নিজস্ব প্রতিবেদক: ব্যাংক খাতের সুশাসন ফেরাতে ব্যাংক পরিচালকদের নিয়োগের নিয়ম কঠিন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন পরিচালক হতে হলে ন্যূনতম ৩০ বছর লাগবে। এর কম বয়সী কেউ পরিচালক হতে পারবেন না। পাশাপাশি ১০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। তবে ১৮ বছর বয়সের আগের কোনো কাজের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নেয়া হবে না। এর আগে এমন নিয়ম ছিল না। এছাড়া ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি থেকে মুক্ত হওয়ার পাঁচ বছরের আগে কেউ পরিচালক হতে পারবে না।
‘ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধনী) আইন, ২০২৩’-এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। গতকাল রোববার ব্যাংক-কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ গঠন এবং পরিচালকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য-সংক্রান্ত এক নীতিমালা জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
নীতিমালায় বলা হয়, ব্যাংকের কর্মকাণ্ড প্রধানত আমানতকারীদের অর্থে পরিচালিত হয় এবং এ ক্ষেত্রে আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা করা অপরিহার্য বিধায় ব্যাংক-কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের দায়িত্ব অপরাপর কোম্পানির তুলনায় অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাংকিং খাতে সুশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২০২৩ সালে ব্যাংক-কোম্পানি আইনে অধিকতর সংশোধনী আনয়ন করা হয়েছে। এর ফলে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের গঠন এবং পরিচালকদের দায়িত্ব, কর্তব্য ও যোগ্যতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে নতুনভাবে এই নীতিমালা প্রণয়নের আবশ্যকতা দেখা দিয়েছে।
নীতিমালা অনুযায়ী, পরিচালনা পর্ষদের পরিচালকসংখ্যা হবে সর্বোচ্চ ২০ জন এবং স্বতন্ত্র পরিচালক হবে তিনজন। তবে ২০-এর নিচে পরিচালক হলে স্বতন্ত্র পরিচালক দুজনের বেশি হতে পারবেন না। পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হতে হলে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ন্যূনতম বয়স ৩০ বছর হতে হবে। পাশাপাশি ১০ বছরের ব্যবস্থাপনা বা পেশাগত অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। কোনো ব্যক্তির বয়স ১৮ বছর পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত তার কোনো কাজের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নেয়া হবে না। এছাড়া ব্যাংক চাকরি শেষ হওয়ার পাঁচ বছর পূর্ণ না হলে পরিচালক হতে পারবে না। আবার কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতা হিসেবে তালিকাভুক্ত হলে সেই তালিকা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পর পাঁচ বছর না পেরোলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি পরিচালক হতে পারবেন না।
পরিচালকদের যোগ্যতা সম্পর্কে নীতিমালায় বলা হয়, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ফৌজদারি অপরাধে দণ্ডিত হতে পারবেন না, কিংবা কোনো জাল-জালিয়াতি, আর্থিক অপরাধ বা অন্য অবৈধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না বা জড়িত নন, এমন নিশ্চয়তা থাকতে হবে। তার সম্পর্কে কোনো দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলায় আদালতের রায়ে বিরূপ পর্যবেক্ষণ বা মন্তব্য থাকতে পারবে না; আর্থিক খাতসংশ্লিষ্ট কোনো নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের বিধিমালা, প্রবিধান, নীতিমালা বা নিয়মাচার লঙ্ঘনের কারণে দণ্ডিত হওয়া যাবে না। ব্যাংক কোম্পানির পরিচালক হতে আগ্রহী ব্যক্তি এমন কোনো কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, যার নিবন্ধন বা লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে বা প্রতিষ্ঠানটি অবসায়িত হয়েছে, তার নিজের কিংবা স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নেয়া ঋণের জন্য খেলাপি নন। পরিচালক হতে গেলে অন্য কোনো ব্যাংক-কোম্পানি, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিমা কোম্পানি বা তেমন কোম্পানিগুলোর কোনো সাবসিডিয়ারি কোম্পানির পরিচালক বা উপদেষ্টা বা পরামর্শক বা অন্য কোনোভাবে লাভজনক পদে নিয়োজিত থাকা যাবে না। এ ছাড়া তিনি একই ব্যাংক-কোম্পানির বহিঃহিসাব নিরীক্ষক, আইন উপদেষ্টা, উপদেষ্টা, পরামর্শক বা অন্য কোনো লাভজনক পদে থাকতে পারবেন না। তিনি কোনো সময়ে আদালত কর্তৃক দেউলিয়া ঘোষিত হননি; তিনি ব্যক্তিগতভাবে অথবা তার ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বা অংশীদারি প্রতিষ্ঠানের জন্য করখেলাপি হতে পারবেন না।
বিকল্প পরিচালকের নিয়োগের ক্ষেত্রে নীতিমালায় বলা হয়, কেউ বছরে তিন মাসের বেশি বিকল্প পরিচালক থাকতে পারবে না। আবার যিনি ব্যাংকের বিকল্প পরিচালক হবেন, তিনি ওই ব্যাংকের ঋণগ্রহীতা হলে পরিচালক হতে পারবেন না। আর এখন কেউ যদি তিন মাসের বেশি বিকল্প পরিচালক থাকেন, তাহলে তাকে পদত্যাগ করে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে জানাতে হবে।
নীতিমালায় ব্যাংক চেয়ারম্যানের মেয়াদ নির্ধারণ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নীতিমালায় বলা হয়েছে, এখন সর্বোচ্চ দুই বছর চেয়ারম্যানের মেয়াদ হবে, যা আগে নির্ধারিত ছিল না। দুই বছর বোর্ড চাইলে আবার পুনর্নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়া যাবে। তবে সহায়ক কমিটি, অডিট কমিটি এবং নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যানের মেয়াদ হবে তিন বছর। অডিট কমিটির চেয়ারম্যান হবেন স্বতন্ত্র পরিচালক। তিনি পরপর দুই মেয়াদে চেয়ারম্যান থাকতে পারবেন না। নির্বাহী কমিটিতে একই পরিবারের একজন পরিচালক হতে পারবেন।
এছাড়া নতুন নীতিমালায় বলা হয়, বোর্ড মিটিংয়ে এজেন্ডার বাইরের কিছু আনা যাবে না। এজেন্ডা বোর্ড মিটিংয়ের দুই দিন আগে পরিচালকদের পাঠাতে হবে। আবার পর্ষদ সভায় বহিরাগত কেউ থাকতে পারবেন না। আবার কোনো পরিচালক কোনো বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট দিলে তা কার্যবিবরণীতে থাকতে হবে। ঢাকার বাইরে কোনো সভা অথবা অনুষ্ঠান করা যাবে না। করতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হবে, যা আগের নীতিমালায় ছিল না।
অন্যদিকে বোর্ড মিটিংয়ের সম্মানী বাড়ানো হয়েছে। আগে প্রতি বোর্ড মিটিং বা সহায়ক কমিটির মিটিংয়ে পরিচালকরা সম্মানী আট হাজার টাকা পেতেন। তা এখন ১০ হাজার টাকা করা হয়েছে। এছাড়া স্বতন্ত্র পরিচালকদের জন্য মাসে ৫০ হাজার টাকার স্থায়ী সম্মানী নির্ধারণ করা হয়েছে।
এতে আরও বলা হয়, বিশেষায়িত ব্যাংক ব্যতীত অন্য যে কোনো ব্যাংক-কোম্পানির কোনো পরিচালককে তার পদ থেকে অপসারণ করতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন নিতে হবে।
আমানতকারীদের স্বার্থের পরিপন্থি কার্যকলাপ সম্পাদন বা স্বার্থসংশ্লিষ্ট লেনদেনের মাধ্যমে তহবিলের অপব্যবহার বা মানি লন্ডারিং বা সন্ত্রাসী কাজে অর্থায়ন কিংবা জনস্বার্থবিরোধী কার্যকলাপে জড়িত থাকার কারণে ‘ব্যাংক-কোম্পানি আইন, ১৯৯১’-এর ৪৬ ধারার আওতায় পরিচালক বা চেয়ারম্যানকে অপসারণ এবং ৪৭ ধারার আওতায় যে কোনো ব্যাংকের পর্ষদ বাতিল করতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই কারণে যে কোনো পরিচালককে ৪৫ ধারায় অপসারণ করতে পারবে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আবার এ ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন পরিচালক নিয়োগ ও পর্ষদ পুনর্গঠন করতে পারবে।