ইসমাইল আলী: আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি দামে ২৫টি ব্রড গেজ ইঞ্জিন (লোকোমোটিভ) কিনছে রেলওয়ে। এজন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৭২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ ইঞ্জিনপ্রতি দাম পড়বে গড়ে ৪২ কোটি ৯০ লাখ টাকা। আর ভ্যাট-কর ছাড়া দাম ধরা হয়েছে ৩১ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। এ হিসেবে প্রতিটি ইঞ্জিনের দাম বেশি ধরা হয়েছে ৭ কোটি ৩৩ লাখ টাকা, যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে খোদ রেলপথ মন্ত্রণালয়।
সম্প্রতি রেলপথ মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) পরীক্ষণ কমিটির সভায় অতিরিক্ত দামের বিষয়টি উঠে আসে। বিষয়টির যৌক্তিকতাও জানতে চাওয়া হয় সভায়। এছাড়া প্রকল্পটির ভ্যাটের হিসাবেও রয়েছে জটিলতা। এ বিষয়েও প্রশ্ন করা হয়। আর প্রকল্পের আওতায় বিদেশ ভ্রমণ, প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও আসবাব কেনা তো আছেই।
রেলওয়ের গেজেট ইন্টারন্যাশনালের তথ্যমতে, ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা রাইটসের তৈরি ৩ হাজার ৬০০ হর্সপাওয়ারের ব্রড গেজ ইঞ্জিনের দাম ২২-২৩ কোটি টাকা। কোরিয়া থেকে কেনা হলে এক্ষেত্রে দাম পড়বে ২৪ কোটি টাকার মধ্যে। স্পেনের তৈরি ইঞ্জিনের দামও একই ধরনের। তবে ফ্রান্স বা জার্মানি থেকে কেনা হলে ব্যয় কিছুটা বেশি হবে। এক্ষেত্রে দাম পড়তে পারে ২৫ কোটি টাকা।
বাজারমূল্যের সঙ্গে ইঞ্জিনপ্রতি সাড়ে ছয় কোটি টাকা ভ্যাট-কর যোগ করলে ৩১-৩২ কোটি টাকায় ব্রড গেজ ইঞ্জিন পাওয়া যাবে। যদিও প্রতিটি ইঞ্জিনের দাম ধরা হয়েছে ৪২ কোটি ৯০ লাখ টাকা।
রেলওয়ের প্রকৌশলীরা জানান, ৭০টি মিটার গেজ ইঞ্জিন কেনায় গত বছর দরপত্র আহ্বান করে রেলওয়ে। ২০১১ সালে ইঞ্জিন কেনার প্রকল্পটি অনুমোদন করা হয়। সে সময় দাম ধরা হয় ভ্যাট-কর ছাড়া ২০ কোটি টাকা। তবে গত বছর দরপত্রে ২০ কোটি টাকারও কম প্রস্তাব করে স্পেনভিত্তিক সুইস কোম্পানি স্ট্যাডলার রেইল। এ হিসেবে ছয় বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে ইঞ্জিনের দাম বাড়েনি।
যদিও গত পাঁচ বছরে ৩০ শতাংশ দাম বেড়েছে ধরে ইঞ্জিনের ব্যয় প্রাক্কলন করেছে রেলওয়ে। প্রকল্পটির ডিপিপিতে বলা হয়, ২০১২ সালে ভারত থেকে কেনা ইঞ্জিনের দাম পড়ে ২৪ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। তার ওপর বছরপ্রতি ৫ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি ধরে ২৫ ইঞ্জিন কেনার ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়। এ বিষয়ে যৌক্তিকতা জানতে চাওয়া হয় ডিপিপি পরীক্ষণ কমিটির বৈঠকে।
সূত্র জানায়, ২০১২ সালেই দ্বিগুণের বেশি দামে ইঞ্জিন কেনা হয় ভারত থেকে। সে সময় ৩০টি ইঞ্জিন কেনার আগে বিভিন্ন দেশের দর যাচাই করা হয়। এতে প্রতিটি ইঞ্জিনের দাম ধরা হয় (ভ্যাট ছাড়া) ১২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। কাস্টম শুল্ক, ভ্যাট ও অন্যান্য করসহ ইঞ্জিনপ্রতি মোট ব্যয় হওয়ার কথা ২০ কোটি ২৬ লাখ টাকা। সে অনুযায়ী ৩০টি ইঞ্জিন কেনায় ৬০৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়। এর ভিত্তিতে প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) অনুমোদন করে।
দরপত্র আহ্বানের পর ভারতের রাইটস লিমিটেড প্রতিটি ইঞ্জিনের দাম প্রস্তাব করে (ভ্যাট ছাড়া) ২৬ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। ভ্যাট ও অন্যান্য করসহ ইঞ্জিনপ্রতি ব্যয় দাঁড়ায় ৩৮ কোটি ৬ লাখ টাকা। এতে ৩০টি ইঞ্জিন কেনায় ব্যয় দাঁড়ায় ১ হাজার ১৪২ কোটি টাকা। তবে ৫৩৩ কোটি টাকা অতিরিক্ত দরকার হলেও তার সংস্থান পায়নি রেলওয়ে। ফলে প্রকল্প কাটছাঁট করা হয়। সে সময় ৩০টির পরিবর্তে ১৬টি ইঞ্জিন কেনার চুক্তি হয়।
রেলওয়ের প্রকৌশলীরা বলছেন, ভারতের ঋণের শর্তই ছিল দেশটি থেকে ইঞ্জিন কিনতে হবে। তাই দ্বিগুণের বেশি দাম হলেও কোনো বিকল্প ছিল না। তবে এবার এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণে এবার ইঞ্জিন কেনায় উš§ুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হবে। তাই কম দর পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। তাই এক্ষেত্রে অতিরিক্ত দরপ্রস্তাবকে অযৌক্তিক বলে মনে করছেন তারা।
এদিকে ইঞ্জিন কেনার অজুহাতে বিদেশে শিক্ষা সফর বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ কোটি টাকা। আবার প্রশিক্ষণ বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে আরো ৮০ লাখ টাকা। এছাড়া প্রকল্পটির ডিপিপিতে ব্যয় বিশ্লেষণে কর ও ভ্যাট বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে ২০১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। তবে এর খাতভিত্তিক বিশ্লেষণের সংযোজনীতে এ ব্যয় দেখানো হয়েছে ২০৯ কোটি ৫৬ লাখ টাকা।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আমজাদ হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, ভারত থেকে কেনা ইঞ্জিনের দাম নিয়ে অনেক বিতর্ক ছিল। তবে ভারতের ডলার ক্রেডিট লাইন ঋণের অন্যতম শর্ত ছিল দেশটি থেকে কেনাকাটা করতে হবে। তাই বেশি দামেই ইঞ্জিনগুলো কিনতে হয়েছে। তবে এবার ইঞ্জিন কেনা হচ্ছে ৩ হাজার ৩০০ থেকে ৩ হাজার ৬০০ হর্সপাওয়ারের। আর ভারত থেকে কেনা হয়েছিল ৩ হাজার ১০০ হর্সপাওয়ারের। এজন্য দাম কিছুটা বেশি হতে পারে। তবে দরপত্র চূড়ান্ত হলে বোঝা যাবে ব্যয় বেশি হচ্ছে, নাকি কম। অন্যান্য ব্যয়ও প্রয়োজনে কাটছাঁট করা হবে। সে অনুযায়ী প্রকল্প ব্যয় সমন্বয় করা হবে।
উল্লেখ্য, ২৫টি ইঞ্জিন কেনায় এডিবির কাছে ৮৪৫ কোটি ৩১ লাখ টাকা ঋণ চাওয়া হয়েছে। সুদহার কিছুটা বেশি হওয়ায় এ ঋণের শর্ত নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। প্রকল্পটিতে সরকারি তহবিল থেকে সরবরাহ করা হবে ২২৭ কোটি ১৪ লাখ টাকা।