২৭ ডিজিটাল সেবায় কর অব্যাহতি তুলে দিতে চায় এনবিআর

রহমত রহমান: ১৩ বছর ধরে ২৭টি ডিজিটাল সেবা খাতে কর অব্যাহতি দেয়া হচ্ছে। আগামী ৩০ জুন অব্যাহতির মেয়াদ শেষ হচ্ছে। তবে অব্যাহতির মেয়াদ আর না বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।

অব্যাহতি তুলে নেয়া হলে আইটি খাতের এসব প্রতিষ্ঠানকে করপোরেট কর দিতে হবে। নিয়ম অনুসারে এসব প্রতিষ্ঠানের করপোরেট কর সাড়ে ২৭ শতাংশ। এনবিআর কর্মকর্তারা বলছে, শুধু আইটি খাত নয়, যেসব খাতে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে, তা তুলে নেয়ার পরামর্শ দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)।

একইসঙ্গে যেসব খাতে ইতোমধ্যে অব্যাহতির মেয়াদ শেষ হয়েছে, তা আর না বাড়ানো উচিত বলে মত দেয়া হয়েছে। কর অব্যাহতি ছাড়াও ভ্যাট ছাড় পাচ্ছে আইটি খাত। এই খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামীতে বাংলাদেশকে লিড দেবে আইটি খাত। রপ্তানি বাড়বে। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে, দেশে বিনিয়োগ বাড়াতে হলে অব্যাহতি অব্যাহত রাখতে হবে। আগামী ২০৩১ সাল পর্যন্ত অব্যাহতির মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।

এনবিআর সূত্রমতে, ২০২০ সালের ১ জুলাই থেকে চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত ২৭টি ডিজিটাল ব্যবসার ওপর শর্ত সাপেক্ষে আয়কর অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। ২০১১ সাল থেকে এ অব্যাহতি চলে আসছে। এ সময়ে এসব ব্যবসা হতে নিবাসী ব্যক্তি বা অনিবাসী বাংলাদেশি ব্যক্তির আয় হতে কর অব্যাহতি দেয়া হয়।

২৭টি ব্যবসা হলোÑসফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, সফটওয়্যার বা অ্যাপ্লিকেশন কাস্টমাইজেশন, নেশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন), ডিজিটাল এনিমেশন ডেভেলপমেন্ট, ওয়েবসাইট ডেভেলপমেন্ট, ওয়েবসাইট সার্ভিস, ওয়েব লিস্টিং, আইটি প্রসেস আউটসোর্সিং, ওয়েবসাইট হোস্টিং, ডিজিটাল গ্রাফিক্স ডিজাইন, ডিজিটাল ডেটা এন্ট্রি ও প্রসেসিং, ডিজিটাল ডেটা এনালিটিক্স, গ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিস (জিআইএস), আইটি সহায়তা ও সফটওয়্যার মেইনটেন্যান্স সার্ভিস, সফটওয়্যার টেস্ট ল্যাব সার্ভিস, কল সেন্টার সার্ভিস, ওভারসিজ মেডিকেল ট্রান্সক্রিপশন, সার্চ ইঞ্জিন অপটিসাইজেশন সার্ভিস, ডকুমেন্ট কনভারশন, ইমেজিং ও ডিজিটাল আর্কাইভিং, রোবটিক্স প্রসেস আউটসোর্সিং, সাইবার সিকিউরিটি সার্ভিস, ক্লাউড সার্ভিস, সিস্টেম ইন্টিগ্রেশন, ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম, ই-বুক পাবলিকেশন, মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট সার্ভিস ও আইটি ফ্রিল্যান্সিং।

অন্যদিকে, আইটি সেবা খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) এ সুবিধা না বাড়ানো হলে এ খাতে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে। সে জন্য ১০ মার্চ বেসিসসহ আইটি খাতের পাঁচ সংগঠন থেকে অর্থমন্ত্রীকে চিঠি দেয়া হয়েছে। চিঠিতে কর অব্যাহতির মেয়াদ ২০৩১ সাল পর্যন্ত বাড়ানোর অনুরোধ করা হয়েছে। বেসিসের চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘করোনার মতো বৈশ্বিক মহামারি, চলমান বৈশ্বিক অস্থিরতা ও এগুলোর সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাবের কারণে ইনফরমেশন টেকনোলজি খাতের ব্যবসায়ীরা পিছিয়ে পড়েছেন।

কর অব্যাহতির মেয়াদ ৩০ জুন পর্যন্ত থাকায় বিনিয়োগকারীরা দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। সরকার ঘোষিত অগ্রাধিকার খাত ও শিল্প হিসেবে বিবেচিত আইটি সেবার ব্যবসায় তরুণ উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে এই সুবিধা বাড়িয়ে ২০৩১ সাল পর্যন্ত অব্যাহত রাখা প্রয়োজন।’ বেসিসের তথ্য অনুযায়ী, এ খাতে বছরে স্থানীয় বাজারের আকার প্রায় দেড় বিলিয়ন। আর রপ্তানির পরিমাণ এক দশমিক ৯ বিলিয়ন। এ খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৬০০ মিলিয়ন। সর্বশেষ ২০২৩ সালে ৭২ বিলিয়ন নতুন বিনিয়োগ এসেছে। অ্যাসোসিয়েট সদস্যসহ বেসিসের সদস্য সংখ্যা এক হাজার ৪০০-এর বেশি।

সংগঠনের সদস্যভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোয় তিন লাখসহ দেশে এ খাতে মোট ১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে এ খাতের কর অব্যাহতির মেয়াদ শেষ হয়েছিল। ওই বছর নতুন করে চার বছরের জন্য তা বাড়ানো হয়, যা আগামী ৩০ জুন শেষ হবে।

এ বিষয়ে বেসিসের প্রেসিডেন্ট রাসেল টি আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, আমরা জানি কোনো খাতে কর অব্যাহতি না রাখতে আইএমএফের চাপ রয়েছে। তবে স্মার্ট বাংলাদেশের এই অব্যাহতি অব্যাহত রাখা দরকার। এই খাতে দুই হাজার ৩০০ কোম্পানি রয়েছে। যাতে তরুণরা কাজ করছে। আইটি খাত সামনে বাংলাদেশকে লিড দেবে। সব খাতে রপ্তানি কমে যাচ্ছে। তবে আমাদের রপ্তানি বাড়বে। এটা সরকারও অনুধাবন করেছে। আইএমএফেরও বিষয়টি অনুধাবন করা দরকার। আমরা বিশ্বাস করি, সরকার এই খাতে অব্যাহতি তুলে নেবে না।

এ নিয়ে এনবিআরের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, শুধু আইটি খাত নয়, যেসব খাতে কর অব্যাহতি দেয়া হয়েছে সব বাতিল করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। আর ইতোমধ্যে যেসব খাতের অব্যাহতির মেয়াদ শেষ হয়েছে, তা আর না বাড়ানো উচিত বলেও মত দিয়েছে। আমরা অব্যাহতি বাতিলের পক্ষে। আমরা সব পর্যালোচনা করছি।

অপরদিকে, আইএমএফ এনবিআরকে বলেছে, আয়কর আইনের যে বিধান অনুযায়ী এনবিআর কর অব্যাহতি দিতে পারে, সে বিধান থাকা উচিত নয়। সেই সঙ্গে বর্তমানে যেসব খাতে কর সুবিধা পায়, সেসব খাতের বিদ্যমান সুবিধার মেয়াদ শেষ হলে আর বাড়ানো উচিত নয়। আর যেসব খাতে অব্যাহতি রয়েছে, তা তুলে দেয়ার পরামর্শ দিয়েছে।

গত কয়েক মাস ধরে আইএমএফ এনবিআরের সঙ্গে সভা ও আলোচনা করে আসছে। আইএমএফের পরামর্শ অনুযায়ী এনবিআর ব্যক্তিগত কর, ক্ষুদ্রঋণ, রেমিট্যান্স (প্রবাসী আয়), জ্বালানি, অর্থনৈতিক অঞ্চল, আইসিটি, পোশাক খাতসহ বেশ কিছু খাত চিহ্নিত করে কর অব্যাহতি তুলে দেয়ার বিষয়টি এনবিআর পর্যালোচনা শুরু

করেছে। এসব খাতে এনবিআরের বছরে প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার ৮১৩ কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি হয়। এর মধ্যে ব্যক্তিগত করদাতা পর্যায়ে বছরে অন্তত ৪০ হাজার ৪৯৮ কোটি টাকা, করপোরেট আয়কর খাতে ৮৫ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা রাজস্ব ক্ষতি হয়। ব্যক্তি করদাতা ও করপোরেট আয়করের মধ্যে রেমিট্যান্স করছাড় ১১ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা। ক্ষুদ্রঋণে ছাড় ১৫ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ-জ্বালানি প্রতিষ্ঠানকে করছাড় দেয়া হয় ৮ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা। রপ্তানিমুখী পোশাক ও বস্ত্র খাতে করছাড় ৩ হাজার ৪৩৪ কোটি টাকা।

এনবিআরের হিসাব অনুয়ায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে অব্যাহতি ও রেয়াতসহ প্রত্যক্ষ কর ব্যয়ের মোট প্রাক্কলিত পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২৫ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেয়া কর ভর্তুকির পরিমাণ ৮৫ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা এবং ব্যক্তি পর্যায়ে ৪০ হাজার ৪৯৯ কোটি টাকা দেয়া হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রাক্কলিত প্রত্যক্ষ কর ব্যয়ের মোট পরিমাণ হবে ১ লাখ ৭৮ হাজার ২৪১ কোটি টাকা।

 

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০