ইসমাইল আলী: আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন (৪৭০ কোটি) ডলার ঋণ পাচ্ছে বাংলাদেশ। গত ৩০ জানুয়ারি এ-সংক্রান্ত ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে আইএমএফ বোর্ড। ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭৬ দশমিক ১৭ মিলিয়ন ডলার এরই মধ্যে পেয়েছে বাংলাদেশ। বাকি ঋণ পেতে বাংলাদেশের সময় লাগবে আরও প্রায় ৩৯ মাস। এজন্য ৩৭টি শর্ত দিয়েছে আইএমএফ। এর সঙ্গে সংস্কারের শর্ত রয়েছে আরও ১১টি। সব মিলিয়ে শর্তের সংখ্যা ৪৮টি।
ঋণের প্রথম কিস্তি ছাড়ের পর গত ২ ফেব্রুয়ারি (রাতে) বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল্যায়ন ও শর্ত বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে আইএমএফ। এতে ঋণ ছাড় হওয়ার টাইমফ্রেম ও শর্ত বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ঋণের মূল শর্ত ৩৭টি ও সংস্কার বিষয়ক শর্ত ১১টি। মূল শর্তের মধ্যে সামষ্টিক অর্থনীতি বিষয়ক শর্ত পাঁচটি, বাজেট সংশ্লিষ্ট শর্ত ১০টি, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, মুদ্রানীতি ও বিনিময় হার সংশ্লিষ্ট শর্ত আরও পাঁচটি, সামষ্টিক কাঠামো ও সুশাসন সংক্রান্ত শর্ত ছয়টি, আর্থিক খাত সংশ্লিষ্ট তিনটি ও জলবায়ু সংক্রান্ত শর্ত পাঁচটি, কাঠামো, পরিসংখ্যান ও মনিটরিং সংক্রান্ত শর্ত তিনটি। এসব শর্ত পূরণে মিলবে তিন দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার।
এর বাইরে সংস্কারের পৃথক ১১টি শর্ত দিয়েছে আইএমএফ। ওই শর্তগুলো পূরণে পৃথক এক বিলিয়ন ডলার দেয়া হবে। দ্বিতীয় কিস্তি থেকে শুরু করে প্রতিটি কিস্তি ছাড়ের আগে শর্ত পরিচালন ও সামষ্টিক অর্থনীতির পৃথক মূল্যায়ন করবে আইএমএফ প্রতিনিধিদল। শর্ত পূরণ হলেই কেবল মিলবে পরের কিস্তিগুলো।
গত ৩০ জানুয়ারি ঋণ অনুমোদনের পর বিজ্ঞপ্তিতে আইএমএফ জানায়, এক্সটেনডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি (ইসিএফ) বা বর্ধিত ঋণ সুবিধা ও এক্সটেনডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটি (ইএএফএফ) বা বর্ধিত তহবিল সুবিধার আওতায় ৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন বা ৩৩০ কোটি ডলার ঋণ পাবে বাংলাদেশ। আর আইএমএফের নতুন গঠিত তহবিল রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটির (আরএসএফ) আওতায় আরও ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন বা ১৪০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে।
ঋণ ছাড়ের টাইমফ্রেম বিশ্লেষণে দেখা যায়, আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি বাংলাদেশ পাবে চলতি বছর ১ নভেম্বর। তৃতীয় কিস্তি মিলবে আগামী বছর ১ মে ও চতুর্থ কিস্তি ১ নভেম্বর। ঋণের পঞ্চম কিস্তি আইএমএফ ছাড় করবে ২০২৫ সালের ১ মে ও ষষ্ঠ কিস্তি ৩১ ডিসেম্বর। আর সপ্তম কিস্তি ছাড় হবে ২০২৬ সালের ১ মে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল্যায়ন করতে গিয়ে আইএমএফ বেশকিছু দুর্বল দিক তুলে ধরে। এর মধ্যে রয়েছে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়া, বৈদেশিক মুদ্রা তথা রিজার্ভ সংকট, সরকারের সাম্প্রতিক কৃচ্ছ সাধন নীতি। অর্থনীতির মূল্যায়ন করতে গিয়ে আইএমএফ মন্তব্য করে, সরকারের সাম্প্রতিক কৃচ্ছ সাধন নীতি স্বল্পমেয়াদে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস করবে এবং মধ্যমেয়াদে অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
আইএমএফের মতে, চলতি অর্থবছর জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়াবে পাঁচ দশমিক ৫ শতাংশ। যদিও গত অর্থবছর তা ছিল সাত দশমিক ২ শতাংশ। তবে আগামী অর্থবছর প্রবৃদ্ধি বেড়ে সাত দশমিক ১ শতাংশে উঠবে বলে প্রক্ষেপণ করেছে সংস্থাটি। চলতি অর্থবছর প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে সরকারের ব্যয় ও বিনিয়োগের ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধিকে দায়ী করা হবে। সংস্থাটির মতে, চলতি অর্থবছর সরকারের ব্যয়ে সাড়ে সাত শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হবে। তবে ব্যক্তি খাতে সাত দশমিক ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে।
এদিকে চলতি সার্বিকভাবে বিনিয়োগে ছয় দশমিক ২ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হবে বলে প্রাক্কলন করেছে আইএমএফ। এছাড়া আমদানিতে ২২ দশমিক ৬ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি ও রপ্তানিতে সাত দশমিক ২ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে আইএমএফ। এছাড়া আগামী মাসে প্রকৃত রিজার্ভ দাঁড়াবে ২২.৯৪ বিলিয়ন ডলার বলে জানায় আইএমএফ। তবে জুনে তা বেড়ে দাঁড়াবে ২৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার।
প্রতিবেদনের শর্তগুলোর মধ্যে রয়েছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি ব্যবস্থার সংস্কার। এক্ষেত্রে সরকারের সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে ঋণগ্রহণকে ২০২৬ সালের মধ্যে মোট অর্থায়নের এক-চতুর্থাংশে নামিয়ে আনতে হবে। এক্ষেত্রে সঞ্চয়পত্রের সুদহারকে যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনা, পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় করা, প্রতিজনের জন্য সঞ্চয়পত্র কেনার সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দেয়া উল্লেখযোগ্য। সঞ্চয়পত্রের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে সরকারের অর্থায়ন ঘাটতি পূরণে বন্ড মার্কেট উন্নয়ন করতে হবে।
সরকারের ভর্তুকি ব্যয় কমাতে সার, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। এসব খাতে সরকারের ব্যয়কে যৌক্তিক করতে হবে। জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। এর আওতায় আন্তর্জাতিক বাজারদরের সঙ্গে সমন্বয় রেখে দেশে জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণ করতে হবে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে এটি করা হবে। বিদ্যুৎ খাতেও ভর্তুকির চাপ কমাতে হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে তা ২০২৬ সালের মধ্যে মূল্যস্ফীতিকে কমিয়ে ৬ শতাংশ নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে।
রাজস্ব খাত নিয়ে আইএমএফের শর্তের মধ্যে রয়েছে, কীভাবে কর আদায় বৃদ্ধি করা যায়Ñতা নিয়ে একটি কৌশল ঠিক করতে হবে, কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে হবে। শুল্ক-করের অব্যাহতির পরিমাণ কমাতে হবে। নিরীক্ষা কার্যক্রমে এনবিআরে শুল্ক, কর ও ভ্যাটÑএই তিন বিভাগের মধ্যে তথ্যের আদান-প্রদানের ব্যবস্থা শক্তিশালী করা, কর প্রশাসন স্বয়ংক্রিয় করা, উৎসে কর আদায় বৃদ্ধি, আধুনিক শুল্ক আইন প্রণয়ন প্রভৃতি শর্ত উল্লেখযোগ্য।
সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে হবে। এক্ষেত্রে অর্থের অপচয় হ্রাস করতে উন্নয়ন প্রকল্প বাছাই কার্যক্রম শক্তিশালী করতে হবে। আর সরকারের বিনিয়োগ প্রোগ্রামের যথাযথ বাস্তবায়নে ২০২৪ সালের মধ্যে পাঁচটি খাত ও ২০২৫ সালের মধ্যে আরও পাঁচটি খাত চিহ্নিত করতে হবে। এছাড়া উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) যাচাই-বাছাইয়ে কর্মদক্ষতা বাড়াতে হবে।
ব্যাংকিং খাতের শর্তের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মনিটরিং কার্যক্রম শক্তিশালী করা, মুদ্রানীতির বাস্তবায়ন জোরদার করা, বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনা সংস্কার, রিজার্ভ বাড়ানোর কার্যক্রম গ্রহণ উল্লেখ্যযোগ্য। এছাড়া আর্থিক খাত সংস্কার ও সুশাসন নিশ্চিত করা, খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা, পুঁজিবাজার উন্নয়নে পদক্ষেপ নিতে হবে।
অন্যান্য শর্তের মধ্যে সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম শক্তিশালী করা, বাজেট বাস্তবায়ন অগ্রগতি প্রতি তিন মাস পর পর প্রকাশ, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা, পিপিপি কার্যক্রম শক্তিশালী করা, বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ শক্তিশালী করা, শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির কার্যক্রম গ্রহণ করা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ, জলবায়ু অর্থায়ন তহবিল গঠন ও সুষ্ঠু ব্যবহার, নি¤œ কার্বন নিঃস্বরণকারী অর্থনীতি বিনির্মাণ, জলবায়ু সহিষ্ণু অবকাঠামো নির্মাণ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ঋণের আওতায় যেসব শর্ত আইএমএফ দিয়েছে সেগুলো যথাযথ পরিচালনও মনিটরিং করবে আইএমএফ।