রোহান রাজিব: দেশের অর্থনীতিবিদরা দীর্ঘদিন ধরে পরামর্শ দিলেও তাতে সাড়া না দিয়ে গত অর্থবছর ডেভেলভমেন্টের ব্যবস্থার মাধ্যমে রেকর্ড পরিমাণ নতুন টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে গেছে। তাই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। দুই মাস ধরে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দেয়া পুরোপুরি বন্ধ রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে গত অক্টোবর শেষে নিট ডেভেলভমেন্টের স্থিতি কমে দাঁড়িয়েছে ৬২ হাজার ৩৯২ কোটি টাকায়, যা গত অর্থবছরের জুন শেষে ছিল ৭৯ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা। হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, গত অর্থবছর রেকর্ড পরিমাণ টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দেয়া হয়, যার প্রভাবে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। তাই এ অর্থবছরে সরকারকে টাকা ছাপিয়ে ঋণ দেয়া হবে না বলে জানিয়ে দেয়া হয়। তাই গত দুই মাসে ডেভেলভমেন্টের মাধ্যমে সরকার ঋণ পায়নি। বরং বাংলাদেশ ব্যাংকে সরকার পরিশোধ করেছে।
তারা আরও বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত বছর সরকারের যেসব বন্ড কিনে নিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে যেগুলোর মেচিউরিটি হয়েছে, তা আর কিনে নিচ্ছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওইসব বন্ড এখন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কিনে নিচ্ছে। এর মাধ্যমেও ব্যাংকগুলোর টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে আসছে। এর অর্থাৎ হলো সরকার বন্ডের মাধ্যমে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে দিচ্ছে।
চলতি অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ২৬ অক্টোবর শেষে সরকারের ব্যাংকঋণের মোট স্থিতি দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ৯৩ হাজার ৭১৪ কোটি টাকা, গত ৩০ জুন শেষে যা ছিল ৩ লাখ ৯৭ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা। এই হিসাবে অর্থবছরের প্রথম তিন মাস ২৬ দিনে সরকারের নিট ব্যাংকঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ৬৪ কোটি ২২ লাখ টাকা। এ সময়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে নেয়া ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ৬৭ হাজার ৯১২ কোটি টাকা, যা গত ৩০ জুন শেষে ছিল ২ লাখ ৩৬ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা। ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকারের ঋণ বেড়েছে ৩১ হাজার ৭৭৪ কোটি টাকা। অন্যদিকে এ সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নেয়া ব্যাংকঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে এক লাখ ২৫ হাজার ৮০১ কোটি টাকা, যা গত ৩০ জুন শেষে ছিল এক লাখ ৫৭ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ কমেছে ৩১ হাজার ৮৩৮ কোটি টাকা।
সাধারণত সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নিলে বেসরকারি খাতের প্রয়োজনীয় ঋণ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সেই সঙ্গে ব্যাংকঋণের সুদের হারও বৃদ্ধির আশঙ্কা থাকে। এতে বেসকারি বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হয়। তাই অর্থনীতিবিদরা বরাবরই ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে যতটা সম্ভব কম ঋণ নেয়ার পরামর্শ দেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, চলমান ডলার সংকট ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কারণে সৃষ্ট রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে চলতি অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা তুলনামূলকভাবে কম। আবার খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণে ব্যাংকগুলোও বেসরকারি খাতে ঋণ দেয়ার পরিবর্তে সরকারকেই ঋণ দিতেই বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে। এছাড়া দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকও চাইছে বাজার থেকে তারল্য তুলে নিতে। এ কারণে গত দুই মাস টাকা ছাপিয়ে ঋণ দেয়া পুরোপুরি বন্ধ রেখেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের শুরুতেও সররকাকে টাকা ছাপিয়ে ঋণ দেয়া হলেও গত সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর টানা দুই মাস টাকা ছাপিয়ে কোনো ঋণ দেয়নি সরকার। অর্থাৎ জুলাই ও আগস্ট ট্রেজারি বিল ও বন্ডের ডেভেলভমেন্টের হলেও সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে কোনো ডেভেলভমেন্টের করা হয়নি। উল্টো এ সময়ে ট্রেজারি বিলের মেয়াদ পূর্তিতে ২২ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকার ঋণ পরিশোধ হয়েছে। আর এতে নিট ডেভেলভমেন্টের স্থিতিও কমে আসছে। যদিও এ সময়ে মোট ডেভেলভমেন্টের স্থিতি বেড়েছে। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, গত অর্থবছরের জুলাই থেকে চলতি অর্থবছরের অক্টোবর পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ট্রেজারি বিল ও বন্ডের মোট স্থিতি আরও বেড়ে দাঁড়ায় এক লাখ ৪৬ হাজার ২৬৪ কোটি টাকা। গত আগস্ট পর্যন্তও এর স্থিতি ছিল একই, কারণ গত সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে নতুন করে কোনো ডেভেলভমেন্টের করেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে গত চার মাসে সবমিলে ৩৬ হাজার ৭১০ কোটি টাকার ট্রেজারি বিল মেয়াদপূর্তিতে পরিশোধ করা হয়েছে। তবে প্রথম দুই মাস জুলাই ও আগস্টে ১৯ হাজার ৩৪৭ কোটি ডেভেলভমেন্টের হওয়ায় গত অক্টোবর শেষে নিট ডিভলভমেন্টের স্থিতি কমে দাঁড়িয়েছে ৬২ হাজার ৩৯২ কোটি টাকায়, যা গত অর্থবছরের জুন শেষে ছিল ৭৯ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা।
গত অর্থবছরও ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার রেকর্ড এক লাখ ২২ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরাসরি সরবরাহ করে ৯৭ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা, যা নতুন টাকা ছাপিয়ে দেওয়া হয়। যদিও ওই অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ট্রেজারি বিল ও বন্ড ডিভলভমেন্টের মোট স্থিতি ছিল আরও বেশি, প্রায় এক লাখ ২৬ হাজার ৯১৭ কোটি টাকা। তবে বেশ কিছু ট্রেজারি বিল ও বন্ডের মেয়াদপূর্তির কারণে সরকারের ঋণ পরিশোধ হওয়ায় নিট ডিভলভমেন্টের পরিমাণ দাঁড়ায় ৭৯ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণসহ চলমান অর্থনৈতিক সংকট নিরসনে করণীয় নির্ধারণে গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ নেয়া শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন শীর্ষ অর্থনীতিবিদের পরামর্শ নেয়া হয়েছে। এসব অর্থনীতিবিদের প্রায় সবাই টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ না দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, গত অর্থবছর সরকারের ঋণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকমুখী ছিল। অনেকটাই নতুন টাকা সৃষ্টি করে দেয়া হয়েছে, যা মূল্যস্ফীতিতে কিছুটা হিট করেছে। এটা এরই মধ্যে আমরা বন্ধ করেছি। তিনি বলেন, হার্ড পাওয়ার মানি সৃষ্টি করলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। এজন্য সর্বশেষ কোনো অকশনে ডিভলভমেন্ট করে সরকারের কোনো ঋণ দেয়া হয়নি। এ প্রক্রিয়াটা সরকারকেও জানিয়ে দেয়া হয়েছে। সরকারকে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকেই ঋণ নিতে হবে। ব্যাংকগুলো যতটুকু পারে, ততটুকুই দেবে।