সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক) প্রদত্ত সেবার বিপরীতে ১৯৮৬ সালে ট্যারিফ নির্ধারণ করেছিল। তখন ডলারের বিনিময় হার ছিল ৩৭ টাকা। এখন ৮৭ টাকার বেশি। ১৯৮৬-৮৭ সালের খোলা পণ্য আমদানি হয়েছিল ৬২ লাখ ৩৯ হাজার টন, কনটেইনার হ্যান্ডলিং ৫০ হাজার টিইইউএস ও এক হাজার জাহাজ হ্যান্ডলিং। ২০২০ সালে খোলা পণ্য ৯ কোটি ৪৮ লাখ টন, কনটেইনার হ্যান্ডলিং ২৫ লাখ ৮৭ হাজার ও জাহাজ হ্যান্ডলিং তিন হাজার ৭৬৭টি। অর্থাৎ বন্দরের অপারেশনাল ও নন-অপারেশনাল রাজস্ব আয়ের সুযোগ বহুগুণ বেড়েছে।
অন্যদিকে বন্দর ব্যবহারকারীদের মাশুল না বাড়লেও ব্যবসায়িক ব্যয় কয়েক গুণ বেড়েছে। খরচ দ্বিগুণ হয়েছে। তাই ব্যবসায়ীরা নতুন করে মাশুল বাড়ার কোনো যৌক্তিকতা দেখছেন না।
এদিকে নানা সেবার বিপরীতে ৩৫ বছর পর ট্যারিফ বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে চবক।
বন্দর কর্তৃপক্ষ ও বন্দর ব্যবহারকারী সূত্র জানায়, বন্দর কর্তৃপক্ষ ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে নানা ধরনের সেবার বিপরীতে মাশুল আদায় করে থাকে। বর্তমানে যে মাশুল নেয়া হচ্ছে তা ১৯৮৬ সালে নির্ধারণ করা হয়েছিল। এরপর ১৯৯০, ২০০৩, ২০০৫, ২০০৭ ও ২০০৮ সালে কয়েক দফায় কিছু উপখাতে সেবার মাশুল বাড়ানো হয়। তবে দুই বছর আগে ২০১৯ সালে মাশুল বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। তখন ১৫টি সেবার বিপরীতে নানা উপখাতে মাশুল ৩৩ থেকে ৪৮৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। এর মধ্যে বন্দর কর্তৃপক্ষ পোর্ট ডিউজ, পাইলটেজ ফি, বার্থিং-আনবার্থিং ফি, বার্থে অবস্থান, মুরিংয়ে অবস্থান, পানি সরবরাহ চার্জ, রিভার ডিউজ (প্রথাগত) ও ল্যান্ডিং অথবা শিপিং চার্জ (প্রথাগত), বন্দরের স্থান ব্যবহার ভাড়া (স্পেস রেন্ট), কনটেইনার বোঝাই ও খালাসকরণ, রেফার কনটেইনার সেবা, রিভার ডিউজ (কনটেইনারাইজড), লিফট অন/লিফট অফ চার্জ (চট্টগ্রাম বন্দর), লিফট অন/লিফট অফ চার্জ (ঢাকা আইসিডি) ও ঢাকার আইসিডিতে কনটেইনারের স্টোরেজ ভাড়া খাতে মাশুল বাড়ানোর প্রস্তাবনা উল্লেখযোগ্য। কিন্তু বন্দর ব্যবহারকারীদের বিরোধিতার মুখে তা হয়নি।
পরবর্তীকালে বিষয়টি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। মন্ত্রণালয় থেকে মাশুল বাড়ানোর বিষয়ে মতামত দেয়া হলেও নানা জটিলতায় তা আর হয়ে ওঠেনি। পরে করোনা মহামারির কারণে বিষয়টি চাপা পড়ে যায়। করোনার প্রকোপ কমে আসায় আবার বন্দর কর্তৃপক্ষ নতুন করে মাশুল বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়। এজন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ নানা সেবার মাশুল বাড়াতে আন্তর্জাতিক একটি পরামর্শক টিম নিয়োগ দিয়েছে। এ টিমে রয়েছে স্পেনের মেসার্স আইডিওম কনসালটিং, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড আর্কিটেক্ট ও দেশীয় প্রতিষ্ঠান মেসার্স এস লজিকফোরাম লিমিটেড। এ কারিগরি টিম এরই মধ্যে নানা বিষয়ে সমীক্ষা ও অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেছে। গত ১২ নভেম্বর বন্দর কর্তৃপক্ষ বন্দর ব্যবহারকারীদের মতামত চেয়ে চিঠি দেয়। এরই মধ্যে বন্দর ব্যবহারকারীরা মতামত দিয়েছেন। আরও কয়েক দফা আলোচনা চলবে। তারপর কারিগরি টিম তাদের প্রতিবেদন বন্দর কর্তৃপক্ষকে পেশ করবে।
আমদানি ও রপ্তানি কার্যক্রমে জড়িত ব্যবসায়ীরা বলেন, সিঙ্গাপুর কিংবা ইউরোপের পোর্টগুলোয় ঘণ্টায় গড়ে ৬০ কনটেইনার ওঠানামা হয়। আর আমাদের চট্টগ্রাম বন্দরে ঘণ্টার গড়ে ১৬ থেকে ১৮টা কনটেইনার ওঠানামা হয়। এতে আমাদের ব্যয় বেশি হচ্ছে। সময়ও নষ্ট হচ্ছে। আবার কোনো ঘটনা ঘটলে তো অচল হয়ে যায় বন্দর। তখন আমাদের অতিরিক্ত ব্যয় ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ বেড়ে যায়। আর আমদানির গতির সঙ্গে বন্দরের সক্ষমতা বাড়েনি। অথচ বন্দরের ফান্ডে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা অলস পড়ে রয়েছে। আমরা জানি, বন্দর অনেকগুলো প্রকল্প গ্রহণ করেছে। সেজন্য টাকা প্রয়োজন। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারি উদ্যোগে অর্থায়ন বা পিপিপির মাধ্যমে কিংবা পুঁজিবাজারের বন্ড ছেড়ে নিতে পারে।
তারা আরও বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে পাঁচটি সেবায় ২৩ শতাংশ মূল্য বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপোস অ্যাসোসিয়েশন (বিকডা)।অন্যদিকে লাইটারেজ জাহাজের ভাড়াও ১৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এর আগে জাহাজ ভাড়া ও কনটেইনার ভাড়া দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। সব মিলিয়ে করোনার মধ্যেও ব্যবসায়িক ব্যয় দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। তাই সেবার মাশুল বাড়ানো উচিত হবে। তখন দেশের সাধারণ মানুষের ওপর চাপ বাড়বে। এমনিতে মানুষ অনেক চাপে রয়েছে।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরওয়ার্ডস অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি খায়রুল আলম সুজন বলেন, বন্দর কর্তৃপক্ষ ১৯৮৬ সালে ট্যারিফ নির্ধারণ করলেও তা অনেক বেশি। তখন ডলারের বিনিময় হার ছিল ৩৭ টাকা। আর এখন ৮৭ টাকার বেশি। বন্দরের উচিত ট্যারিফ না বাড়িয়ে অপারেশনাল কাজে গতি এনে প্রচলিত হারে মাশুল আদায় করা। সবচেয়ে বড় কথা, বন্দর আমাদের কাছ থেকে অধিকাংশ মাশুল আদায় করে ডলারে। ১৯৮৬ সালে ডলারের বিনিময় হার ছিল ৪০ টাকার নিচে। বর্তমানে ডলারের বিনিময় হার প্রায় ৮৭ টাকা। এতে মাশুল না বাড়লেও আমাদের খরচ কিন্তু দ্বিগুণ হয়ে গেছে। আবার প্রচলতি বিনিময় হার থেকে এক টাকা বেশি নেয়া হয়।
বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রধান অর্থ ও হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, বন্দরে নানা সেবার মান বেড়েছে, নানা প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি সংযোজন করা হয়েছে। সব মিলিয়ে বন্দরের সক্ষমতা বেড়েছে। আর ভবিষ্যতে আরও ভালো মানের সেবাদানের জন্য চলমান মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন ও প্রতিবেশী দেশগুলোর ট্যারিফ রেটের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ট্যারিফ নির্ধারণ ও আধুনিকায়ন করা প্রয়োজন। সব মিলিয়ে ১৯৮৬ সালে নির্ধারিত মাশুলে সেবা দেয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করে মাশুল বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এখন সবার সঙ্গে আলোচনা করে পরে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
উল্লেখ্য, ২০২০ সাল শেষে চট্টগ্রাম বন্দরের রাজস্ব আয় হয়েছিল দুই হাজার ৯০৪ কোটি টাকা। এর বিপরীতে পরিচালন ব্যয় হয়েছে এক হাজার ৭৭০৮ কোটি টাকা। আর পরবর্তীকালে লাভ ছিল ৭২৮ কোটি টাকা, আগের বছর যা ছিল ৮০৭ কোটি টাকা। এ সময় সুদজনিত আয় ছিল ৫৩৩ কোটি টাকা।