুন এবং জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিষ্পত্তির হার সবচেয়ে বেশি।
হিসাবে আরও দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত আট মাসে মোট ৮০৬টি নথি ও ২৬ হাজার ২৩০টি দাবি নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে দেশি ২৬৩টি নথি নিষ্পত্তিতে ৪৭ কোটি ৭৫ লাখ ৬৯ হাজার ২২৮ টাকা ফেরত (প্রত্যর্পণ বা রিফান্ড) দেয়া হয়েছে। দূতাবাস, বিদেশি মিশন ও সংস্থার ৫৪৩টি নথি নিষ্পত্তিতে ৪৯ কোটি ৩৫ লাখ ৬২ হাজার ২৯৩ টাকা ফেরত দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ইউনিসেফ, ইউএনএইচসিআর, ডব্লিউএইচও, ইউএনডিপি, আইসিডিডিআর,বি, আইএফসি, আইবিআরডি আইএলও এবং আইওএমের নথি নিষ্পত্তি করে প্রায় সাড়ে ৪৬ কোটি টাকা ফেরত দেয়া হয়েছে। নিষ্পত্তি করা আবেদনের তুলনায় দেখা গেছে, চলতি বছর জুলাই মাসে নিষ্পত্তি প্রবৃদ্ধি ১০৫০ শতাংশ ও আগস্ট মাসে প্রবৃদ্ধি ৪৩৮ শতাংশ। দুই মাসে নিষ্পত্তি প্রবৃদ্ধি ৫০৪ শতাংশ।
খাতভিত্তিক প্রত্যর্পণ হিসাব করলে দেখা যায়, খাতভিত্তিক হিসাবে বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছর সবচেয়ে বেশি প্রায় ১৪১ কোটি টাকা ৩২ লাখ টাকা প্রত্যর্পণ বা ফেরত দেয়া হয়েছে। এছাড়া ২০১৮-১৯ অর্থবছর প্রায় ১৩৬ কোটি ৫৯ লাখ টাকা, ২০১৯-২০ অর্থবছর প্রায় ১২৯ কোটি ৪৬ লাখ টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছর প্রায় ৪৮ কোটি ৯৬ লাখ টাকা এবং চলতি অর্থবছরের জুলাই ও আগস্ট মাসে প্রায় ৩১ কোটি ৫২ লাখ টাকা ফেরত দেয়া হয়েছে। খাতগুলো হলোÑলেদার, গ্যাস ও বিদ্যুৎ, সিরামিকস, পাওয়ার ট্রান্সফরমার বা ইলেকট্রিক্যাল পণ্য, প্রি ফেব্রিকেটেড স্টিল স্ট্রাকচার, কূটনৈতিক মিশন ও আন্তর্জাতিক সংস্থা, হোম টেক্সটাইল, কেব্ল, পাট ও পাটজাত পণ্য, আন্তর্জাতিক দরপত্র ও অন্যান্য। খাতভিত্তিক প্রত্যর্পণ বা ফেরতের প্রবৃদ্ধির হিসাবে ২০১৯-২০ অর্থবছর প্রবৃদ্ধি ৯৪ দশমিক ৭৮ শতাংশ, ২০২০-২১ অর্থবছর ৩৮ শতাংশ ও ২০২১-২২ অর্থবছর ২৮৯ শতাংশ।
ডেডোর সাম্প্রতিক আলোচিত কার্যক্রমের মধ্যে বিদেশি মিশন ও সংস্থার দাবি নিষ্পত্তিতে ২৪ কর্মদিবসের ক্রাশ প্রোগ্রাম নেয়া হয়। এই সময়ে ২৫ হাজার ৬৬৬টি দাবি নিষ্পত্তি ও ৪৪ কোটি ২১ লাখ ৫৪ হাজার ৬৭৭ টাকার রিফান্ড অনুমোদিত হয়েছে। দ্রুত দাবি নিষ্পত্তির দক্ষতা উন্নয়নে কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার দাবি দ্রুত নিষ্পত্তিতে ডেডোর নতুন ওয়েবসাইট ও অনলাইন রিফান্ড অ্যাপস ডেডো-পে চালু করা হয়েছে। নিজস্ব লোগো, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কল্যাণে ডেডো ক্লাব গঠন ও ব্যাংক হিসাব খোলা হয়েছে।
এসব কার্যক্রম নেয়ার পর ডেডোর কাজের গতি কয়েকগুণ বেড়েছে। তবে রয়েছে চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতা, যার মধ্যে রয়েছেÑঅটোমেশন ও অনলাইন কার্যক্রম, ডেডোপে অ্যাপসের বাস্তবায়নের বাজেট; সম্পূরক শুল্কের নতুন অর্থনৈতিক কোড সৃজন; বিগত তিন বছরের সমহার আদেশ অনুমোদনের অপেক্ষাধীন; বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে টেরিটাওয়েল ও হোম টেক্সটাইলের অপচয় হার নির্ধারণের চেষ্টা; অপর্যাপ্ত কর্ম এলাকা; অপর্যাপ্ত সংখ্যক রাজস্ব ও সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা; সহগ প্রণয়নে সংশ্লিষ্ট সেক্টর স্পেশালিস্টসহ অন্যান্য কর্মচারীর স্বল্পতা; কম জনবলের অধিক কর্মভার; তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির শূন্যপদে নিয়োগের বাজেট; যানবাহন সংকট; চালান যাচাইয়ে ব্যাংক, ভ্যাট সার্কেল ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে পত্রের জবাব বিলম্বে প্রাপ্তি।
ডেডোর সূত্রমতে, রপ্তানি খাতকে উৎসাহ দিতে ১৯৮৭ সালে রাষ্ট্রপতির এক আদেশে ডেডো প্রতিষ্ঠিত হয়। ডেডোর কাজের ধরন এনবিআরের অন্য সংস্থার মতো নয়। ডেডোর কাজের মধ্যে রয়েছেÑশুল্ক প্রত্যর্পণ, রপ্তানি সহগ নির্ধারণ, রিফান্ড, প্রকৃত ও সমহার নির্ধারণ, আবেদন ও মামলা নিষ্পত্তি, ভুল সংশোধন ও সমন্বয়, প্রার্থীর চেক ইস্যু, প্রশাসনিক কাজ প্রভৃতি। ডেডো ৪৮টি বিদেশি সংস্থা ও দূতাবাস নিয়ে কাজ করে।