নিজস্ব প্রতিবেদক: ২০১৯ সালে সামিট গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালের হাত ধরে বাংলাদেশে বিদ্যুতের ব্যবসা শুরু করে জাপানের প্রতিষ্ঠান জেরা। দুই হাজার ৭৭৩ কোটি টাকা বিনিময়ে জেরা সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালের ২২ শতাংশ শেয়ার কেনে। এরপর আরও কিছু প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কিনে নেয় কোম্পানি। বর্তমানে জেরার বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা দাঁড়ায় ৭৮৩ মেগাওয়াট।
ব্যবসা শুরুর পর থেকে গত চার অর্থবছরে (২০১৯-২০ থেকে ২০২২-২৩) বিদেশি এ প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ থেকে দুই হাজার ৩৪ কোটি টাকার ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে গেছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে নিয়েছে এক হাজার ৩৪৮ কোটি টাকা (প্রায় ২১ কোটি ডলার)। আর এলএনজি টার্মিনাল থেকে ৬৮৬ কোটি টাকা নিয়েছে। বাংলাদেশ বৈদেশিক দেনা-বিষয়ক কর্মজোট বিডব্লিউজিইডির এক প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে।
বিডব্লিউজিইডি বলেছে, বৈদেশিক মুদ্রার চরম সংকটের সময় এই বিপুল পরিমাণ ডলার দেশের বাইরে চলে যাওয়ায় তা অর্থনীতির ওপর নতুন করে চাপ তৈরি করেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে জেরা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৩৩৫ কোটি এবং এলএনজি টার্মিনাল থেকে ১৪৭ কোটি টাকার ক্যাপাসিটি চার্জ পায়। ওই অর্থবছর দুই খাত থেকে নিয়ে যায় ৪৮২ কোটি টাকা। পরের (২০২০-২১) অর্থবছর বিদুৎকেন্দ্র থেকে ৩৩৮ কোটি এবং এলএনজি টার্মিনাল থেকে ১৬৬ কোটি টাকার ক্যাপাজিটি চার্জ নেয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে মোট ক্যাপাসিটি চার্জ নেয় ৫০৪ কোটি টাকার। এছাড়া ২০২১-২২ অর্থবছরে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ হয় ৩২১ কোটি এবং এলএনজি টার্মিনাল থেকে ১৮১ কোটি টাকা। ওই অর্থবছরে সর্বমোট ক্যাপাসিটি চার্জ নেয় ৫০২ কোটি টাকা। আর গত অর্থবছর প্রতিষ্ঠানটি ৩৫৪ কোটি টাকা বিদুৎকেন্দ্র এবং ১৯২ কোটি টাকা এলএনজি টার্মিনাল থেকে ক্যাপাজিটি চার্জ নিয়ে যায়। ফলে ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট ক্যাপাসিটি চার্জ হয় ৫৪৭ কোটি টাকার। অর্থাৎ গত চার বছরে বিদ্যুৎকেন্দ্র ও এলএনজি টার্মিনাল থেকে দুই হাজার ৩৪ কোটি টাকার ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে গেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গ্যাস সরবরাহ করা হোক বা না হোক এলএনজি টার্মিনাল বাবদ প্রতিদিন দুই লাখ ১৭ হাজার ডলার ( বছরে ৮৭১ কোটি লাখ টাকা) ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়। মালিকানার হার অনুসারে জেরা গত চার অর্থবছরে (২০১৯-২৩) ৬৮৬ কোটি টাকার ক্যাপাসিটি চার্জ গ্রহণ করেছে।
এরই মধ্যে সামিট পাওয়ার ও জেরা যৌথভাবে মহেশখালীতে আরও একটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন করার জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব দিয়েছে। গত জুনে সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির পক্ষ থেকে প্রস্তাবের নীতিগত অনুমোদন দেয়া হয়েছে। প্রতিদিন ৬০ কোটি ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ করার ক্ষমতাসম্পন্ন এ টার্মিনাল তৈরিতে প্রায় ৫০ কোটি ডলার খরচ হবে। ২০২৬ সালে চালু হতে যাওয়া এ টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরবরাহ করা হোক বা না হোক ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ প্রতি মাসে ৭৮ লাখ ডলার বা এক বছরে ৯ কোটি ৩৭ লাখ ডলার দিতে হবে। সংস্থাটির মতে, ওই এলএনজি টার্মিনাল বাংলাদেশকে আরও পরনির্ভর করে তুলবে এবং তা দেশের জ্বালানি নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলে দেবে।
জানা যায়, নতুন বিদুৎকেন্দ্র কেনার পর ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত বাংলাদেশে জেরার মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা দাঁড়ায় ৭৮৩ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ১৬৬ মেগাওয়াট জীবাশ্ম গ্যাস, ১৬৯ মেগাওয়াট ফার্নেস অয়েল ও ৪৪৮ মেগাওয়াট এলএনজিভিত্তিক। বিডব্লিউজিইডি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন, জ্বালানি নিরাপত্তা, সাধারণ নাগরিকদের সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ এবং ভবিষ্যৎ প্রজšে§র জন্য একটি সবুজ ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের জন্য সরকার ও জ্বালানিসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাছে জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ প্রত্যাহারসহ পাঁচটি দাবি রাখে।
তারা মনে করেন, বর্তমান পৃথিবীর সব থেকে বড় জীবাশ্ম জ্বালানি কোম্পানিগুলোর মধ্যে জেরা অন্যতম। নতুন যুগের জাপানি জ্বালানি সেøাগান দিয়ে কার্যক্রম শুরু করলেও জীবাশ্ম জ্বালানিতে ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে এটি ডাইনোসর যুগের জ্বালানি কোম্পানি হিসেবে পরিচিত হচ্ছে। তাই আগামী প্রজš§ ও পৃথিবী বাঁচাতে এ বিনিয়োগ বন্ধ করতে হবে।
এছাড়া নির্মাণাধীন ও প্রস্তাবিত সব জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক প্রকল্প বাতিল এবং ২০৫০ সালের মধ্যে শতভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানি বাস্তবায়ন করার জন্য পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করতে হবে, পরিবেশ দূষণের ক্ষতিপূরণ বাবাদ গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের মূল্য পরিশোধ করতে হবে এবং জেরার জ্বালানি প্রকল্প দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় জনসাধারণকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।