২ বছরে পিডিবি লোকসান গুনবে ৯২ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা!

ইসমাইল আলী: চলতি মাসে সরবরাহকৃত গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। এছাড়া ডলারের বিনিময় হার পরিবর্তনের কারণে উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। পাশাপাশি উৎপাদনে আসছে নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র। এতে বাড়ছে ক্যাপাসিটি চার্জের বোঝা। ভারতের আদানির বিদ্যুৎও আগামী মাস থেকে আসার কথা রয়েছে। এতে বিদ্যুতের বাল্ক (পাইকারি) মূল্য অনেক বেড়ে গেছে।

যদিও তিন মাসের মধ্যে দুই দফা বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের বাল্ক মূল্য। তবে ব্যয় বৃদ্ধির হার দাম বৃদ্ধির তুলনায় অনেক বেশি। ফলে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির সুফল খুব একটা পাচ্ছে না বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এতে সংস্থাটির লোকসান দুই বছরে রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছাবে।

চলতি (২০২২-২৩) ও আগামী (২০২৩-২৪) অর্থবছর দুই বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত এ সংস্থাটি লোকসান গুনবে প্রায় ৯২ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা। পিডিবির সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। এতে বিদ্যুৎ খাতের বর্তমান পরিস্থিতি ও আগামী অর্থবছরের সম্ভাব্য গতিবিধি তুলে ধরা হয়েছে।

প্রতিবেদনের তথ্যমতে, চলতি অর্থবছর দেশে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের (সম্ভাব্য) পরিমাণ দাঁড়াবে আট হাজার ৯৯৪ কোটি ৮০ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এজন্য জ্বালানি ব্যয় পড়বে ৫৬ হাজার ৭৫৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা। আর জ্বালানি-বহির্ভূত (ক্যাপাসিটি চার্জ ও বিদ্যুৎকেন্দ্র রক্ষণাবেক্ষণ) ব্যয় হবে ৩৭ হাজার ৪৮৭ কোটি ৯০ লাখ টাকা। অর্থাৎ মোট উৎপাদন ব্যয় পড়বে ৯৪ হাজার ২৪২ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এ বিদ্যুৎ বিক্রি করে পিডিবির সম্ভাব্য আয় হবে ৫১ হাজার ৮৯১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এর থেকে বিদ্যুৎ উন্নয়ন তহবিল ও উৎসে কর বাদ দিয়ে চলতি অর্থবছর পিডিবির সম্ভাব্য লোকসান দাঁড়াবে ৪৬ হাজার ২৭৫ কোটি ১০ লাখ টাকা।

এদিকে আগামী অর্থবছর মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের (সম্ভাব্য) পরিমাণ দাঁড়াবে ৯ হাজার ৭১৪ কোটি ২০ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এজন্য জ্বালানি ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৬ হাজার ৮৯৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা। আর জ্বালানি-বহির্ভূত ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৭ হাজার ৭০৭ কোটি ৯০ লাখ টাকা। অর্থাৎ মোট উৎপাদন ব্যয় দাঁড়াবে এক লাখ চার হাজার ৬০১ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এ বিদ্যুৎ বিক্রি করে পিডিবির সম্ভাব্য আয় ধরা হয়েছে ৬৩ হাজার ১৩২ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এর থেকে অন্যান্য ব্যয় বাদ দিয়ে আগামী অর্থবছর পিডিবির সম্ভাব্য লোকসান দাঁড়াবে ৪৬ হাজার ৬৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা।

পিডিবির একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, আগে পিডিবি বছরে যে পরিমাণ লোকসান গুনত, এখন এক মাসেই তার কাছাকাছি পরিমাণ লোকসান হচ্ছে। ডিসেম্বর ও ফেব্রুয়ারিতে দুই দফা বাল্ক বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলেও গ্যাসের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধিতে ব্যয় তার চেয়ে বেশি হারে বেড়েছে। আবার ৮৫ টাকার ডলার এখন ১০৭ টাকা (ব্যাংক রেট)। এসব কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। ফলে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ফল অতটা পাওয়া যাচ্ছে না।

তারা আরও বলেন, নতুন বেশ কয়েকটি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসছে। এতে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। এ কারণেও বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় বাড়বে। আবার অর্থ মন্ত্রণালয় চাহিদা অনুযায়ী ভর্তুকি ছাড় করছে না। সব মিলিয়ে দুই বছর (চলতি ও আগামী অর্থবছর) বিদ্যুৎ খাতের জন্য খুবই জটিল সময়।

পিডিবির প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় ছিল আট টাকা ৮৬ পয়সা। তবে চলতি অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়াবে ১০ টাকা ৮০ পয়সা। আগামী অর্থবছর আরও বেড়ে দাঁড়াবে ১১ টাকা ১০ পয়সা। যদিও চলতি অর্থবছর বিদ্যুতের বাল্ক মূল্যহার ছিল পাঁচ টাকা আট পয়সা। প্রথম দফা বৃদ্ধির পর তা দাঁড়ায় ছয় টাকা ২০ পয়সা। চলতি মাস থেকে তা দাঁড়াবে ছয় টাকা ৭০ পয়সা। এতে চলতি অর্থবছর প্রতি ইউনিটে পিডিবির লেকসান দাঁড়াবে চার টাকা ৮৫ পয়সা। আগামী অর্থবছর তা সামান্য কমে দাঁড়াবে গড়ে চার টাকা ৪০ পয়সা।

এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছর দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় ছিল ছয় টাকা ৫৮ পয়সা, ২০১৯-২০ অর্থবছর পাঁচ টাকা ৮৫ পয়সা, ২০১৮-১৯ অর্থবছর পাঁচ টাকা ৯৫ পয়সা, ২০১৭-১৮ অর্থবছর চার টাকা ৮৪ পয়সা, ২০১৬-১৭ অর্থবছর চার টাকা ৯০ পয়সা, ২০১৫-১৬ অর্থবছর পাঁচ টাকা ৫৫ পয়সা, ২০১৪-১৫ অর্থবছর ছয় টাকা ২৭ পয়সা এবং ২০১৩-১৪ অর্থবছর ছয় টাকা ২৮ পয়সা।

পিডিবির তথ্যমতে, গত ১২ বছরে পিডিবি লোকসান গুনেছে এক লাখ ছয় হাজার ১৭৬ কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে ২০১০-১১ অর্থবছর সংস্থাটির লোকসান ছিল চার হাজার ৬২০ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ছয় হাজার ৬৯৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। তবে ২০১২-১৩ অর্থবছর তা কিছুটা কমে দাঁড়ায় পাঁচ হাজার ৪৩ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। পরের কয়েক বছরও পিডিবির লোকসান চার থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকার মধ্যেই ছিল। এর মধ্যে ২০১৩-১৪ অর্থবছর সংস্থাটি লোকসান গুনে ছয় হাজার ৮০৯ কোটি ২৫ লাখ টাকা এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছর সাত হাজার ২৮২ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছর লোকসান কমে দাঁড়ায় তিন হাজার ৮৭৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছর আবার কিছুটা বেড়ে হয় চার হাজার ৪৩৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা।

যদিও ২০১৭-১৮ অর্থবছর লোকসান এক লাফে দ্বিগুণ ছাড়িয়ে যায়। ওই অর্থবছর পিডিবির লোকসান দাঁড়ায় ৯ হাজার ৩১০ কোটি ১৫ লাখ টাকা। পরের দুই অর্থবছর লোকসান কিছুটা কমে সংস্থাটির। এর মধ্যে ২০১৮-১৯ অর্থবছর আট হাজার ১৪১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা ও ২০১৯-২০ অর্থবছর সাত হাজার ৪৪৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা লোকসান গুনে পিডিবি। তবে পরের দুই অর্থবছর তা ক্রমেই বেড়ে আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছর সংস্থাটির লোকসানের পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ৫০৯ কোটি ১২ লাখ টাকা। আর গত (২০২১-২২) অর্থবছর পিডিবির লোকসান দাঁড়ায় ৩১ হাজার আট কোটি ৩২ লাখ টাকা।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০