৩০ হাজার নারীর হাট

OLYMPUS DIGITAL CAMERA

অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছে এমন একটি হাট গাউসিয়া। নারায়ণগঞ্জের এ হাট সম্পর্কে বিস্তারিত জানাচ্ছেন রাসেল আহমেদ

বাড়ির কাছে আরশিনগর রাজধানীর অদূরে ভুলতার গাউসিয়া হাটে অভাবনীয় বাণিজ্যের ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটে চলছে। ‘লক্ষ্মীর হাট’ বসে এখানে। প্রতি মঙ্গলবার সারা দেশের কাপড় ব্যবসায়ীদের বিপণন-তীর্থ হয়ে ওঠে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশের এই মোকাম। প্রায় তিন যুগের কিংবদন্তি হয়ে ওঠা এই বস্ত্র-হাটের অলিগলি

আলো-আঁধারিতে হাজার হাজার দোকানের বিস্ময় হাজারও ক্রেতার ভিড়ে পা ফেলা দায়। ব্যবসায়ীদের জন্য এখানে দিন-রাতের ফারাক থাকে না। ফুরসত মেলে না নাওয়া-খাওয়া ও ঘুমের। সপ্তাহের একদিন বিক্রিবাট্টা হয় অবিশ্বাস্য অঙ্কের। শুধু মঙ্গলবারই বিক্রি হয় প্রায় ২০ কোটি টাকার পণ্য। আর এ হাটের ক্রেতা সব নারী। এ হাটকে ঘিরে সারা দেশের প্রায় ৩০ হাজার নারীর ভাগ্যের চাকা সচল হয়েছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, নিশুতি রাতের সুসুপ্তি যখন চরাচরজুড়ে নিথর-নিস্তব্ধ অধিকার করে নেয়, তখন শুরু হয় এ হাটের হাঁকডাক। দরদামের কোলাহলের পাশাপাশি বেড়ে যায় কুলিদের ব্যস্ততা। মার্কেটের সামনে ভ্যানের দীর্ঘ সারি। হাটের গা ঘেঁষে সড়কে ট্রাকের বহর। কাপড়ের বিশাল গাঁইট উঠছে, নামছে। লোড নিয়ে চলেছে দূর-অদূর গন্তব্যে। সেই ১৯৭৯ সাল থেকে আজ অব্দি ব্যবসার কৌলীন্য এই হাটকে ইতোমধ্যে ‘প্রাচ্যের ম্যানচেস্টার’ উপাধি দেওয়া হয়েছে। গাউসিয়া মার্কেটের থান কাপড়ের ভাঁজে ভাঁজে রঙের গন্ধ। বেশি ক্রেতা, বেশি বিক্রি। এর বাইরে আর কোনো দৃশ্য নেই। একসময় কেবল শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা ও চাদরের জন্য যে গাউসিয়া হাটের সুখ্যাতি ছিল, তার বর্ণাঢ্যতা এখন প্রশস্ত হয়েছে। বর্তমানে এ হাটটি দেশের বড় তাঁতবস্ত্র বিপণনকেন্দ্র। রুমাল থেকে জামদানি শাড়ি, মাথার টুপি থেকে পাঞ্জাবি সব মেলে এই হাটে। ছাপা কাপড়, থান কাপড়, সুতি কাপড়, থ্রিপিস, ওড়না, শার্ট-প্যান্ট কী নেই এখানে। রমজানের ঈদে বাড়তি যোগ হয় জাকাতের কাপড়।

চট্টগ্রাম, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল, সিলেট, রংপুর, বগুড়া, জামালপুর, ময়মনসিংহ, পাবনা, ভোলা, কিশোরগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, সিরাজগঞ্জসহ দেশের সব প্রান্তের পাইকারি ক্রেতার ভিড়ে মুখর গাউসিয়া হাট। ব্যবসায়ীদের কোনো টোল জমা, খাজনা বা চাঁদা দিতে হয় না। টোল-খাজনা না থাকায় গাউসিয়া হাটই ব্যবসায়ীদের প্রথম পছন্দ। তাছাড়া চোরবাটপার কিংবা ছিনতাইকারীর কোনো ভয় নেই।

গত মঙ্গলবার। ঘড়ির কাঁটা তখন ভোর সাড়ে ৫টা। ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক নীরব-নিথর। কিছু দূরে কয়েকজন মহিলার জটলা। কারও হাতে ভ্যানিটি ব্যাগ। আবার কারও হাতে চটের বস্তা। তাদের কারও বাড়ি যশোরে, কারও বাড়ি নোয়াখালী, কারও বাড়ি চট্টগ্রামে। আবার কারও বাড়ি জামালপুর, পটুয়াখালীতে। দারিদ্র্যতা ছিল তাদের নিত্যসঙ্গী। তাই দারিদ্র্যকে জয় করতে তারা একেকজন জীবনযুদ্ধ আর জীবিকা নির্বাহের অগ্রনায়িকা। তারা সবাই আজ স্বাবলম্বী। প্রতি মঙ্গলবার সারা দেশের প্রায় ৩০ হাজার নারী রূপগঞ্জের গাউসিয়া মার্কেটে এসে সমবেত হন। গাউসিয়া মার্কেট তাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছে।

মার্কেট কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, রাজধানী ঢাকা থেকে ২৪ কিলোমিটার পূর্বে ভুলতা এলাকার ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশ ঘেঁষে গড়ে উঠেছে গাউসিয়া মার্কেট। ১৯৭৯ সালে ছোট পরিসরে বেচাকেনা শুরু হয়। পরে ১৯৮৫ সালের ৪ জানুয়ারি গাউসিয়া মার্কেটের প্রথম ভবন গড়ে ওঠে। পরে ১২০ বিঘা জমির ওপর মার্কেট সম্প্রসারিত হয়। বর্তমানে গাউসিয়া-১ ও গাউসিয়া-২ মার্কেটে পাইকারি কাপড়, শাড়ি, ওড়না, লুঙ্গি, গামছা বিক্রি হয়।

সরেজমিনে নারী ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে অভাবীদের দারিদ্র্য জয়ের নানা তথ্য পাওয়া গেল। সকাল ৬টা। মার্কেটের ভেতরে কথা হয় ষাটোর্ধ্ব শরফুন বেগমের সঙ্গে। স্বামী এহান আলী পাঁচ বছর আগে মারা গেছেন। বাড়ি জামালপুরের মেলান্দহের গোয়ালপাড়া এলাকায়। ২০ বছর ধরে গাউসিয়া মার্কেট থেকে পাইকারি কাপড় কিনে নিয়ে এলাকায় ফেরি করে বিক্রি করেন। এক সময় নুন আনতে পান্তা ফুরাত। এখন সংসারে সচ্ছলতা ফিরে এসেছে। শরফুন বেগম বলেন বাজান, এহানতে কাপড় কিনা ভালাই আছি। দামে কম পাই। আর নাইলে কি হেই জামালপুরতে আহি!

প্রায় ১৮ বছর আগে মারা যান স্বামী আবদুল করিম। স্বামী মারা যাওয়ার পর চোখে সর্ষেফুল দেখতে থাকেন। সংসারের ঘানি টানতে হিমশিম খান। অবশেষে এলাকার শরফুন বেগমের পরামর্শে গাউসিয়া থেকে কাপড় কিনে নিয়ে এলাকায় বিক্রি করতে থাকেন জুলেখা বেগম। আজ তিনি স্বাবলম্বী। কাপড়ের ব্যবসা করে সংসার চালানোর পাশাপাশি তিন শতাংশ জমি কিনেছেন। জুলেখা বেগম বলেন, সোয়ামি মইরা যাওনের পর দিশাহারা অইয়া গেছিলাম। শরফু বুবু আমারে পথ দেহাইছে। আমি অহন ভালা আছি। এহানকার কাপড়ের দাম কম। কিনা লাব (লাভ) পাই। পটুয়াখালী আদালতপাড়ার নূরজাহান বেগম। আদালতপাড়ার লঞ্চঘাটে তার কাপড়ের দোকান। প্রতি সোমবার লঞ্চে করে আসেন ঢাকায়। এরপর আসেন গাউসিয়া মার্কেটে। সপ্তাহে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকার কাপড় কিনে নেন। নূরজাহান বেগম জানান, ভালাই আছি। ১০ হাজার টেকার কাপড় নিলে লাভ ভালাই অয়। অন্যহান থেইক্যা কাপড় কিনলে লাভ অয় না। হের লেইগ্যাই এহান থেইক্যা কাপড় কিনা নি। কাপড় কিনে বের হওয়ার সময় কথা হয় চট্টগ্রামের পাহাড়তলী থেকে আসা হুসনে আরা বেগমের সঙ্গে। স্বামী আলী আহাম্মদ রিকশা চালান। স্বামীর আয়ের টাকায় সংসার চালানো দায়। তাই পাশের বাড়ির জেসমিন আক্তারের পরামর্শে গাউসিয়া থেকে কাপড় কিনে নিতে এসেছেন। হুসনে আরা বেগম বলেন, ভাই ভালাই আছি। সংসার চালাইতে গিয়া অনেক কষ্ট করছি। অহন ডাইল-ভাত খাইবার পারি। যশোরের রহিমপুর এলাকার কামালউদ্দিনের সঙ্গে খায়রুন বেগমের বিয়ে হওয়ার পর অভাবের তাড়নায় ৯ বছর আগে ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে এসে বসবাস শুরু করেন। এরপর স্বামী তাকে ফেলে রেখে অন্যত্র বিয়ে করে চলে যান। কোনো উপায় না পেয়ে বাসাবাড়িতে কাজ নেন খায়রুন বেগম। এক সময় গলার চেইন বিক্রি করে গাউসিয়া মার্কেট থেকে শাড়ি, ওড়না, গামছা কিনে নিয়ে ফেরি করে বিক্রি করেন। এখন তিনি স্বাবলম্বী। খায়রুন বেগম বলেন, গাউসিয়া মার্কেট আমার ভাগ্যের চাকা ফিরাইয়া দিছে। এখানে কাপড়ের দাম অনেক কম। তাদের মতো মুন্সীগঞ্জের করিমন বেগম, সিলেটের আঙ্গুর বালা, ঢাকার রায়েরবাগের মণি বেগমসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় ৩০ হাজার নারী প্রতি মঙ্গলবার গাউসিয়া মার্কেট থেকে পাইকারি কাপড় কিনে নিয়ে যান।

গাউসিয়া মার্কেটের দোকান মালিকরা জানান, এখানে পাইকারি কাপড়ের দোকান রয়েছে সাড়ে চার হাজারের ওপরে। তবে এসব দোকান খোলা থাকে মঙ্গলবার। অন্য দিনগুলোয় কিছু দোকান বন্ধ থাকে। মঙ্গলবারে একেকটি দোকানে বিক্রি হয় কমপক্ষে এক থেকে দেড় লাখ টাকা। আবার কোনো কোনো দোকানে পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকা বিক্রি হয়। রহিম শাড়িকাপড় বিতানের মালিক আবদুর রহিম বলেন, ভাই ব্যবসা ভালাই। তয় দেশের পরিস্থিতি খারাপ অইলে ব্যবসা মন্দা হয়। আমাগো কাস্টমার সব মহিলা। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেইক্যা আহে। আগে বেচবার পারতাম দেড়-দুই লাখ টাকা। অহন বেচি মাত্র ৪০-৫০ হাজার টাকা। সিটি প্রিন্ট শাড়ির মালিক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, আগে বেচবার পারতাম লাখ পাঁচেক টাকা। আর অহন বেচবার পারি লাখখানেক টাকা। আরেক ব্যবসায়ী আশিকুর রহমান জানান, প্রতি মঙ্গলবার সাড়ে চার হাজার পাইকারি দোকানদার এক লাখ থেকে ১০ লাখ টাকার পণ্য বেচাকেনা করেন। মার্কেটের ম্যানেজার আবদুল আউয়াল বলেন, মার্কেটে সারা দেশ থেকে প্রায় ৩০ হাজার নারী ক্রেতা আসেন; এটা ভাগ্যের বিষয়। তাই নারী ক্রেতাদের কথা চিন্তা করে নিরাপত্তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ছিনতাই, চুরি কিংবা ডাকাতির ঘটনা যেন না ঘটে, সেদিকে রয়েছে বিশেষ নজর। মার্কেটের পাশে রয়েছে পুলিশ ফাঁড়ি। রয়েছে নিরাপত্তা প্রহরীও।

মার্কেটের মালিক মুস্তাফিজুর রহমান ভূঁইয়া দিপু বলেন, গাউসিয়া মার্কেটের ৮০ ভাগ ক্রেতাই মহিলা। ঢাকার বাইরে থেকে যেসব নারী কাপড় কিনতে আসেন, তাদের অনেক কষ্ট হয়। সে বিবেচনা মাথায়  রেখে পরিকল্পনা করেছি গাউসিয়ায় একটি মহিলা রেস্ট হাউজ তৈরি করব। কম খরচে মহিলারা এখানে রাতযাপন করতে পারবেন। আর ব্যবসায়ীদের কথা চিন্তা করে মার্কেটের পাশেই তৈরি করা হবে অ্যাপার্টমেন্ট।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০