রহমত রহমান: ১১ বছরেও প্রতিষ্ঠান অডিট হয়নি। বন্ডেড সুবিধায় আমদানি হয়েছে প্রায় দুই লাখ কেজি কাপড়। কিন্তু এই কাপড় দিয়ে তৈরি পোশাক রপ্তানি করা হয়েছে কি না তার কোনো হদিস নেই। শুল্ককর ফাঁকি দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি এসব কাঁচামাল অবৈধভাবে অপসারণ করা হয়েছে। ফাহামী ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামে ফাহামী গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের একটি প্রতিষ্ঠানের বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের প্রমাণ পেয়েছে ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট।
অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়েছে অর্থদণ্ড, প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায় শনাক্তকরণ নম্বর (বিআইএন) লক করা হয়েছে। সম্প্রতি এই অর্থদণ্ড দেয়া হয়। এছাড়া বন্ড সুবিধার অপব্যবহার গ্রুপের ফাহামী গ্রুপের আরও চারটি প্রতিষ্ঠানের বন্ড লাইসেন্স বাতিল ও একটি প্রতিষ্ঠানের বিআইএন লক করা হয়েছে। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এ বিষয়ে মেসার্স ফাহামী ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোতাহারুল ইসলাম চৌধুরী শেয়ার বিজকে বলেন, ‘সব প্রক্রিয়া মেনেই ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করি। আমাদের কোনো ডিমান্ড নেই।’ প্রায় দুই লাখ গজ বন্ডের কাপড় শুল্ককর পরিশোধ ছাড়াই বিক্রি করে দেয়া হয়েছে এই বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এক গজ কাপড়ও বিক্রি করা হয়নি। আমি তো সেই ধরনের ব্যবসায়ী না।’
প্রায় সাড়ে ১১ কোটি টাকার শুল্ককর ফাঁকি দেয়ায় সম্প্রতি বন্ড কমিশনারেট রায় দিয়েছে এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কমিশনারের জানা উচিত। রায় সম্পর্কে আমি অবগত নই। অবান্তর রায় দিলে তো হবে না। আমরা কোনো রায়ের কপি পাইনি। আমাদের যে শুনানিতে ডাকা হয়েছে তার কোনো নোটিস পাইনি। আমাদের ফ্যাক্টরি বন্ধ হলেও সেখানে তো লোক আছে।’ তবে ২০১১ সাল থেকে প্রতিষ্ঠান অডিট করা হয়নি বলে স্বীকার করেন তিনি।
এনবিআর সূত্রমতে, সাভারের বাইপাইল এলাকায় অবস্থিত মেসার্স ফাহামী ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ২০০৫ সালে বন্ড লাইসেন্স পায়। লাইসেন্স পাওয়ার পর থেকে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের অভিযোগ ওঠে। প্রতিষ্ঠানটি ২০১১ সাল থেকে কোনো নিরীক্ষা করা হয়নি। এনবিআরের নির্দেশে প্রতিষ্ঠানটির বন্ড সুবিধার অনিয়ম উদ্ঘাটনের উদ্যোগ নেয় ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট। বার্ষিক নিরীক্ষা সম্পাদনে প্রতিষ্ঠানের কাছে কাগজপত্র চাওয়া হয়। বিশেষ করে কাঁচামাল আমদানি ও পণ্য রপ্তানির তথ্য, ইউপি চাওয়া হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কোনো সহযোগিতা করা হয়। পরে বন্ড কর্মকর্তারা সংরক্ষিত ডেটাবেস (সিআইএস সেল) থেকে প্রতিষ্ঠানটির আমদানি-রপ্তানির তথ্য নেয়া হয়।
যাতে দেখা যায়, ফাহামী ইন্ডাস্ট্রিজ ২০১১ সালের ৩১ মার্চ থেকে চলতি বছরের ৫ জুন পর্যন্ত বন্ড সুবিধায় মোট এক লাখ ৯১ হাজার ৪৭৩ কেজি কাঁচামাল আমদানি করেছে। যার শুল্কায়নযোগ্য মূল্য ১২ কোটি ৮০ লাখ ২২ হাজার ৯২০ টাকা। যাতে প্রযোজ্য শুল্ককর ১১ কোটি ৩৬ লাখ ৭৫ হাজার ১০১ টাকা। এই কাপড় দিয়ে কোনো পণ্য তৈরি করে রপ্তানি করা হয়েছে কি নাÑতার কোনো তথ্য সিআইএস সেলে নেই। প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে রপ্তানির সপক্ষে কোনো দলিলাদি বা ইউডির কপি দেয়া হয়নি। প্রতিষ্ঠানটি শুল্ককর ফাঁকি দিতে এসব কাঁচামাল অবৈধভাবে অপসারণ করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে বলে ধারণা করছেন বন্ড কর্মকর্তারা। বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করায় প্রতিষ্ঠানকে চলতি বছরের ১৬ মার্চ দাবিনামা সংবলিত কারণ দর্শানোর নোটিস জারি করা হয়। ১৪ জুলাই লিখিত জবাব ও ব্যক্তিগত শুনানিতে অংশ নিতে বলা হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের দলিলাদি সরবরাহ করা হয়নি এবং শুনানিতে কেউ অংশ নেয়নি।
সূত্র আরও জানায়, মামলার নথি, কারণ দর্শানো নোটিস, বন্ড কর্মকর্তাদের বক্তব্য ও সিআইএস সেলের তথ্য পর্যালোচনা করা হয়। যাতে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি এসব কাঁচামাল অবৈধভাবে অপসারণ করেছে। এসব পণ্যের বন্ডিং মেয়াদ মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। ফলে প্রতিষ্ঠানের কাছে এই কাঁচামালের ওপর শুল্ককর প্রযোজ্য। সব পর্যালোচনা করে ২৮ সেপ্টেম্বর বন্ড কমিশনার রায় দেয়। যাতে বলা হয়, বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করায় প্রতিষ্ঠানকে ২০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেয়া হয়। অর্থদণ্ডসহ শুল্ককর ১১ কোটি ৫৬ লাখ ৭৫ হাজার ১০১ টাকা পরিশোধে প্রতিষ্ঠানকে ১৫ দিনের সময় দেয়া হয়। একইসঙ্গে প্রতিষ্ঠানের বিআইএন লক করা হয়েছে।
ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট সূত্রমতে, ফাহামী ইন্ডাস্ট্রিজ ছাড়াও ফাহামী গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের আরও পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের বন্ড লাইসেন্স ছিল। অনিয়মের অভিযোগে চারটি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল ও একটি প্রতিষ্ঠানের বিআইএন লক করা হয়েছে। এর মধ্যে ফাহামী নিটওয়্যার লিমিটেড, ফাহামী শার্টস লিমিটেড, ফাহামী ড্রেসেস লিমিটেড ও ফাহামী ওয়াশিং প্লান্ট লিমিটেডের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। আর ফাহামী অ্যাপারেলস লিমিটেডের বিআইএন লক করা হয়েছে।
সূত্রেমতে, ১৯৯২ সালে জেসিকা অ্যাপারেলস স্থাপনের মাধ্যমে মোতাহারুল ইসলামী চৌধুরী পোশাক খাতের ব্যবসায় আসেন। পরে এ ব্যবসায়ী ফাহামী ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, ফাহামী অ্যাপারেলস লিমিটেড, ফাহামী নিটওয়্যার লিমিটেড, ফাহামী ড্রেসেস লিমিটেড, ফাহামী টাউজারস লিমিটেড, ফাহামী শার্টস লিমিটেড, ফাহামী ওয়াশিং লিমিটেড এবং জেসিকা অ্যাপারেলস লিমিটেডের সমন্বয়ে ফাহামী গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ নামে একটি ব্যবসায়িক গ্রুপ গড়ে তোলেন। এ গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলো সাভারে অবস্থিত। এর মধ্যে ২০০০ সালে ফাহামী অ্যাপারেলস, ২০০৫ সালের ফাহামী ইন্ডাস্ট্রিজ ও ফাহামী নিটওয়্যার, ২০০৬ সালের ফাহামী ড্রেসেস ও ফাহামী শার্টস এবং ২০১০ সালে ফাহামী টাউজারস স্থাপন করেন।