৪১ বছর ধরে পরিত্যক্ত ঠাকুরগাঁও বিমানবন্দর

শামসুল আলম, ঠাকুরগাঁও: ঠাকুরগাঁওয়ে কোনো বড় শিল্পকারখানা নেই। এর একমাত্র কারণ যোগাযোগ ব্যবস্থা। এ কারণে রাজধানীর কোনো শিল্পোদ্যোক্তা এখানে কোনো ভারী প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে আগ্রহ দেখাননি।

এককালে ঐতিহ্য ও সম্ভাবনাময় জনপদ ছিল ঠাকুরগাঁও। কালক্রমে হারিয়ে গেছে সেই ঐতিহ্য। যেমন ১৯৪৫ সালে ব্রিটিশ আমলে প্রায় আড়াইশ’ একর জমির ওপর নির্মিত হয় ঠাকুরগাঁও বিমানবন্দর। এটি চালু হয় ১৯৬৬ সালে। মুক্তিযুদ্ধের সময় কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ঢাকা থেকে সরাসরি ফ্লাইট চলাচল করেছে, এরপর বন্ধ হয়ে যায়।

সম্ভাবনা থাকার পরও নানা জটিলতার কারণে দীর্ঘদিনেও চালু করা সম্ভব হয়নি ঠাকুরগাঁও বিমানবন্দর। সরজমিন দেখা গেছে, প্রায় ৪১ বছর ধরে পরিত্যক্ত বিমানবন্দরটি। নষ্ট হয়ে গেছে স্টল ভবনের দরজা-জানালা ও রানওয়ের কার্পেট। চুরি হয়ে গেছে সীমানা পিলারসহ তারের বেড়া। গোচারণ ভূমিতে পরিণত হওয়া এ বিমানবন্দরের রানওয়ে এখন বছরজুড়ে ব্যবহƒত হচ্ছে খেলার মাঠ এবং ধান, গম ও ভুট্টা শুকানোর কাজে। অথচ এটি চালু করা গেলে একদিকে যেমন যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হতো অন্যদিকে এ অঞ্চলের অর্থনীতিতে যোগ হতো নতুন মাত্রা।

বিমানবন্দরটির রানওয়ে দৈর্ঘ্যে ছয় হাজার ফুট, প্রস্থে ৬০০ ফুট। বিমানবন্দরটিতে একটি টার্মিনাল ভবন পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। প্রায় আড়াইশ’ একর জমির মধ্যে বর্তমানে ১৫০ একর জমিতে সরকারিভাবে অথবা লিজ দিয়ে চাষাবাদ করা হচ্ছে।

বিমানবন্দরটি নির্মাণের পর দীর্ঘদিন চালু ছিল। পাকিস্তান আমলেও ত্রাণসামগ্রী পরিবহনসহ জরুরি কাজে এটি ব্যবহƒত হতো। স্বাধীনতার পর ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত রাজধানীর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। সে সময় ঢাকা-ঠাকুরগাঁও রুটে নিয়মিত বিমান চলাচল করত। তখন থেকে ঠাকুরগাঁও বিমান বন্দরটি উত্তরের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনপদের সঙ্গে রাজধানীর বিমান যোগাযোগের একমাত্র অবলম্বন হয়ে পড়ে। কিন্তু ১৯৮০ সালে লোকসানের অজুহাতে এ বিমানবন্দরটিকে বন্ধ করে দেয়া হয়।

পরবর্তীকালে জনগণের দাবিতে ১৯৯৪ সালে এ বিমানবন্দরটি পুনরায় চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়। সে জন্য এক কোটি টাকা ব্যয়ে রানওয়ে মেরামত, টার্মিনাল ভবন নির্মাণ ও বিদ্যুতায়নসহ নানা সংস্কার করা হয়। এয়ারবেঙ্গল ও বোরাকসহ ছয়টি বেসরকারি সংস্থা ঢাকা-ঠাকুরগাঁও রুটে স্টল বিমান সার্ভিস চালু করার জন্য বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে চুক্তিও সম্পাদন করে। কিন্তু সেই চুক্তি আর বাস্তবায়ন হয়নি। এর কয়েকদিনের মধ্যে স্টল বিমান সার্ভিস চালুর প্রক্রিয়াও বন্ধ হয়ে যায়।

তবে সময় গড়িয়েছে, অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। বন্দরটি চালু হওয়া এখন সময়ের দাবি। সৈয়দপুর বিমানবন্দরের প্রায় ৮০ ভাগ যাত্রী ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড় ও দিনাজপুরের। ঠাকুরগাঁও বিমানবন্দর থেকে ১০ থেকে ১৫ মিনিটে ভারতের বাগডোগরা বিমানবন্দরে অবতরণ করা সম্ভব। ট্রানজিট ফ্লাইটে আশেপাশের কয়েকটি দেশে যাওয়া সম্ভব। অথচ একটি সময়োপযোগী আন্তরিক সিদ্ধান্তের জন্য বঞ্চিত হচ্ছেন তিন জেলার মানুষ। ব্যাহত হচ্ছে অর্থনীতি।

২০১৬ বিমানবন্দরটি চালু করার কথা থাকলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। সে সময় বর্তমান সরকারের বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী ছিলেন রাশেদ খান মেনন। তিনি বিমানবন্দরের অবকাঠামো পরিদর্শন করেন। পরে সেখানে তিনি বিমানবন্দর চালু করার বিষয়ে নানা পেশার মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেন। রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘ব্রিটিশ আমলে আড়াইশ’ একর জমির ওপর নির্মিত এ বিমানবন্দরে বিমান চলাচলের সব ধরনের অবকাঠামো রয়েছে। এটি চালু করতে তেমন কোনো খরচ হবে না। এটি চালু করার জন্য যা দরকার, আমরা তিন মাসের মধ্যে সে কাজ শুরু করব।

পরে সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আঞ্চলিক বিমানবন্দরে রূপান্তর করার অনুমতি দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পঞ্চগড় স্থলবন্দর চালু হলে এ এলাকায় বিমান লাভবান হবে। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। সর্বশেষ ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রীর আগমনে বিমানবন্দর চালুর স্বপ্ন দেখে ঠাকুরগাঁওবাসী। কিন্তু তা এখনও অধরা।

ঠাকুরগাঁও বিমানবন্দর চালু হলে ও পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের ইমিগ্রেশন চালু হলে এ এলাকার মানুষের মাঝে উন্নয়নের সঞ্চার ঘটবে বলে বিশিষ্টজনরা মনে করেন।

বিশিষ্টজনরা জানান, ঠাকুরগাঁও বিমানবন্দর চালুর সিদ্ধান্ত বারবার হয়েছে কিন্তু আলোর মুখ দেখেনি। বিমানবন্দরটি চালু হলে শুধু ঠাকুরগাঁওয়ের মানুষই সুবিধা ভোগ করবে না বরং আশেপাশের কয়েকটি জেলায় কয়েক লাখ মানুষ এর সুবিধা ভোগ করতে পারবেন। এতে বেকারত্বও দূর হবে।

ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় থেকে সৈয়দপুর বিমানবন্দরের বিমানের টিকিট বুকিং দেয়ার জন্য রয়েছে মোট পাঁচটি বুকিং অফিস। প্রতিদিন এ অফিসগুলোয় গড়ে ৫০ থেকে ৬০টি টিকিট বুকিং হয় ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় যাওয়ার জন্য। এ অবস্থায় ঠাকুরগাঁও বিমানবন্দর চালু হলে পঞ্চগড় ও দিনাজপুরসহ ঠাকুরগাঁওয়ের লোকজন সহজে এ বিমানবন্দর দিয়ে বিভিন্ন জেলায় যাতায়াত করতে পারবেন।

ঠাকুরগাঁওয়ের এসএস ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরসের পরিচালক রফিকুল ইসলাম রোহান বলেন, ঠাকুরগাঁও থেকে ঢাকা যাওয়ার বিমানের টিকিট অনেক বিক্রি হয়। যে পরিমাণ চাহিদা আমরা সে পরিমাণ সেবা দিতে পারছি না। টিকিট না পেয়ে মানুষ ফিরে যান। আমাদের ঠাকুরগাঁওয়ে বিমানবন্দর চালু হলে বিমান খাত লাভজনক খাতে পরিণত হবে ও মানুষ কম সময়ে দ্রুত বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছাতে পারবেন। অন্যদিকে বিমানবন্দরটি চালু হলে ভারতের অনেক ব্যবসায়ী এর সুবিধা নিতে পারবেন।

ঠাকুরগাঁও চেম্বার অব কর্মাসের সভাপতি হাবিবুল ইসলাম বাবলু জানিয়েছেন, ঠাকুরগাঁওয়ের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় ঢাকার ব্যবসায়ীদের এ অঞ্চলে শিল্পকারখানা গড়ে তুলতে আগ্রহ নেই। যদি বিমান বন্দর পুনরায় চালু হয়, তাহলে এ এলাকায় অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। এতে কর্মসংস্থান ও জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে। কার্গো বিমান চালু হলে অন্য জেলা থেকে পণ্য পরিবহন করা যাবে এবং এ এলাকার পণ্য সহজে ও কম খরচে বিভিন্ন জেলায় পাঠানো যাবে।

ঠাকুরগাঁও প্রেস ক্লাবের সভাপতি মনসুর আলীর মতে, ঠাকুরগাঁও বিমানবন্দর চালুর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। পরে আলোর মুখ দেখেনি। বিমান বন্দরটি চালু হলে শুধু ঠাকুরগাঁওয়ের মানুষ সুবিধা ভোগ করবেন না, আশেপাশের কয়েকটি জেলায় কয়েক লাখ মানুষ এর সুবিধা পাবেন।

ঠাকুরগাঁও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পরিষদ চেয়ারম্যান মুহম্মদ সাদেক কুরাইশী বলেন, সৈয়দপুর বিমানবন্দর কাছাকাছি হওয়ার কারণে ঠাকুরগাঁও বিমানবন্দরটি এখনও চালু হয়নি। তবে বিমানবন্দরটি চালুর জন্য আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

ডিসি মো. মাহাবুবুর রহমান বলেন, বিমানবন্দর চালু হোক এটা কে না চায়? তাহলে এ এলাকার অনেক মানষের কর্মসংস্থান হবে, শিল্পকারখানা নির্মাণ হবে। ফলে ঠাকুরগাঁওসহ আশেপাশের কয়েক জেলার মানুষের অনেক উপকার হবে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০