ইসমাইল আলী: দেশের গ্যাস মজুত ফুরিয়ে আসছে, যা নিয়ে কয়েক বছর ধরেই আলোচনা হচ্ছে। এর মধ্যে দুই বছরেই মজুত কমেছে সাড়ে পাঁচ শতাংশের বেশি। তবে স্থলভাগে নতুন ক্ষেত্র না পাওয়ার পরও সমুদ্রভাগে গ্যাস অনুসন্ধানের উদ্যোগ খুব একটা এগোয়নি। অথচ সংকটের কারণে চাহিদার অন্তত এক-তৃতীয়াংশ গ্যাস সরবরাহ করা যাচ্ছে না। এতে নাজেহাল হচ্ছে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিভিন্ন শিল্প-কারখানা।
হাইড্রোকাবর্ন ইউনিটের তথ্যমতে, দেশে উত্তোলনযোগ্য গ্যাস মজুতের পরিমাণ ২৯ দশমিক ৯২৬৫ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ)। এর মধ্যে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত উত্তোলন করা হয়েছে ২০ দশমিক ৫৪৮৪ টিসিএফ, যা মজুতের ৬৮ দশমিক ৬৬ শতাংশ। ওই সময় দেশে অবশিষ্ট গ্যাস মজুত ছিল ৯ দশমিক ৩৭৮১ টিসিএফ বা ৩১ দশমিক ৩৪ শতাংশ। যদিও অবশিষ্ট মজুত থেকে কিছু গ্যাস উত্তোলন করা যাবে না। কারণ চাপ কমে এলে প্রতি ফিল্ডেই কিছু গ্যাস উত্তোলন করা যায় না।
এদিকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর শেষে গ্যাস উত্তোলনের পরিমাণ ছিল ১৮ দশমিক ৮৮৬৮ টিসিএফ আর মজুত ছিল ১১ দশমিক ০৩৯৩ টিসিএফ। অর্থাৎ দুই বছরে দেশে গ্যাসের মজুত কমেছে এক দশমিক ৬৬১২ টিসিএফ বা পাঁচ দশমিক ৫৫ শতাংশ। আর ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর শেষে গ্যাস উত্তোলনের পরিমাণ ছিল ১৯ দশমিক ৭১৫৪ টিসিএফ আর মজুত ছিল ১০ দশমিক ২১১১ টিসিএফ। অর্থাৎ শেষ এক বছরে গ্যাসের মজুত কমেছে শূন্য দশমিক ৮৩৩ টিসিএফ বা দুই দশমিক ৭৮ শতাংশ।
তথ্যমতে, কয়েক বছর ধরে দেশে সবচেয়ে বেশি গ্যাস সরবরাহ করছে মার্কিন কোম্পানি শেভরন। কোম্পানিটির অধীন তিনটি ক্ষেত্রে গ্যাস মজুত ছিল সাত দশমিক ৬১২৭ টিসিএফ। এর মধ্যে সাত দশমিক ৬৫৮৯ টিসিএফ গ্যাস উত্তোলন করা হয়ে গেছে। অর্থাৎ শেভরনের অধীন ক্ষেত্রগুলোর সক্ষমতা শেষ। যে কোনো সময় এসব ক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাতীয় গ্রিডে স্থানীয় গ্যাস সরবরাহের অর্ধেকেরও বেশি আসত শেভরনের ক্ষেত্রগুলো থেকে। তবে কয়েক বছর ধরে এগুলো থেকে বাড়তি গ্যাস সরবরাহের কারণে তাদের মজুত ফুরিয়ে এসেছে। যদিও দেশে গ্যাস মজুতের অর্ধেকেরও বেশি আছে স্থানীয় কোম্পানিগুলোর পরিচালনাধীন গ্যাসক্ষেত্রে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোম্পানিগুলো সরবরাহ সেভাবে বাড়াতে পারেনি। দেশে গ্যাসের চাহিদা যেভাবে বাড়ছে, তাতে এখনই স্থানীয় সরবরাহের বিকল্প চ্যানেল বা সরবরাহ লাইন তৈরি করা না গেলে অদূর ভবিষ্যতে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে পারে গ্যাস খাত।
এদিকে পরিমাণের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেডের ক্ষেত্রগুলো থেকে। এ কোম্পানির অধীনে ছয়টি ক্ষেত্রে মজুত ছিল ১২ দশমিক ২৫২০ টিসিএফ গ্যাস। এর মধ্যে উত্তোলন করা হয়েছে ৯ দশমিক ৩০৩ টিসিএফ বা ৭৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ। আর অবশিষ্ট রয়েছে তিন টিসিএফের কিছুটা বেশি গ্যাস।
উত্তোলনের দিক থেকে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে সিলেট গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি। এ কোম্পানির অধীনে পাঁচটি ক্ষেত্রে গ্যাস মজুত ছিল সাত দশমিক ০৩৩ টিসিএফ। এর মধ্যে উত্তোলন করা হয়েছে মাত্র এক দশমিক ৮৬৪৩ টিসিএফ বা ২৬ দশমিক ৫১ শতাংশ। আর অবশিষ্ট রয়েছে পাঁচ দশমিক ১৬৮৭ টিসিএফ গ্যাস।
হাইড্রো কার্বন ইউনিটের তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে সর্বোচ্চ গ্যাস মজুত রয়েছে রশিদপুর, তিতাস ও কৈলাসটিলায়। এ তিন ক্ষেত্রে গ্যাস মজুতের পরিমাণ যথাক্রমে দুই দশমিক ৪২৭৩ টিসিএফ, ২ দশমিক ২২১২ টিসিএফ ও দুই দশমিক ০৮১৫ টিসিএফ। এর মধ্যে তিতাস বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডসের অধীনে এবং রশিদপুর ও কৈলাসটিলা সিলেট গ্যাস ফিল্ডসের অধীনে রয়েছে। তবে দেশের অন্যান্য গ্যাস ক্ষেত্রে মজুতের পরিমাণ আধা টিসিএফ বা তারও কম।
গত বছর জানুয়ারিতে জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছিলেন, ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত দেশে মজুত গ্যাসের পরিমাণ ছিল ৯ দশমিক ০৬ টিসিএফ। দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে দৈনিক গড়ে প্রায় ২ হাজার ২৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদিত হচ্ছে বিবেচনায় অবশিষ্ট মজুত গ্যাস দিয়ে প্রায় ১১ বছর চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে। এছাড়া নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানের বিভিন্ন কার্যক্রমও পরিচালিত হচ্ছে।
সে হিসাব বিবেচনায় নিলে বর্তমানে দেশে মজুত গ্যাস দিয়ে ৯ থেকে সাড়ে ৯ বছর চলবে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক বদরূল ইমাম এ প্রসঙ্গে শেয়ার বিজকে বলেন, শেভরনের গ্যাস সরবরাহ হ্রাসের ফলে সৃষ্ট ঘাটতি দেশীয় কোম্পানিগুলোর পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কারণ তারা নিজেরাই বছরের পর বছর ধরে গ্যাস উত্তোলন বাড়াতে পারেনি। বিপুল পরিমাণ গ্যাসের মজুত নিয়েও গ্রিডে সরবরাহ করেছে কম। এখন যেসব উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে তাতে বড় ধরনের কোনো গ্যাস সরবরাহ গ্রিডে আসবে না।